ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৫ নভেম্বর, ২০২৪ ১৬:১২ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ২৯ বার
খুলনা: হতদরিদ্র ঘরের সন্তান এস এম কামরুজ্জামান। গ্রেপ্তার বাণিজ্য, তদবির, দুর্নীতি, অনিয়ম করে কয়েক বছরে কোটিপতি বনে গেছেন পুলিশের এ এডিসি।
প্রতারণা, মিথ্যা মামলার রেকর্ড সৃষ্টি করে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের হয়রানি করে জিরো থেকে হিরো হয়েছেন বহুরূপী কামরুজ্জামান।
ব্যক্তি স্বার্থে পুলিশ বাহিনীর পেশাদারিত্ব ধ্বংস করে উচ্চাভিলাষী অপেশাদার এ কর্মকর্তা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। কামরুজ্জামান বর্তমানে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) উপ-পুলিশ কমিশনার (বোম স্কোয়াড টিমে) হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। আওয়ামী লীগের খুলনা সভাপতি কেসিসির সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের কথিত ভাগ্নে পরিচয় দেওয়ায় তার দুর্নীতিসহ অপকর্মের ফিরিস্তি নিয়ে এতদিন মুখ খুলতে পারেনি কেউ।
কে এই কামরুজ্জামান
এস এম কামরুজ্জামান বাগেরহাট জেলার রামপাল থানার শিবনগর গ্রামের দরিদ্র কৃষক মৃত আব্দুল মান্নানের ছেলে। চার ভাই-বোনের মধ্যে কামরুজ্জামান সবার বড়। কামরুজ্জামান স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ১৯৮৫ থেকে ৮৭ সাল পর্যন্ত খুলনা সিটি কলেজে পড়ালেখা করেন।
দরিদ্র বাবার সংসারে অভাব-অনটনের কারণে কামরুজ্জামান রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামের হাফিজুর রহমান মোল্লার বাড়িতে গৃহশিক্ষক হিসেবে থেকে পড়াশুনা করেন। এরপর তিনি ১৯৮৮ সালে পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) পদে চাকরি নেন। সারদায় ট্রেনিং শেষে তিনি কুষ্টিয়া, যশোর, ভোলা, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন স্থানে কর্মরত ছিলেন।
কুষ্টিয়ায় কর্মরত অবস্থায় তিনি এক মেয়ের প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় আপত্তিকর অবস্থায় এলাকাবাসী তাকে ধরে ও মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেন।
কিছুদিন পর তিনি ভোলার বোরহানউদ্দিন থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে যোগ দেন। এখানে তার অপকর্মে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর গণপিটুনিতে তার কপাল ফেটে যায়। সেই ক্ষত চিহ্ন এখনও বহন করছেন তিনি।
২০০৯ সালের ১৫ মার্চ সাতক্ষীরা সদর থানার ওসি হিসেবে যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মাথায় এপ্রিল মাসে কামরুজ্জামান আওয়ামী সমর্থিত লোকজন নিয়ে সাতক্ষীরা বাস টার্মিনাল দখল করেন। এভাবেই সাতক্ষীরার রাজনৈতিক অঙ্গন, পরিবহন সেক্টর, চোরাচালান জগৎ, সন্ত্রাসীদের আন্ডারওয়ার্ল্ড- সবকিছুর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন তিনি।
রাজশাহী রেঞ্জ থেকে এস এম কামরুজ্জামান খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় যোগদান করেন। এরপর তাকে নগরীর খালিশপুর থানায় ও পরে সদর থানায় ২০১১ সালের ১৪ মার্চে ওসি হিসেবে পাঠানো হয়।
যোগদানের কিছুদিন পরেই খুলনা স্টেডিয়াম মার্কেটে জুতা তৈরির তিন কারিগরকে থানায় ডেকে জুতা তৈরি করে দেওয়ার জন্য বলেন। তখন কারিগররা কারখানায় গিয়ে জুতা তৈরির কথা বললে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের মারধর করেন। এর প্রতিবাদে খুলনার সমস্ত জুতা কারিগর ও জুতা তৈরি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এ সময় তাদের দমন করতে আরও ১৭ জনকে থানায় নিয়ে আসা হয়। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসেন কামরুজ্জামান।
