ঢাকা, বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

এইচআইভি ও এইডস : কখন, কবে, কীভাবে?

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ৮ ডিসেম্বর, ২০২১ ০৯:৫২ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫২৬ বার


এইচআইভি ও এইডস : কখন, কবে, কীভাবে?

বিশ্ব এইডস দিবস আজ। ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছর পহেলা ডিসেম্বর পালন করা হচ্ছে দিবসটি। 

উদ্দেশ্য এইচআইভি সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট এইডস সম্পর্কে গোটা বিশ্বে জনসচেতনতা সৃষ্টি। প্রতিবারের মতো এবারও স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাংলাদেশ দিবসটি পালন করার উদ্যোগ নিয়েছে।

হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (এইচআইভি) সর্বপ্রথম শনাক্ত করা হয় ৮০’র দশকে। এরপর থেকেই এই রোগটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে। কীভাবে, কখন ও কোথায় এইচআইভি প্রথম মানুষের মধ্যে সংক্রমণ শুরু করেছে সে সম্পর্কে এখন প্রচুর প্রমাণ রয়েছে। এইডস রোগের সূচনা ঘটে মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার প্রাইমেটদের মধ্যে।

এইচআইভি ভাইরাস সংক্রমণের কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। সর্বপ্রথম এইডস শনাক্ত করা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলসে ১৯৮১ সালে। এশিয়ার মধ্যে প্রথম এইডস লক্ষ করা যায় ১৯৮৪ সালে থাইল্যান্ডে এবং ভারতীয় উপমহাদেশ ও মায়ানমারে ১৯৮৬ সালের মধ্যেই এর সংক্রমণ ঘটে।

এইচআইভি এবং এসআইভির মধ্যে সংযোগ

এইচআইভি একধরনের লেন্টিভাইরাস যেটা মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় আক্রমণ করে। তেমনি সিমিয়ান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস শিম্পাজি বা বানরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় আক্রমণ করে। গবেষণায় এই দুটি ভাইরাসের মধ্যে অনেক মিল পাওয়া গেছে। শিম্পাঞ্জির শরীর থেকে পাওয়া এসআইভি-এর ধরনের সঙ্গে এইচআইভি-১ এর মিল পাওয়া গেছে এবং সুটি মাঙ্গাবি বানরের শরীর থেকে পাওয়া এসআইভি-এর ধরনের সঙ্গে মিল পাওয়া গেছে এইচআইভি-২ এর।

এইচআইভি কি বানর থেকে এসেছে?

গবেষকরা ১৯৯৯ সালে শিম্পাঞ্জির শরীরে পাওয়া এসআইভির সঙ্গে মানুষের শরীরে পাওয়া এইচআইভির মধ্যে একটি মিল খুঁজে পান যা প্রায় অভিন্ন এবং তারা এটি প্রমাণেও সফল হয়েছে যে এইচআইভি-১ এর উৎস ছিল শিম্পাঞ্জি। কোনো এক সময় এই ভাইরাসটি শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। বিজ্ঞানীরা আরও গবেষণা চালান যে কীভাবে শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে এসআইভি বিকশিত হয়েছে। তারা আবিষ্কার করে শিম্পাঞ্জিরা দুটি ছোট ছোট প্রজাতির বানর শিকার করে খেত। এই ছোট প্রজাতির বানরগুলো থেকেই শিম্পাঞ্জিরা এসআইভি-এর ভিন্ন দুটি ধরণ দিয়ে সংক্রমিত হয়েছিল। এই দুটি ভিন্ন ধরন একসাথে মিলে তৃতীয় একটি ভাইরাস গঠন করে যার নাম এসআইভিসিপিজেড যা শিম্পাঞ্জিদের সংক্রমিত করেছিল। পরবর্তীতে এই ধরনটিই মানুষকে সংক্রমিত করে।

