ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর, ২০২৪ ১০:০৮ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ১৯ বার
ঢাকা: ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মেঘনা-গোমতী, চট্টগ্রামের শাহ আমানত (কর্ণফুলী), ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জসহ দেশের ২৬টি সেতুর নির্মাণ ব্যয় উঠে গেলেও আদায় হচ্ছে টোল। এ টোলহার সেতু নির্মাণের পর নির্ধারণ হলেও এরপর কয়েক দফা বেড়েছে।
একই সঙ্গে সেতুগুলো থেকে টোল আদায়ে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। যাদের পেছনে টোল আদায়ের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যয় উঠে গেলে সরকারের উচিত পর্যালোচনা করে টোল আদায় বন্ধ করা।
এছাড়া বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে টোল আদায়ে ঠিকাদার নিয়োগ করা রাষ্ট্রের অর্থ অপচয়ের শামিল; যা কখনো কাম্য হতে পারে না। জানা যায়, ২০১৪ সালে সওজের অধীন সড়ক, সেতু, পাতালপথ (টানেল), উড়ালসড়ক ও ফেরি থেকে টোল আদায়ে নীতিমালা প্রণয়ন করে সরকার। নীতিমালায় ২০০ মিটারের দীর্ঘ সব সেতু টোলের অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া যেসব জায়গায় ফেরি চলাচল বন্ধ করে সেতু নির্মাণ করা হয়েছে, ২০০ মিটারের কম দৈর্ঘ্যের হলেও সেগুলোয় কমপক্ষে এক বছর পর্যন্ত টোল আদায়ের কথা বলা হয়েছে। নীতিমালায় বিভিন্ন শ্রেণির সড়কের ভিত্তি টোল ১০০ থেকে ৪০০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। যানবাহনের শ্রেণি এবং সেতুর দৈর্ঘ্যের ওপর তা বাড়ে-কমে। তবে একটি সেতু, সড়ক বা স্থাপনা থেকে কত দিন পর্যন্ত টোল তোলা হবে, নীতিমালায় তা উল্লেখ করা হয়নি।
ব্যয় উঠলেও যেসব সেতু থেকে টোল আদায় হচ্ছে: ২০০৯ সাল থেকে রূপগঞ্জের কাঞ্চন সেতুর টোল আদায় হচ্ছে। ১৯৯১ সাল থেকে মেঘনা-গোমতী, ২০১০ সাল থেকে চট্টগ্রামের শাহ আমানত, ২০০৬ সাল থেকে ঘোড়াশাল, ১৯৯১ সাল থেকে গড়াই, ২০০৩ সাল থেকে দোয়ারিকা-শিকারপুর, ১৯৯২ সাল থেকে শম্ভুগঞ্জ, ১৯৯৩ সাল থেকে মহানন্দা, ২০০০ সাল থেকে মোল্লাহাট ও ধল্লা (ভাষাশহীদ রফিক সেতু), ১৯৯১ সাল থেকে সিলেট-শেরপুরু, ২০০৮ সাল থেকে কুষ্টিয়া সৈয়দ মাসুদ রুমি, ২০০৫ সাল থেকে তুলসীখালী ও মরিচা এবং ২০০৬ সাল থেকে কাপাসিয়া ফকির মজনু শাহ সেতুর টোল আদায় হচ্ছে। এছাড়া ১৯৯০ সাল থেকে সিলেট লামাকাজী, ২০০৫ সাল থেকে পটুয়াখালী, ১৯৯০ সাল থেকে দিনাজপুরের মোহনপুর, ২০০৩ সাল থেকে বাগেরহাটের দড়াটানা, ২০০৫ সাল থেকে চাঁদপুর, ২০০৭ সাল থেকে শেরপুরের ব্রহ্মপুত্র, ২০০৭ সাল থেকে সিলেট পঞ্জগঞ্জ, ১৯৯৯ সাল থেকে সিলেটের শেওলা, ২০০৭ সাল থেকে হযরত শাহ পরান (রহ.), ২০০০ সাল থেকে পিরোজপুরের বলেশ্বর, ২০০৭ সাল থেকে চৌডালা ও ২০০১ সাল থেকে টাঙ্গাইল হাঁটুভাঙ্গা সেতুর টোল আদায় হচ্ছে।
টোল আদায়ে ঠিকাদার: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়কে (এক্সপ্রেসওয়ে) টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার একটি কোম্পানিকে দরপত্র ছাড়া কাজ দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। টোল আদায়ের জন্য তারা বছরে পাবে প্রায় ৯৬ কোটি টাকা। অথচ বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতুতে বছরে মাত্র ১২ কোটি টাকায় টোল আদায় করছে চীনা কোম্পানি। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে কাজ পেয়ে গত ১ সেপ্টেম্বর যমুনা সেতুতে তারা টোল আদায় শুরু করে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যত কেনাকাটা ও ঠিকাদার নিয়োগের ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় সবই প্রশ্নবিদ্ধ। যোগসাজশের ব্যাপক অভিযোগ আছে। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর এক্সপ্রেসওয়ের টোল আদায় ও সেটির রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ পাঁচ বছরে কোরীয় প্রতিষ্ঠানটিকে দেবে ৭১৭ কোটি টাকা। চালুর পর এক্সপ্রেসওয়েটি থেকে এখন পর্যন্ত যে টোল আদায় হয়েছে, তার ৮০ শতাংশই চলে গেছে ঠিকাদারের পেছনে। মেঘনা-গোমতী সেতুতে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম লিমিটেডের (সিএনএস) টোল আদায়ের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দিতে ২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর সওজ দরপত্র আহ্বান করে। কিন্তু সিএনএস দরপত্র কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আদালতে যায়। তারা হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ পায়। মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পর ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দেয় সওজ। এর মধ্যে সাত বছর কাটিয়ে দেয় সিএনএস। এ কোম্পানিটির চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ভাই আরিফুল হক। আইনমন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে টোল আদায়ে ঠিকাদারির দায়িত্ব পায় সিএনএস। সিএনএস বছরে ৭৭ কোটি টাকা নিত। তবে বর্তমানে টোল আদায় করছে ও অ্যান্ড এম বাই ইউডিসি কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। এ কোম্পানির সঙ্গে তিন বছরে ৬৬ কোটি টাকার চুক্তি করা হয়।
শুধু বঙ্গবন্ধু মহাসড়ক ও মেঘনা-গোমতী সেতু নয়, বড় ও মাঝারি সেতু (যেগুলোয় টোল আদায় হচ্ছে) সবকটিতে ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। যেসব ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, অধিকাংশই আওয়ামী লীগের সরকারে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের কাছের লোক। তাদের আধিপত্যে সেতুর টোল আদায়ে ঠিকাদারি দায়িত্ব পান তারা। আবার অনেক দরপত্র ছাড়াই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যা উন্মুক্ত দরপত্রে অনেক কম টাকাতেই দেওয়া যেত।
ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়কে চলাচলকারী পরিবহন তিশা। বাসটি কুমিল্লার লাকসাম থেকে ঢাকায় যাতায়াত করে। বাসটির চালক মো. ইবরাহীম বলেন, ‘মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল আদায় চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে পাঁচ বছর আগে। মেয়াদ শেষ হওয়ার দিন কমানোর চেয়ে উল্টো ৫০ টাকা বেড়েছে। আগে ছিল ৪০০ টাকা, এখন ৪৫০ টাকা টোল দিতে হচ্ছে। এ টাকা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে। টোল আদায় বন্ধ করলে ভাড়ার টাকা অনেক কমে যাবে। সাধারণ মানুষও স্বস্তিবোধ করবে। ’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, ‘পৃথিবীর অন্যান্য দেশে টোলব্যবস্থা রয়েছে। এ টোলব্যবস্থা প্রকল্পের ব্যয় ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু আজীবনের জন্য নয়। মনে রাখতে হবে, টোল চলাচলের একটা বাধা। একটা সেতু থেকে আজীবন টাকা আদায় করা হবে সেটা যৌক্তিক নয়। ’
তিনি আরও বলেন, ‘পদ্মা সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে, টানেলসহ বড় প্রকল্পে টাকা আদায়ে ঠিকাদার নিয়োগ হয়েছে সেটা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হয়নি। বর্তমান সরকারকে ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া দেখা উচিত। যেন ভবিষ্যতে এ রকম কাজ না হয়। ’
আরেক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘জনগণের টাকা দিয়ে প্রকল্পের টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে। সুতরাং প্রকল্পের টাকা পরিশোধ করার পরও অতিরিক্ত টাকা আদায় একদম ঠিক নয়। আর সেতু নির্মাণ করা হয়েছে মানুষের যোগাযোগ ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য। সেখানে সেতুর ব্যয় পরিশোধ হলেও অতিরিক্ত টোল আদায় কাম্য হতে পারে না। ’
তিনি আরও বলেন, ‘সেতু থেকে টোল আদায়ে দরপত্র ছাড়া ঠিকাদার নিয়োগ এক ধরনের দুর্নীতি। বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় করে ঠিকাদার নিয়োগ সেটাও কাম্য হতে পারে না। ’
এ বিষয়ে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. জিকরুল হাসান বলেন, ‘টোল আদায়ে আগে নীতিমালা ছিল না। ২০১৪ সালে সরকার নীতিমালা তৈরি করে। কিন্তু নীতিমালায় টোল আদায়ে নির্দিষ্ট মেয়াদ নেই। কিন্তু পাবলিক পারসেপশন আছে যেখানে সেতুর ব্যয় উঠে গেছে সেখানে টাকা আদায় করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু টোল সরকারের রেভিনিউ খাত হিসেবে চিহ্নিত। এ খাত উন্নয়ন প্রকল্পে অংশীদার। ’