ওসি হিসেবে খুলনা থানার দায়িত্ব গ্রহণের পর কামরুজ্জামান বিরোধীদলের নেতাকর্মী দমনের বিশেষ স্কিম নেন। এমনকি হরতাল চলাকালে খুলনা-২ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে লাঠি দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করেন।
খুলনার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের দুগ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা না করলেও গাড়ি ভাঙচুর ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার মিথ্যা অভিযোগ তুলে ছাত্রদল নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার নজির সৃষ্টি করেন।
অভিযোগ রয়েছে, নিজেকে কখনও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবার খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের ভাগ্নে পরিচয় দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করতেন কামরুজ্জামান। কালো টাকা দিয়ে কামরুজ্জামান খুলনা মহানগরীর অভিজাত বাগমারা এলাকায় ১২ কাঠা জমির ওপর চারতলা বাড়ি ও পাশে ছয়তলা ফাউন্ডেশনের একটি টিনশেডের বাড়ি করেছেন।
ঢাকার উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কের ১৪ নম্বর বাড়ির মালিকও কামরুজ্জামান। এছাড়া রাজধানীর বনানীসহ অন্যান্য স্থানেও বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে তার। এছাড়া তার গ্রামের বাড়ি রামপালে নামে-বেনামে রয়েছে শত শত বিঘা ঘের ও জমি।
ছাত্রদল নেতাকে ফ্যানে ঝুলিয়ে নির্যাতন
২০১২ সালের ২২ এপ্রিল আনুমানিক সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার দিকে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার শফিকুর রহমান ও ডেপুটি পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে ওসি এস এম কামরুজ্জামানসহ সাবেক এসআই মো. শাহ আলম, মো. জেলহাজ্ব উদ্দিন, তৎকালীন পুলিশের সোর্স কাসেম, জাহিদ, তারক, ইস্রাফিল, মাথায় হেলমেট, হাতে লাঠি ও সরকারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মাহমুদুল হক টিটো ও ফেরদৌস রহমান মুন্নাকে জোরপূর্বক আটক করেন। তাদের হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ও চোখ গামছা দিয়ে বেঁধে থানায় নিয়ে আসা হয়।
পরে মাহমুদুলকে হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় থানা অভ্যন্তরে ফ্যানের হুকের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশের বেধড়ক মারধরে বাদী অজ্ঞান হয়ে পড়েন। কামরুজ্জামান তখন পুলিশ সদস্যদের বলেন, ‘শালার জ্ঞান ফেরা, আমাদের আরও কাজ বাকি আছে। ’ তখন এসআই মো. জেলহাজ্ব উদ্দিন চোখে-মুখে পানি দিয়ে তার জ্ঞান ফেরান। তিনি কোনোভাবেই বসতে পারছিলেন না। বার বার লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়। এক পর্যায়ে তৎকালীন ওসি বাদীর পেটে লাথি মেরে মেঝেতে ফেলে দেন। বলেন- ‘শালাকে ক্রসফায়ারের জন্য গাড়িতে ওঠা, সব জানতে পারবো’। শুধু তাই নয়, ২০১২ সালের ২২ এপ্রিল পুলিশ মিথ্যা মামলা দায়ের করে। যার প্রধান আসামি বাদী ও ছাত্রদল নেতা ফেরদৌস রহমান মুন্না।
এ ঘটনায় সে সময় খুলনা সদর থানার ওসি এস এম কামরুজ্জামানসহ সিপাহি আবু সুফিয়ান, সিপাহি মামুন আখতার এবং ওসির গাড়িচালক সুধাংশুকে প্রত্যাহার করা হয়।
নির্যাতিত খুলনা মহানগর ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এস এম মাহমুদুল হক টিটো বাদী হয়ে চলতি বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর খুলনা মহানগর হাকিমের আদালতে সাবেক ওসি এস এম কামরুজ্জামানসহ ৯ পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
দুদকের জালে কামরুজ্জামান
অবশেষে আলোচিত-সমালোচিত এস এম কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা হয়েছে। সোমবার (৪ নভেম্বর) দুদক খুলনার সহকারী পরিচালক রকিবুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