কীভাবে এইচআইভি শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষের মধ্যে এসেছে
এক্ষেত্রে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ধারণা হলো মানুষ যখন শিম্পাঞ্জি বা বানর শিকার করে এর মাংস খেত তখন কোনো এক সময় অথবা শিকারকৃত প্রাণীর রক্ত যখন শিকারিদের ক্ষতস্থানের সংস্পর্শে আসে তখন মানুষ এই ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়ে থাকে। সাধারণত শিকারির শরীর এসআইভির সঙ্গে লড়াই করে, কিন্তু ভাইরাসটি তার নতুন মানব ধারকের মধ্যে কয়েকবার পরিবর্তনের মাধ্যমে মানিয়ে নিয়ে এইচআইভি-১ এ পরিণত হয়।

এইচআইভির ধরণ প্রধানত চারটি ( M, N, O, P) এর প্রতিটি জীনগতভাবে সামান্য ভিন্ন ধরনের। এটা শিকারতত্ত্বকে সমর্থন করে কারণ প্রত্যেকবার এসআইভি শিম্পাঞ্জি থেকেই মানব শরীরে প্রবেশ করেছে যা একটু ভিন্নভাবে মানব শরীরে বিকশিত হয়ে সামান্য ভিন্ন একটি ধরন তৈরি করে। এ থেকেই বুঝা যায় এইচআইভি-১ ছাড়াও কেন একাধিক ধরন রয়েছে। তবে এইচআইভি-১ হলো পুরো বিশ্বে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার জন্য বেশি দায়ী।

কীভাবে এইচআইভি-২ মানুষের মধ্যে এসেছে

সুটি মাঙ্গাবি বানর থেকে এসআইভিএসএমএম মানুষের শরীরে এসে এইচআইভি-২ তে রূপান্তরিত হয়। বানরের মাংস বিক্রয় ও খাওয়ার মাধ্যমে মানুষের শরীরে এই সংক্রমণ হয় বলে ধারণা করা হয়। এটা খুব দুর্লভ এবং এইচআইভি-১ থেকে কম সংক্রামক। যার কারণে খুব কম মানুষ আক্রান্ত হয়। পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশ যেমন মালি, মউরিতানিয়া, নাইজেরিয়া ও সিয়েরা লিওনে এর সংক্রমণ দেখা যায়।

কখন ও কোথায় মানুষের মধ্যে এইচআইভির উপস্থিতি দেখা যায়
গবেষণায় প্রথম দিকের কতগুলো নমুনায় এইচআইভি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় কখন এটি প্রথম মানুষের শরীরে এর অস্তিত্ব জানান দেয় এবং কীভাবে এটি বিবর্তনের মাধ্যমে শক্তিশালী হয়ে উঠে। ১৯৫৯ সালে কঙ্গোর রাজধানী কিনসাসা নিবাসী একজন ব্যক্তির রক্ত পরীক্ষার নমুনা থেকে প্রথম এইচআইভি এর উপস্থিতি জানা যায়। পরবর্তীতে এই নমুনাকে ভালভাবে বিশ্লেষণ করে এইচআইভি শনাক্ত করা হয়।

এইচআইভি কি আফ্রিকায় শুরু হয়েছিল?
বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখে এসআইভি থেকে এইচআইভি এর প্রথম সংক্রমণ ঘটে ১৯২০ সালে কঙ্গোর রাজধানী কিনসাসায়। বিশ্বে সর্বাধিক এইচআইভি জীনগত বৈচিত্র্যের ধারা এই অঞ্চলেই দেখা যায়। এখানেই প্রথম এইডসের সূত্রপাতও হয়।

