ঢাকা, শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

যে রহস্যময় রোগ ধাঁধায় ফেলেছে কানাডার চিকিৎসকদের

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৪:১৯ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৬৩৭ বার


যে রহস্যময় রোগ ধাঁধায় ফেলেছে কানাডার চিকিৎসকদের

আন্তর্জাতিক ডেস্ক; নাডার চিকিৎসকরা সম্প্রতি এমন কিছু রোগী পাচ্ছিলেন, যাদের লক্ষণ মিলে যাচ্ছে মস্তিস্কের এক বিরল রোগের সঙ্গে। ওই রোগ 'ক্রয়েটসফেল্ট ইয়াকপ ডিজিজ' (সিজেডি) নামে পরিচিত। কিন্তু চিকিৎসকরা আরো ভালোভাবে ওই রোগীদের পরীক্ষা করে যা দেখলেন, তাতে হতবাক হয়ে গেলেন।

প্রায় দুই বছর আগে রজার এলিস তার ৪০তম বিবাহবার্ষিকীতে বাড়িতে হঠাৎ খিঁচুনিতে আক্রান্ত হয়ে মাটিতে পড়ে যান। এলিসের জন্ম নিউ ব্রান্সউইকের গ্রামীণ সৌন্দর্য্যমণ্ডিত আকাডিয়ান উপদ্বীপ এলাকায়। বেড়ে উঠেছেন সেখানেই। তার বয়স মাত্র ৬০ পেরিয়েছে তখন।

সে বছরের জুন মাসেও তিনি বেশ সুস্থ-সবল একজন মানুষ ছিলেন। কয়েক দশক ধরে তিনি কাজ করেছেন শিল্প-কারখানার মেকানিক হিসেবে। তারপর কাজ থেকে অবসর নিয়ে তার সময়টা ভালোই কাটছিল। রজার এলিসের ছেলে স্টিভ এলিস জানান, যেদিন তার বাবা এভাবে খিঁচুনিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে গেলেন, সেদিন থেকে দ্রুত তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে লাগল।

তিনি আরো বলেন, বাবা দৃষ্টিবিভ্রম এবং অলীক কল্পনায় ভুগতে লাগলেন। তার ওজন কমে যেতে শুরু করল। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেল। একই কথা বার বার বলতে শুরু করলেন। তিনি আরো বলেন, একপর্যায়ে তিনি তো হাঁটতেই পারছিলেন না। মাত্র তিন মাসের মধ্যে তার অবস্থার এতটাই অবনতি ঘটল যে আমাদের হাসপাতালে ডেকে নিয়ে ওরা বলল, তাদের বিশ্বাস আমার বাবা মারা যাচ্ছেন- কিন্তু তারা বুঝতে পারছেন না, কি রোগে।

রজার এলিসের চিকিৎসকরা প্রথমে সন্দেহ করেছিলেন তিনি হয়তো 'ক্রয়েটসফেল্ট ইয়াকপ' বা সিজেডি রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এটি একধরনের হিউম্যান প্রিয়ন রোগ। 

প্রিয়ন হচ্ছে এক ধরনের প্রোটিন, যা মস্তিস্কের স্বাভাবিক প্রোটিনকে আক্রমণ করে। সিজেডি খুবই বিরল এবং মারাত্মক এক রোগ। এটি মস্তিস্কের কর্মক্ষমতা হ্রাস করতে থাকে। আক্রান্ত লোকের স্মৃতি লোপ পেতে থাকে, ব্যবহার বদলে যায় এবং তারা চলা-ফেরা, কাজে-কর্মে আর কোনো ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে না।

সিজেডির অনেক ধরনের মধ্যে একটির সম্পর্ক আছে ম্যাড কাউ ডিজিজের সঙ্গে। ম্যাড কাউ ডিজিজে আক্রান্ত পশুর মাংস কেউ খেলে, এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। রোগ হিসেবে সিজেডি-কে সেই শ্রেণিভুক্ত করা হয়, যার মধ্যে আরো আছে আলঝেইমার বা পারকিনসন্সের মতো রোগ। এরকম রোগে যখন কেউ আক্রান্ত হয়, তাদের স্নায়ুতন্ত্রের প্রোটিনগুলো বিকৃতভাবে ভাঁজ হতে থাকে।

