ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২২ অগাস্ট, ২০২৪ ১২:৪৭ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ১৬১ বার
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন-১
কয়েকজন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ( রাজউক)-এর প্রধান প্রকৌশলী হওয়া উজ্জ্বল মল্লিককে অবশেষে শোকজ করা হয়েছে। শোকেজে বলা হয়েছে, তিনি ২০২০ সালের বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন নিয়মমাফিক অনুবেদনকারী কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ হেলালী ( প্রধান প্রকৌশলী, বাস্তবায়ন)-এর কাছ থেকে গ্রহণ না করে অন্য এক কর্মকর্তার কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন, যা চাকুরি বিধিমালা, ২০১৩ অনুযায়ী সাধারণ আচরণ ও শৃক্সখলা পরিপন্থী এবং গুরুদন্ড আরোপযোগ্য অপরাধ। এমন অবস্থায় বিধি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে কেন বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তা তিন কার্যদিবসের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে।
ছাত্রজনতার গণঅভ্যূত্থানের পর গত ৮ আগষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের দিন তাকে এ শোকজ করা হয়। তবে কেবল গোপনীয় অনুবেদন গ্রহণে অনিয়ম নয়, প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই। অভিযোগ আছে, কয়েক কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে কয়েকজন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী হন তিনি। পদে বসে তিনি সে টাকা সুদে-আসলে তুলেও নিয়েছেন বলে শোনা যায়। ।
জানা যায়, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশক্রমে রাজউকের সিনিয়র প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ হেলালীকে প্রধান প্রকৌশলী পদে পদায়ন করা হয়। কিন্তু সংস্থাটির ওই সময়ের চেয়ারম্যান সাইদ নুর-আলম মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তার পরিবর্তে জুনিয়র প্রকৌশলী উজ্জল মল্লিককে পদায়ন করেন। অভিযোগ আছে, উজ্জ্বল মল্লিক অনিয়মতান্ত্রিকভাবে দায়িত্ব পাওয়ার পর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে রাজউকের প্রকৌশলীদের মধ্যে গ্রুপিং তৈরি করে বিভিন্ন অনিয়মে লিপ্ত হন। আধিপত্য বজায় রাখতে গড়ে তোলেন গুন্ডা বাহিনী। গুন্ডা লেলিয়ে দিয়ে তিনি সিনিয়র প্রকৌশলীদের কোনঠাসা করে রাজউকে অনিয়ম-দুর্নীতির রাজত্ব কায়েম করেন। তার প্রথম শিকার সিনিয়র প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম। অভিযোগ, তার রুমে গুন্ডা পাঠিয়ে শুধু টেবিল চেয়ার ভাঙচুর করা নয়, তাকে ‘জামায়াতের লোক’ আখ্যা দিয়ে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত ও গালিগালাজ করা হয়।পরবর্তীতে একই ধরণের ঘটনা ঘটে প্রকল্প পরিচালক রাহাত মুসলেমীনের ক্ষেত্রেও। তাকে বিএনপির সমর্থক আখ্যা দিয়ে তার রুমে ভাঙচুর করা হয় এবং তাকেও শারীরিকভাবে হেনেস্তা করা হয়।
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তার দাপট বেড়ে যায়। এছাড়া চট্টগ্রামের লোক হিসাবে তিনি নানা সুবিধা আদায় করে নেন। চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ফজলে করিম চৌধুরীর নাম ভাঙ্গিয়ে নিজ পদ মর্যাদা বাড়িয়ে নেন। পরবর্তীতে ইঞ্জি. মোশারফ হোসেন (চট্রগ্রাম) মন্ত্রী হবার পর উজ্জল মল্লিকের আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তার স্বেচ্ছাচারিতা তখন চরম আকার ধারণ করে। এই সুযোগে তিনি সিনিয়রদেরকে ডিঙ্গিয়ে একাধিকবার পদন্নোতি নেন।
পূর্বাচল প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন, প্লট বরাদ্দ, পানি সরবরাহ লাইন স্থাপন, মাটি ভরাট এবং রাস্তা ও ড্রেন প্রশস্তকরণসহ বিভিন্ন কাজে যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের অন্যতম এই উজ্জ্বল মল্লিক। তিনি কমবেশি ১২ বছর ছিলেন এ প্রকল্পের বিভিন্ন দায়িত্বে। দুর্নীতি দমন সংস্থার তিন সদস্যের একটি টিম এসব অভিযোগ অনুসন্ধানে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে।
অভিযোগ রয়েছে, উজ্জ্বল মল্লিক পূর্বাচল প্রকল্পের পরিচালক থাকাকালে তার নামে বরাদ্দকৃত পাঁচ কাঠার প্লটটি বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৬৫ কাঠা করেন। শুধু তাই নয়, প্লটটির জন্য এমনভাবে লে-আউট পরিবর্তন করেন, তার আশেপাশে শুধু প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডাটা এক্সপার্টের মালিক জাহাঙ্গীর কবীরের প্লট ছাড়া আর কোনো প্লট নেই। তিনি জাহাঙ্গীর কবীরকে ম্যানেজ করেই লে-আউট পরিবর্তন করেন।
শুধু যে নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে তা নয়, কম দামে নেয়ার জন্য প্লটের শ্রেণিতেও আনা হয় পরিবর্তন। বাণিজ্যিক ব্লকে অবস্থিত প্লট দুটির বাজারদর কমপক্ষে ২০ কোটি টাকা হলেও আবাসিক প্লট হিসেবে তা বিক্রি হয়েছে মাত্র সাড়ে ৩৭ লাখ টাকায়। এতে রাজউক কম পেয়েছে প্রায় ১৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা। উজ্জ্বল মল্লিক প্রকল্প পরিচালক থাকাকালে অতি নিম্মমাণের কাজের জন্য তাকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
রাজউকে গুঞ্জন আছে, উজ্জ্বল মল্লিক স্বভাবেই "গুরুমারা শিষ্য"। একের পর এক গুরুদের ল্যাং দিয়ে তিনি দখলে নেন প্রধান প্রকৌশলীর চেয়ার। পূর্বাচল প্রকল্পে তার গুরু বা বস ছিলেন নুরুল ইসলাম। কলাকৌশল করে একপর্যায়ে তাকে সরিয়ে নিজেই হয়ে যান বস ( প্রকল্প ব্যবস্থাপক)। পরে প্রকল্প পরিচালক আব্দুল আউয়ালকে সরিয়ে ওই পদ দখল করেন। সর্বশেষ একইভাবে প্রধান প্রকৌশলী আবদুল লতিফ হেলালীকে সরিয়ে ওই পদে বসেন। রাজউকে তার অনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে টু-শব্দটি করার সাহস কারো ছিল না। গত ৫ আগষ্ট ছাত্রজনতার গণঅভ্যূত্থানে দেশ ও জাতি স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছে, পরিবর্তন ঘটেছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের। এই সুবাদে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রায় সর্বত্র বইছে পরিবর্তনের হাওয়া।রাজউকেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে তার প্রতিফলন।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দৃষ্টিতে গত ৮ আগষ্ট প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিককে কারণ দর্শানো নোটিশ তারই বহিঃপ্রকাশ বলা যায়।
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানার জন্য যোগাযোগের চেষ্টা করেও উজ্জ্বল মল্লিককে সরাসরি বা ফোনে পাওয়া যায়নি। #