ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

কৃষিযন্ত্র বিতরণে অনিয়ম

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ১৪ অগাস্ট, ২০২৪ ০৯:১৭ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫৫ বার


কৃষিযন্ত্র বিতরণে অনিয়ম

টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলে সরকারি ভর্তুকিমূল্যে দেওয়া বিভিন্ন কৃষি যন্ত্র (মেশিন) কৃষকদের মাঝে বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।  

প্রকৃত কৃষকদের না দিয়ে এসব যন্ত্র দেওয়া হয়েছে প্রভাবশালী ব্যক্তি, দালালদের।

এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির লোকের নামেও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এসব কৃষিযন্ত্র। আর এসব কিছুর মূলে রয়েছেন খোদ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা। তার স্বাক্ষরেই সরকারের ভতুর্কির টাকা উত্তোলন করতে পারে মেশিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। এ জন্য কৃষি কর্মকর্তাকে প্রতি হারভেস্টারে দিতে হয় নগদ এক লাখ টাকা।  

 

তবে টাঙ্গাইল সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলছেন, সারা বাংলাদেশেই একই চিত্র। আমি টাকা নিলে সমস্যা কি। এই টাকাটা কোম্পানি তার মতো অনেককেই অনারিয়াম দিয়ে থাকে।

জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় ভর্তুকিমূল্যে কৃষি যন্ত্র কম্বাইন হারভেস্টার ১৬টি এবং মেইজ শেলার বিতরণ করা হয়েছে ৫টি। এর মধ্যে টাঙ্গাইল পৌর এলাকায়ই ৯টি, ঘারিন্দা ইউনিয়নে তিনটি, গালা ইউনিয়নে তিনটি, করটিয়ায় দুইটি, মাহমুদনগরে দুইটি, বাঘিল ও ছিলিমপুরে একটি করে মেশিন বিতরণ করা হয়েছে। তবে এসব বেশিরভাগ মেশিনের কোনো হদিস নেই।

এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে নতুন করে টাঙ্গাইলে ১৫ জন কৃষকের মাঝে কৃষি যন্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। এরমধ্যে বিভিন্ন কোম্পানির ১০টি হারভেস্টার, তিনটি রাইস  ট্রান্সপ্লান্টার এবং দুইটি রিপার বাইন্ডার।  

এরমধ্যে গত ২৭ নভেম্বর টাঙ্গাইল সদর উপজেলার হুগড়া ইউনিয়নের উত্তর হুগড়া গ্রামের মৃত মোবারক আলী সরকারের ছেলে মৎস্যজীবী লীগের নেতা মো. আমিরুল ইসলামকে আদি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডকে কম্বাইন হারভেস্টার দেওয়া হয় সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে। এতে সরকারি ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ১৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা। বাকি টাকা আমিরুল ইসলামকে পরিশোধের শর্ত দেওয়া হয়েছে। আমিরুলের বাড়িতে গিয়ে মেশিনের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। তবে আমিরুল জানান, মেশিনটি তিনি নেননি। মেশিনটি তার ভাই নিয়েছেন এবং তার ভাইয়ের কাছেই মেশিনটি রয়েছে। এছাড়া এ ধরনের সংবাদ প্রকাশ করলে প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে মানহানীর মামলা করার হুমকি দেন তিনি।

এবছর গালা ইউনিয়নেও চারটি এবং টাঙ্গাইল পৌর এলাকায় পাঁচটি কৃষি যন্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। এরমধ্যে গালা ইউনিয়নের সদুল্যাপুর এলাকায় মজনু আহমেদ, রাবনা এলাকার আল আমিন এবং পৌর এলাকার এনায়েতপুরের মোঃ তোফাজ্জল হোসেন বাবুর নামে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব মেশিনে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে সাত লাখ ৬০ হাজার টাকা। তবে এদের কারো বাড়িতেই রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের হদিস পাওয়া যায়নি।  

তবে মজনু মিয়া এবং তোফাজ্জল হোসেন বাবু জানান, তারা কয়েকজন পাটনার আছেন। তারা চারটি মেশিন পেয়েছেন। এসব মেশিন এনায়েত হোসেন বাবু নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে রেখে দেওয়া হয়েছে।  

এদিকে টাঙ্গাইল পৌরসভার তিন নং ওয়ার্ডের পশ্চিম আকুরটাকুর পাড়া এলাকার মোঃ নূর আবু নিশাত। তিনি চাকরি করেন কৃষিবিদ এগ্রিকালচার লিমিটেড কোম্পানিতে। তার নামেও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে রিপার বাইন্ডার। আর এ মেশিনে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে দুই লাখ টাকা। এছাড়া কাগমারা এলাকার সুনিল চন্দ্র দাসের নামেও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে রিপার বাইন্ডার। তাকেও দুই লাখ টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, কোম্পানির লোক এসে তার কাছ থেকে মেশিন নিয়ে গেছে। বিনিময়ে তাকে অল্প কিছু টাকা দেওয়া হয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কৃষিযন্ত্র সরবরাহের আগেই কৃষকের সাথে কৃষি অধিদপ্তরের একটি চুক্তিপত্র করতে হয়। ওই চুক্তিপত্রে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাসহ তিনজন এবং কৃষকের পক্ষে তিনজন সাক্ষীর স্বাক্ষরের পর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা স্বাক্ষর করে মেশিন সরবরাহ করার কথা।

