ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০৭:৩১ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৯৪ বার
ঢাকা: স্বৈরাচারী সরকার পতনের জন্য জুলাইয়ে যে গণ অভ্যুত্থান হয়েছে সেখানে হাজারের কাছাকাছি ছাত্রজনতা শহীদ হয়েছেন। প্রায় ৩০ হাজারের অধিক আহত হয়েছেন।
তাদের এ সাহসী আত্মত্যাগ যেন কোনোভাবে শেষ না হয় সেজন্য সম্প্রতি 'জাতীয় নাগরিক কমিটি' গঠন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে গঠিত এ নাগরিক কমিটি একটি বিকল্প রাজনৈতিক দল হয়ে উঠবে এমন আলোচনাও চলছে রাজনৈতিক মহলে।
তবে সংগঠনটির নেতারা বলেছেন, আমরা রাজনৈতিক দল নই, তবে আমাদের উদ্যোগ রাজনৈতিক। ছাত্র নাগরিকদের সংঘবদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। এখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও ছিলেন। কিন্তু দেখা গেছে বিএনপি বলছে ওদের এতজন মারা গেছে, জামায়াত বলছে ওদের এতজন মারা গেছেন তাহলে সাধারণ যে নাগরিক মারা গেছেন তাদের কি হবে! নাগরিকদের এক প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়েছে।
শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর ) বিকেলে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির পক্ষ থেকে এসব কথা বলা হয়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী, সদস্যসচিব আখতার হোসেনসহ অন্যান্য নেতারা।
লিখিত বক্তব্যে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশ দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী সরকারের হাত থেকে মুক্ত হয়। জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পরিণত হয় সারা বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির আন্দোলনে। ছাত্র জনতার কাছে পরাজিত হয় ফ্যাসিস্ট শক্তি। এ আন্দোলনে হাজারের কাছাকাছি মানুষ শহীদ হয়েছেন। তাদের এ সাহসী আত্মত্যাগই বাংলাদেশের সামনে নতুন সুযোগ শুরু করেছে এগিয়ে যাওয়ার।
এ দেশে দ্বিধা ও বিভক্তর কারণে কোনো ইস্যুতেই জাতীয় ঐক্য তৈরি হয় না উল্লেখ করে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, আমরা আমাদের স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার করছি। কিন্তু এটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় কষ্টের যে এতদিন পরও আমাদের মধ্যে কোনো ইস্যুতেই জাতীয় ঐক্য নেই। সব কিছুই নিয়েই আমরা দ্বিধা-বিভক্ত। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের মতো প্রাথমিক রাষ্ট্রীয় কাজও এখানে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এর সুযোগ নেয় বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী। এর কারণে স্বাধীনতার এত দিন পরও আমরা ন্যূনতম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বাংলাদেশে তৈরি করতে পারিনি। পাঁচ বছর পর পর ক্ষমতা হস্তান্তর হবে কি প্রক্রিয়ায় তা নিয়েই এতদিনে কোনো ঐক্যে পৌঁছানো যায়নি। ফলে, আমাদের এ নাগরিক কমিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, জনগণসহ সব রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যে বাংলাদেশ পুনর্গঠনে জাতীয় ঐক্য তৈরি করা।
লিখিত বক্তব্যে সামান্তা শারমিন আরও বলেন, ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন হয়েছে কিন্তু ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার এখনো বিলোপ হয়নি। ফ্যাসিবাদ স্রেফ একটি সরকার নয়। এটি একটা ব্যবস্থা যা বিভিন্ন আইন, প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক চর্চার মাধ্যমে টিকে থাকে। আমরা সে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ চাই। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে নতুন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরিতে কাজ করবে নাগরিক কমিটি। এমন একটি বন্দোবস্ত আমরা তৈরি করতে চাই যাতে সামনের দিনে কোনো সরকার প্রধানকে শেখ হাসিনার মতো পালিয়ে যেতে না হয়।
সামান্তা বলেন, জাতীয় নাগরিক কমিটি তরুণদের নেতৃত্বে তৈরি হওয়া একটি প্ল্যাটফর্ম। আমরা সামনের দিনের বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য তরুণসহ সব নাগরিককে এ প্ল্যাটফর্মে একত্র করতে চাই। রাষ্ট্র পুনর্গঠনে জনগণকে আমরা সম্পৃক্ত করতে চাই। মানুষের মধ্যে যেই গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে তাকে বাস্তবতায় পরিণত করতে চাই আমরা।
এরই মধ্যে সংস্কারের লক্ষ্যে ৬টি কমিশন গঠন করেছে সরকার। আমরাও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত একত্রিত করে প্রস্তাবনা তুলে ধরব কমিশনের কাছে। আমরা চাই কমিশনগুলো তাদের কাজের সময় আন্দোলনরত সকল শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে এ কাজ করবে। যেন ঐক্যমত্যের মধ্য দিয়ে এসব সংস্কার পরিকল্পনা তৈরি করা হয়।
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র আরও বলেন, ফ্যাসিস্ট পতনের ১ মাসের ওপর সময় হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও শহীদদের নামের তালিকা সম্পূর্ণ করেনি সরকার। এ বিলম্ব গ্রহণযোগ্য নয়। অনেক আহত আছেন, যারা সুচিকিৎসা পাচ্ছেন না। প্রত্যেকদিনই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ সংক্রান্ত খবর আসছে। সরকারের অবিলম্বে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সব শহীদ ও আহতদের নামের তালিকা দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকাশ করতে হবে। আহতদের জন্য সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করা সরকারের দায়িত্ব। সরকারকে তা নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, বিভিন্ন রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারে ফ্যাসিবাদী শক্তির পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চলছে। এ ব্যাপারে আমরা সজাগ আছি। একই সঙ্গে এ বিষয়ে জনগণকে সজাগ থাকারও আহ্বান জানান তিনি।