কিন্তু চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে দেখলেন, রজার এলিসের আসলে সিজেডি হয়নি। তার পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসে। ডাক্তাররা আরো নানা রকম পরীক্ষা চালালেন। সেগুলোতেও তাদের সন্দেহ অমূলক বলে প্রমাণিত হলো। কোনোভাবেই তারা নিশ্চিত হতে পারলেন না, এলিসের অসুস্থতার কারণ আসলে কী।

তার ছেলে জানান, ডাক্তাররা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন তার বাবার নানা রকমের উপসর্গ উপশমের জন্য। কিন্তু একটা রহস্য থেকেই গেল- কেন এলিসের স্বাস্থ্য এত দ্রুত পড়ে গেল? এ বছরের মার্চ মাসে স্টিভ এলিস এই রহস্যের একটা সম্ভাব্য বা আংশিক জবাব পেলেন।

কানাডার সরকারি মালিকানাধীন রেডিও কানাডা জানাল, জনস্বাস্থ্যবিষয়ক এমন একটি নির্দেশ তাদের হাতে এসেছে, যেটি প্রদেশের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল। এতে সবাইকে এই বলে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল যে, একটি এলাকায় এমন কিছু রোগী পাওয়া যাচ্ছে, যারা মস্তিস্কের এক অজানা রোগে আক্রান্ত, যেটি মস্তিস্কের কার্যক্ষমতা ধ্বংস করে দেয়।

স্টিভ এলিস বলেন, এটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হলো, আমার বাবার তো এটাই হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে রজার এলিস এই অজানা রোগে আক্রান্তদের একজন। তিনি ডা. এলিয়ের মারেরোর অধীনে চিকিৎসাধীন। ডা. মারেরো একজন নিউরোলজিস্ট। কাজ করেন মংকটন শহরের জর্জেস এল-ডুমন্ট ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল সেন্টারে।

তিনি জানান, ডাক্তাররা প্রথম এই রহস্যজনক রোগের সন্ধান পান ২০১৫ সালে। তখন মাত্র একজন রোগীর মধ্যে তারা এটি দেখেছিলেন, কাজেই এটা একেবারেই বিচ্ছিন্ন এবং অস্বাভাবিক একটি কেস হিসেবে ধরা হয়েছিল। কিন্তু তারপর এরকম আরও অনেক কেস দেখা যেতে লাগল। এখন এত বেশি মানুষের মধ্যে এই নতুন রোগ দেখা গেছে যে ডাক্তাররা এখন এটিকে একটি স্বতন্ত্র ধরনের রোগ বলে ধরে নিয়েছেন। তবে তারা এটিকে চিহ্নিত করছেন 'আগে দেখা যায়নি' এমন ধরনের এক রোগ হিসেবে।

প্রদেশের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, তারা বর্তমানে ৪৮টি কেসের ওপর নজর রাখছেন, এর মধ্যে ২৪ জন পুরুষ, ২৪ জন নারী। তাদের বয়স ১৮ হতে ৮৫ বছরের মধ্যে। এদের সবাই নিউ ব্রান্সউইকের আকাডিয়ান উপদ্বীপ বা মংকটন এলাকার বাসিন্দা। এই ৪৮ জনের মধ্যে ছয়জন মারা গেছেন। বেশির ভাগ রোগীর উপসর্গ দেখা দিয়েছে সম্প্রতি, ২০১৮ সাল হতে। তবে এদের একজনের মধ্যে এটির লক্ষণ দেখা দেয় ২০১৩ সালে।

ডা. মারোরো জানান, এই রোগের লক্ষণ অনেক রকমের এবং রোগীভেদে লক্ষণ নানা রকম হতে পারে। প্রথমদিকে রোগীদের মধ্যে কিছু আচরণগত পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা এবং মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া। এরপর শরীরে এমন ধরনের ব্যথা-বেদনা শুরু হয়, যার কোনো ব্যাখ্যা নেই। একেবারে পুরোপুরি সুস্থ-সবল ছিলেন এমন মানুষদেরও তখন মাংসপেশির ব্যথা এবং খিঁচুনি শুরু হয়।