কম্বাইন্ড হারভেস্টার বিতরণে অনিয়ম বড় ধরনের। একটি মেশিনে দুই লাখ থেকে প্রায় ১৬ লাখ টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি দেয় সরকার। কৃষি কর্মকর্তা তার পছন্দের কৃষক নির্বাচন করে কৃষক ও কৃষিকর্মকর্তা কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করে ডাউন পেমেন্ট ৮লাখ টাকা দিয়ে মেশিন এনে কৃষককে বুঝিয়ে দেন। কৃষকের প্রাপ্তি স্বীকার নিয়ে কোম্পানি সরকারের ভর্তুকির টাকা আবেদন করে আদায় করে থাকে। এরপরে কৃষিকর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে ওই মেশিন বিক্রি করে টাকা ভাগাভাগি করে নেন দুই পক্ষ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কৃষি কর্মকর্তা জানান, যারা মেশিনের জন্য আবেদন করেন তাদের মেশিন দেওয়া হয় ঠিকই। কিন্তু কেউ মেশিন নিয়ে কাজে লাগান আবার কোম্পানির লোকজন এই মেশিন দিয়ে ব্যবসা করেন। এ নিয়ে অডিট শুরু হলে কোনো কৃষকের বাড়িতে মেশিন না থাকলে কোম্পানির লোকজন ওই কৃষকের বাড়িতে লোবেট ভাড়া করে মেশিন পাঠিয়ে দেন। অডিট চলে গেলে আবার মেশিনটি ফিরিয়ে নিয়ে আসে কোম্পানির লোকজন। বিনিময়ে ওই কৃষককে দেওয়া হয় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। আবার এই একই মেশিন শুধু নাম্বার প্লেট পরিবর্তন করে অন্য কৃষকের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শুধু অডিট টিমকে দেখানোর জন্য। এভাবেই একটি মেশিন বারবার দেখানো হয় অডিট টিমকে।

ভর্তুকিমূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য এসিআই মোটরস লিমিটেড, আদি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, মেটাল অ্যাগ্রিটেক লিমিটেড, বাংলা মার্ক, এসকিউ অ্যাগ্রিকালচার লিমিটেড ও কৃষিবিদ অ্যাগ্রিকালচার লিমিটেডসহ ৩৪ কোম্পানিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। আর এসব কোম্পানির সঙ্গে কৃষকরা চুক্তি করার আগে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা বিভিন্ন কোম্পানির লোকদের সঙ্গে দেনদরবার শুরু করেন কে কত দেবেন। যে বেশি টাকা দেবে সেই কোম্পানির মেশিনই সরবরাহ করা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।

সমতলে ৫০ শতাংশ ভর্তুকিমূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি গরিব কৃষকদের দেওয়ার কথা। অভিযোগ রয়েছে, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের ভর্তুকির সুবিধায় ভাগ বসাচ্ছেন অসাধু কর্মকর্তা, যন্ত্র সরবরাহকারী কিছু কোম্পানি ও স্থানীয় দালাল। ভর্তুকির যন্ত্রের জন্য ঘুষ, যন্ত্রের দাম বাড়িয়ে কৃষকের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায়, ভুয়া উপকারভোগী বানিয়ে পুরো যন্ত্রের টাকা আত্মসাৎ, প্রকৃত কৃষকের বদলে অন্যকে যন্ত্র দেওয়া, মানহীন যন্ত্র সরবরাহ, যন্ত্র বিতরণে প্রভাবশালীদের প্রভাব, নষ্ট হলে কোম্পানিগুলোর বিক্রয়োত্তর সেবা না দেওয়া, এক যন্ত্র কয়েকবার বিক্রি করে একাধিকবার ভর্তুকি নেওয়াসহ রয়েছে নানা অভিযোগ।

ভর্তুকির কৃষিযন্ত্র দিতে অনেক কৃষকের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্ট্যাম্পে সই নেওয়া হয়েছে। যন্ত্র হস্তান্তরের অনুষ্ঠানের পর সরবরাহকারী কোম্পানি যন্ত্রটি তাদের শোরুমে ফেরত নিয়ে অন্য কোনো কৃষকের কাছে বিক্রি ও হস্তান্তর করেছে।

টাঙ্গাইল শহরের বিভিন্ন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সাড়িসাড়ি রাখা হয়েছে হারভেস্টারসহ বিভিন্ন কৃষিযন্ত্র। যন্ত্রটি দেখে যে কেউ বুঝবে এটি কৃষকদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া যন্ত্র। কারণ প্রতিটি যন্ত্রের গায়ে লেখা রয়েছে ‘সরকারি উন্নয়ন সহায়তার আওতায় সরবরাহকৃত, হস্তান্তর যোগ্য নহে। সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প, ডিএই। ’ অথচ এইসব মেশিন পুনরায় বিক্রি করছে বিভিন্ন কোম্পানি।

এ বিষয়ে টাঙ্গাইল সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রোমানা আক্তার জানান, নিয়ম অনুযায়ী কৃষকদের মাঝে কৃষিযন্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। তবে কৃষকদের মাঝে প্রতি হারভেস্টার বিতরণের সময় কোম্পানির কাছ থেকে এক লাখ টাকা করে নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, এটি কোম্পানির লোক তাকে অনারিয়ারম দেয়। এছাড়া সারা বাংলাদেশের একই চিত্র। সবাই টাকা নেয়, আমি নিলে সমস্যা কি।


   আরও সংবাদ