ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর, ২০২১ ১১:০৩ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫০৯ বার
চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এ পর্যন্ত এক হাজার ৫৭০ জন জনপ্রতিনিধি ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, তৃণমূলের এ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি প্রার্থীর অংশগ্রহণের কথা।
অথচ একক প্রার্থী হিসাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিপুলসংখ্যক জনপ্রতিনিধি জয়ী হচ্ছেন, যা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার জন্য অশনিসংকেত। এ থেকে উত্তরণে সরকার, রাজনীতিক ও নির্বাচন কমিশনকে এখনই ভাবতে হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক রাখার বিষয়টিও বিবেচনা করার সময় এসেছে।
মঙ্গলবার সঙ্গে আলাপকালে তারা এসব অভিমত ব্যক্ত করেন।
বিশেষজ্ঞদের আরও অভিমত-দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ভোট হওয়া, বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল অংশ না নেওয়া, আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর বাইরে বিদ্রোহী না হওয়ার জন্য দলীয় ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি, মাঠপর্যায়ে হুমকি-ধমকি ও প্রভাব বিস্তারের কারণে অন্যদের মাঠ ছাড়তে বাধ্য করায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ীদের সংখ্যা বেড়েছে। তারা বলেছেন, নির্বাচনে এমন ফলাফল ভালো নয়। এটি ভাবনার বিষয়।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, পাঁচ ধাপে তিন হাজার ৭৪৪টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৩৫১ জন চেয়ারম্যান, ৮৫৮ সাধারণ সদস্য ও ৩৬১ জন সংরক্ষিত সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। সবমিলিয়ে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মোট এক হাজার ৫৭০ জন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী জনপ্রতিনিধির এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। ষষ্ঠ ধাপের ২১৯ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ১৩ জানুয়ারি প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় নির্ধারিত রয়েছে। ওই সময়ের পর এবারের নির্বাচনে কতজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হলেন তা স্পষ্ট হবে। এর আগে ২০১৬ সালে ছয় ধাপে চার হাজার ১০৪টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট হয়েছিল। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বড় রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নেয়। ওই সময়ে চার হাজার ১০৪টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে মাত্র ২০৭টি ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পান। এবার তিন হাজার ৭৪৪টির মধ্যেই চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছেন ৩৫১ জন। তাদের মধ্যে ৩৫০ জনই আওয়ামী লীগের ও একজন একই দলের বিদ্রোহী প্রার্থী।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী জয়ে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ছাড়াও নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
মঙ্গলবার চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়াকে উৎসাহিত করা সমীচীন নয়। তিনি বলেন, নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিবর্তন করলে এ অবস্থা থেকে আমরা উদ্ধার পেতে পারি কিনা-তা আগামী কমিশন অবশ্যই ভেবে দেখবে।
দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হওয়ায়সহ কয়েকটি কারণে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ীদের সংখ্যা বেড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন। তিনি বলেন, কয়েকটি কারণে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ীদের সংখ্যা বাড়ছে। তার অন্যতম হচ্ছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক থাকা। নির্দলীয় প্রতীকে এ নির্বাচন হওয়া উচিত তা প্রমাণিত হচ্ছে। তিনি বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে অনেক ব্যক্তি আছেন, যারা সাধারণ মানুষকে সেবা দেন, তাদের পাশে থাকেন। মানুষও ওইসব ব্যক্তিদের বিশ্বাস করেন, ভালোবাসেন। কিন্তু ওইসব ব্যক্তি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। তারা সমাজসেবী।