মামলায় সম্পদ বিবরণীতে ১৯ লাখ ৬০ হাজার টাকার তথ্য গোপন ও ১ কোটি ২ লাখ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, বাগেরহাট জেলার রামপাল থানার শিবনগর গ্রামের মৃত আব্দুল মান্নান শেখের ছেলে এবং খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (তৎকালীন সহকারী পুলিশ কমিশনার, দৌলতপুর অঞ্চল, কেএমপি, খুলনা) এস এম কামরুজ্জামান (বিপি-৬৬৮৯০৪২৭৯১) ঢাকা দুর্নীতি দমন কমিশনে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে ১৯ লাখ ৬০ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপন পূর্বক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য দেওয়া এবং ১ কোটি ২ লাখ ৩২ হাজার ৫৮২ টাকার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ অর্জন করে নিজ মালিকানা ও ভোগ দখলে রেখে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৬(২) ও ২৭(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে ১ কোটি ৮৭ লাখ ৭২ হাজার ১৪৯ টাকার স্থাবর এবং ১ কোটি ২ লাখ ৪৯ হাজার ৬৯৭ টাকার অস্থাবর সম্পদসহ সর্বমোট ২ কোটি ৯০ লাখ ২১ হাজার ৮৪৬ টাকার সম্পদ প্রদর্শন করেন। কিন্তু অনুসন্ধানকালে এস এম কামরুজ্জামানের নামে ২ কোটি ৭ লাখ ১২ হাজার ১৪৯ টাকার স্থাবর এবং ১ কোটি ২ হাজার ৬৯ হাজার ৬৯৭ টাকার অস্থাবরসহ সর্বমোট ৩ কোটি ৯ লাখ ৮১ হাজার ৮৪৬ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ পাওয়া যায়। অর্থাৎ তিনি তার দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে ১৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা মূল্যের স্থাবর/অস্থাবর সম্পদের তথ্য গোপন পূর্বক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য দেওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৬(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
অনুসন্ধানকালে রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, সম্পদ বিবরণী দাখিলকালে আসামি এস এম কামরুজ্জামানের ২ কোটি ৭ লাখ ১২ হাজার ১৪৯ টাকার স্থাবর এবং ১ কোটি ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬৯৭ টাকার অস্থাবরসহ সর্বমোট ৩ কোটি ৯ লাখ ৮১ হাজার ৮৪৬ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। উক্ত সময়ে তার ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং ফাইন্যান্স করপোরেশন ও রূপালী ব্যাংকে ৪৫ লাখ টাকার দায় ছিল। সুতরাং দায় বাদে তার নিট সম্পদের মূল্য ২ কোটি ৬৪ লাখ ৮১ হাজার ৮৪৬ টাকা। তার অতীত জীবনের সঞ্চয়, বেতন-ভাতার আয়, বাড়ি-ভাড়ার আয়, মাইক্রোবাস ভাড়া থেকে আয়, সঞ্চয়পত্রের সুদ প্রাপ্তি ও জমি বিক্রয় বাবদ মূলধনি আয় থেকে মোট গ্রহণযোগ্য আয়ের পরিমাণ ২ কোটি ২৪ লাখ ৮১ হাজার ৭১৮ টাকা। তিনি পারিবারিক ব্যয় ও ঋণ পরিশোধ বাবদ ৬২ লাখ ৩২ হাজার ৪৫৪ টাকা ব্যয় করেন। অর্থাৎ তার নিট আয়/সঞ্চয়ের পরিমাণ ১ কোটি ৬২ লাখ ৪৯ হাজার ২৬৪ টাকা। ফলে এস এম কামরুজ্জামানের জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ দাড়ায় ১ কোটি ২ লাখ ৩২ হাজার ৫৮২ টাকা। সুতরাং এস এম কামরুজ্জামান বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগে চাকরি করার সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ১ কোটি ২ লাখ ৩২ হাজার ৫৮২ টাকার সম্পদ অর্জন করে নিজ মালিকানা ও ভোগ দখলে রেখে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
দুদক খুলনার সহকারী পরিচালক রকিবুল ইসলাম বলেন, কামরুজ্জামান বর্তমানে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) উপ-পুলিশ কমিশনার (বোম স্কোয়াড টিমে) হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ১৯ লাখ ৬০ হাজার টাকার তথ্য গোপন ও ১ কোটি ২ লাখ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনে দুদকে মামলা করা হয়েছে। কমিশন থেকে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হবে। তিনি তদন্ত করে চার্জশিট দেবেন। প্রক্রিয়া অনুসারে মামলা এগোবে।