কীভাবে এইচআইভি কিনসাসা থেকে ছড়িয়ে পড়ে
কিনসাসার আশেপাশের অঞ্চলে সড়ক, রেলপথ ও জলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিল। এইডস যখন ছড়িয়ে পড়ছিল তখন এই অঞ্চলে যৌন ব্যবসাও বেড়ে গিয়েছিল। অভিবাসীদের সংখ্যা বেশি থাকায় এবং পতিতাবৃত্তির ফলে এখানে এইডস আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছিল। ১৯৩৭ সালের মধ্যে, এটি কিনসাসার প্রায় ১২০ কিলোমিটার পশ্চিমে ব্রাজাভিলে পৌঁছেছিল। দেশের উত্তর এবং পূর্ব দিকে যোগাযোগ ব্যবস্থা কম থাকায় সেই সময়ে সেখানে সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল। ১৯৮০ সাল নাগাদ কঙ্গোতে সংক্রমণের প্রায় অর্ধেক ছিল কিনসাসাতে, যা বিশ্বকে মহামারির আভাস দিচ্ছিল।

হাইতি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
হাইতিতে ১৯৬০ সালে এইচআইভি ধরা পড়ে। অনেক হাইতিয়ান পেশাদার যারা ১৯৬০ এর দশকে কঙ্গোতে কাজ করছিলেন তারা হাইতিতে ফিরে আসেন। এই কারণে তাদের এইচআইভি মহামারীর জন্য দায়ী করা হয়েছিল। যার ফলে তারা বর্ণবাদ, অপবাদ ও বৈষম্যের শিকার হয়েছিল। আন্তর্জাতিকভাবে এইচআইভি-১ এর উপপ্রধান ধারা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ৭৫ মিলিয়ন মানুষ ২০১৪ সাল নাগাদ এই উপপ্রধান ধারাটি দিয়ে সংক্রমিত হয়েছিল।

৮০’র দশকে আমেরিকায় যা ঘটেছিল
এটা বলা হয় যে ১৯৮০ এর দশকে আমেরিকায় প্রথম এইচআইভি শুরু হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এইচআইভি সম্পর্কে মানুষ তখন জানতে ও সচেতন হতে শুরু করে এবং ভেবে নেয় এটি একটি সাধারণ শারীরিক অবস্থা।

১৯৮১ সালে নিউ ইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়াতে সমকামী পুরুষদের মধ্যে কাপোসিস সারকোমা (এক ধরনের বিরল ক্যানসার) ও পিসিপি নামক ফুসফুসের সংক্রমণের মতো বিরল রোগের প্রমাণ মেলে। পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা ১৯৮২ সালের মাঝামাঝিতে বুঝতে পেরেছিলেন যে এই রোগটি অন্যান্য মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। পতিতাবৃত্তি, একই সুচের ব্যবহার ও হেরোইন সেবনকারীদের মধ্যে এ রোগের বিস্তার দেখা যায়। একই বছরের সেপ্টেম্বরে এই রোগের নামকরণ হয় এইডস হিসেবে।

ফোর-H ক্লাব কী?
আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করেন। এরা হলো এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গীরা, একই সুচ দিয়ে মাদক ব্যবহারকারীরা (যাদের রক্তের হিমোফিলিয়াকস রোগ আছে) এবং যারা সম্প্রতি হাইতি থেকে ফিরে এসেছিল। আমেরিকায় যে সময় এইডসের আবির্ভাব শুরু হয় তখন এই রোগ সম্পর্কে তথ্যের অভাবে মানুষ মহামারীর আশঙ্কায় ভীত হয়ে পড়ে। তখন ফোর-H ক্লাবের কথা জানা যায়। যেটা সমকামী (হোমো সেক্সুয়াল), হেমোফিলিয়াকস, হেরোইন আসক্তদের ও হাইতিয়ানদের এই রোগ বিস্তারের জন্য দায়ী করে থাকে।

২০২০ সালের শেষের সমীক্ষা অনুযায়ী পৃথিবীর প্রায় ৩৭.৭০ মিলিয়ন মানুষ এইচআইভিকে সঙ্গী করে বেঁচে আছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, কেবল ২০২০ সালে এই রোগটিতে মৃত্যুবরণ করেন ৬ লাখ ৮০ হাজার মানুষ এবং এই এক বছরে নতুন করে এইচআইভিতে আক্রান্ত হন পৃথিবীর ১.৫ মিলিয়ন মানুষ।


   আরও সংবাদ