ঘোষিত ৮ দফা বাস্তবায়নে অচিরেই নাগরিক কমিটি সারাদেশে জনসংযোগ কার্যক্রম শুরু করবে জানিয়ে আত্মপ্রকাশের ৮ দফা তুলে ধরেন জাতীয় নাগরিক কমিটি। সেগুলো হলো:
১। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হওয়া সামষ্টিক অভিপ্রায় ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে সমুন্নত রাখা।
২। ছাত্র-জনতার উপর সংঘটিত নির্মম হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি গ্রহণ করা।
৩। রাষ্ট্রের জরুরি সংস্কার ও পুনর্গঠন করার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা ও জবাবদিহিতার পরিসর তৈরি করা।
৪। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগের সঙ্গে আলোচনা, মত বিনিময় ও গণমুখী কর্মসূচির মাধ্যমে সর্বস্তরের জনতাকে সংহত করার লক্ষ্যে কাজ করা।
৫। দেশের সর্বস্তরের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বকে সংহত করে গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা সমুন্নত করে রাখার লক্ষ্যে ফ্যাসিবাদী কাঠামো ও শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত রাখা।
৬। জনস্বার্থের পক্ষে নীতি নির্ধারণের লক্ষ্যে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক সংলাপের আয়োজন করা।
৭। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নীতি নির্ধারণী প্রস্তাবনা তৈরি ও সেটা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক পদক্ষপে গ্রহণ করা।
৮। গণপরিষদ গঠন করে গণভোটের মাধ্যমে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান তৈরির জন্য গণআলোচনার আয়োজন করা।
লিখিত বক্তব্যের পরবর্তীতে প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা।
পলিটিক্যাল জাতীয় নাগরিক কমিটির ফিলোসফি কি এমন প্রশ্নের জবাবে, জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, ছাত্র-জনতা যে জন্য জীবন দিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটিয়েছে তা কিন্তু বর্তমানে হচ্ছে না। কীভাবে বাংলাদেশকে পুনর্গঠন করা যায় ওই জায়গা থেকে আমাদের আত্মপ্রকাশ। বাংলাদেশ প্রশ্নে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ।
জাতীয় নাগরিক কমিটিতে ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি আছে কি-না এবং কতজন আছে আর কে কোন সংগঠনে আছে এমন প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র সামান্তা শারমীন বলেন, এরকম কেউ আমাদের সংগঠনে নেই। তবে এখানে যারা আছে তাদের পূর্বে বিভিন্ন সংগঠনে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। সবার রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা আছে। পূর্বের কোন পদপদবি এখানে মুখ্য বিষয় নয়।
গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি এক্টিভ কি-না এ প্রশ্নের জবাবে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তির সব কার্যক্রম স্থগিত। ক্যাম্পাসে যেহেতু বর্তমানে শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতি চায় না সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে কি হবে তা পরবর্তীতে জানানো হবে। তবে আমরা চাই শিক্ষার্থীদের একটা অংশ ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় থাকবে। কারণ তারই ভবিষ্যতে দেশ গঠনে ভূমিকা রাখবে। ছাত্র সংগঠনগুলো কীভাবে কাজ করবে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি চলবে না।
সংবিধান পুনর্গঠন নাকি সংশোধন করা হবে এমন প্রশ্নের জবাবে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, এ সংবিধান একদলীয় সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে গঠন করা হয়েছে। যেটাতে গণমানুষের অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়নি। সংবিধান পুনর্গঠন নাকি সংশোধন করা উচিত এর জন্য গণ আলোচনার আয়োজন করা হবে। জনগণের অভিপ্রায় যেটা তার মাধ্যমে সংবিধান লেখা হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় বেঁধে দিতে চায় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র সামান্তা বলেন, এ সরকারকে আমরা কাজ করার সুযোগ দিতে চাই। কিন্তু আমার চাইবো মন্থর গতিতে যেন কার্যক্রম না চলে। তবে আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচিত সরকার চাইবো। অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস শেষ হওয়ার বিষয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা বলেন, আপনার অতি দ্রুত কাজগুলো শেষ করে একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
জাতীয় নাগরিক নাগরিক কমিটি কেন গঠন করা হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে নেতারা বলেন, ছাত্র নাগরিকদের সংঘবদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। এখনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও ছিল। কিন্তু দেখা গেছে বিএনপি বলেছ ওদের এতজন মারা গেছে, জামায়াত বলছে ওদের এতজন মারা গেছেন তাহলে সাধারণ যে নাগরিক মারা গেছেন তাদের কি হবে! নাগরিকদের এক প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়েছে।
দেশে জরুরি অবস্থা আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা বলেন, না নেই। দেশটাতে যেন জরুরি ভিত্তি না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে সবাইকে।