রোগীদের মধ্যে ঘুম নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়- অনিদ্রা বা মারাত্মক অনিদ্রায় ভুগতে শুরু করেন তারা। এরপর শুরু হয় স্মৃতি লোপ পাওয়ার সমস্যা। এরপর খুব দ্রুতই দেখা দেয় কথা বলার সমস্যা। তারা নিজেদের মনের ভাব প্রকাশে সমস্যায় পড়েন। স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারেন না। তাদের মধ্যে তোতলানোর সমস্যা দেখা দেয়, কিংবা একই শব্দ তারা বারে বারে বলতে থাকেন।

আরেকটা লক্ষণ হচ্ছে দ্রুত ওজন কমে যাওয়া। পেশি দুর্বল হতে শুরু করে, এর সঙ্গে দেখা দেয় দৃষ্টিশক্তির সমস্যা। চলাফেরায় সমস্যা তৈরি হয়। মাংসপেশিতে কোনো কারণ ছাড়াই টান পড়তে থাকে। এরপর অনেক রোগীকেই হয় হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে হয়, নয়তো চলাফেরার জন্য অন্য কারো সাহায্যের দরকার হয়।

ডা. মারেরো বলেন, এটা খুবই গুরুতর এক সমস্যা। যেমন ধরুন একজন রোগী তার স্ত্রীকে বললেন, আমি দুঃখিত, আপনি আমার সঙ্গে একই বিছানায় শুতে পারেন না, কারণ আমি বিবাহিত। স্ত্রী যদি তখন তার নাম-পরিচয় দেন, তখনো রোগী বলতে থাকে, আপনি আসল লোক নন, নকল।

এই রোগটির ব্যাপারে গবেষণায় এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডা. মারেরো। তাকে সাহায্য করছেন একদল গবেষক এবং ফেডারেল সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ।

যাদের এই রোগ হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়, তাদের ওপর প্রিয়ন রোগের পরীক্ষা চালানো হয় তাদের জেনেটিক অবস্থা জানার জন্য। তাদের দেহের স্বয়ংক্রিয়-রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় কোনো সমস্যা আছে কিনা বা কোনো ক্যান্সার আছে কিনা, সেটা দেখা হয়। এছাড়া নানা রকম ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস, হেভি মেটাল বা কোনো ধরনের অস্বাভাবিক অ্যান্টিবডি আছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা হয়।

রোগীরা কোন ধরনের পরিবেশে বসবাস করেছেন, কী ধরনের জীবনযাপন করেছেন, কোথায় কোথায় ভ্রমণ করেছেন, তাদের মেডিক্যাল হিস্ট্রি, পানির উৎস- সবকিছু সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। এখনো পর্যন্ত এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। যেসব লক্ষণের কারণে রোগীদের যন্ত্রণা হয়, কেবল সেটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়।

এখনো পর্যন্ত এই রোগটি জেনেটিক নয় বলেই ধরা হচ্ছে। চিকিৎসকরা ধরে নিচ্ছেন, এটি রোগীরা কোনো না-কোনোভাবে পেয়েছেন। ডা. মারেরো বলেন, এখনো পর্যন্ত আমরা ধরে নিচ্ছি রোগীর শরীররে এমন বিষাক্ত কিছু ঢুকেছে, যা হয়তো মস্তিকে এই বিনাশী পরিবর্তনের সূচনা করছে।

রোগটির রহস্য উদঘাটনে আরো যারা গবেষণা চালাচ্ছেন তাদের একজন হচ্ছেন ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার নিউরোলজিস্ট ড. নীল ক্যাশম্যান। তিনি বলছেন, রোগীদের মধ্যে যদিও প্রিয়ন রোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না, তারপরও এটিকে এখনো তারা একটি কারণ হিসেবে একেবারে বাদ দিচ্ছেন না।


   আরও সংবাদ