দলীয় প্রতীকে ভোট হওয়ায় ওইসব মানুষ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন না। আরেকটি কারণ হচ্ছে, এ নির্বাচনে সরকারি দল থেকে বারবার বলা হচ্ছে, নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বহিষ্কার বা অন্য সাজামূলক ব্যবস্থা এড়াতেও অনেকেই প্রার্থী হচ্ছেন না। এছাড়া নির্বাচনের ব্যয় একটি ফ্যাক্টর। অনেকে মনে করেন নির্বাচনে প্রার্থী হলে মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করতে হবে।
কিন্তু দলীয় নেতাকর্মীরা প্রতীক পাওয়া প্রার্থীর পক্ষেই কাজ করবেন বা করতে বাধ্য হবেন। মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করেও তখন ভালো ফল পাওয়া যাবে না। আরেকটি কারণ হচ্ছে, বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এতে প্রার্থীও কমেছে। সাবেক এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচনমুখী। তারা নির্বাচনকে একটি উৎসব মনে করেন। এ দেশেই প্রার্থীর অভাবে অনেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে যাচ্ছেন। এটা নির্বাচনি প্রক্রিয়ার জন্য ভালো লক্ষণ নয়। এ বিষয়টি গভীরভাবে ভাবতে হবে।
জানা গেছে, সর্বশেষ রোববার পঞ্চম ধাপে ৫২ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী ভোট ছাড়া বিজয়ী হয়েছেন। এর আগে চতুর্থ ধাপে ৪৮ জন, তৃতীয় ধাপে ১০০, দ্বিতীয় ধাপে ৮০ ও প্রথম ধাপে ৭১ চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা ভোটে বিজয়ী হন।
ধাপ অনুযায়ী, সর্বশেষ পঞ্চম ধাপে ৫২ জন চেয়ারম্যান, ৩২ জন সংরক্ষিত সদস্য ও ১০৯ জন সাধারণ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। এ ধাপে ৫ জানুয়ারি ভোট হবে।
চতুর্থ ধাপে ৮৪২ ইউপিতে ২৬ ডিসেম্বর ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এ ধাপে ভোটের আগেই ৪৮ চেয়ারম্যান, ১৩৫ সাধারণ সদস্য ও ১১২ সংরক্ষিত সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত তৃতীয় ধাপের ফল ঘোষিত ৯৯২টি ইউপির মধ্যে ১০০ জন চেয়ারম্যান ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাধারণ সদস্য নির্বাচিত হন ৩৩৭ জন এবং সংরক্ষিত সদস্য নির্বাচিত হন ১৩২ জন। এ ধাপে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী ১০০ জনের মধ্যে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের ৮৩৪টি ইউপির মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৮০ জন, সংরক্ষিত নারী সাধারণ সদস্য পদে ৭৩ এবং সাধারণ সদস্য পদে ২০৩ জন বিনা ভোটে জয়ী হন। ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর দুদফায় প্রথম ধাপে ৩৬২টি ইউপির মধ্যে ৭১ চেয়ারম্যান, ৭৪ সাধারণ সদস্য ও ১২ জন সংরক্ষিত সদস্য বিনা ভোটে নির্বাচিত হন।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিপুলসংখ্যক জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার এই ঘটনা শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীতে খারাপ নির্বাচনের ইতিহাস রচনা হচ্ছে বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, রাউজান ও লাকসাম উপজেলার সবকটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সংরক্ষিত সদস্য ও সাধারণ সদস্য-সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এমন ঘটনা পৃথিবীর কোথাও আছে? এমনকি ভারতেও কি এমন ইতিহাস আছে? কোথাও নেই। আমাদের দেশে সেই ইতিহাস রচিত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সেই যে ধারা তৈরি হয়েছে তা তৃণমূলে ছড়াচ্ছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক দল, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের কারও মাথাব্যথা নেই। নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় এসব প্রার্থী জয়ী হয়েছেন-সেই যুক্তি দিচ্ছেন সবাই। কিন্তু কেন নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হচ্ছে না তা নিয়ে কেউ কথা বলছেন না। মূলত নির্বাচন প্রক্রিয়ার কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। এখন যেভাবে নির্বাচন হচ্ছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটাকে কোনো নির্বাচন বলা যাবে না। এ নির্বাচন তৃণমূল পর্যায়ে উৎসব নয়, আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনের নামে যা হচ্ছে তা নির্বাচনি প্রক্রিয়ার জন্য অশনিসংকেত। তার মতে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে কারসাজি এবং টাকা ও ক্ষমতার প্রভাবের কারণে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ীর সংখ্যা বেশি হয়েছে। তিনি বলেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হতে অনেক প্রার্থী বিনিয়োগ করেছেন। তারা দলীয় মনোনয়ন পাওয়া, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের টাকা ও ক্ষমতার প্রভাবে মাঠছাড়া করাসহ এমন কোনো পদক্ষেপ নেই, যা করেননি।