ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ ১১:২৫ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫২৮ বার
এবারের মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থীরা ২০২০ সালে দশম শ্রেণিতে ওঠার পর থেকেই আর ভালোভাবে ক্লাস করতে পারেনি। ওই বছরের মার্চে কভিড মহামারি দেখা দেয়, পরে এর জেরে বিপর্যস্ত হয় শিক্ষা ব্যবস্থা। ফলে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরুর কথা থাকলেও তা হয়নি। এ পরিস্থিতিতে সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করে ফেলা হয়।
৫৪৪ দিনের দীর্ঘ ছুটি কাটিয়ে গত ১২ সেপ্টেম্বর ফের শুরু হয় ক্লাস। কিছু দিন ক্লাস করেই ছাত্রছাত্রীরা গত নভেম্বরে বসে পরীক্ষায়। সব বিষয়ে নয়, শুধু তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়। বাকি বিষয়গুলোতে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় তাদের প্রাপ্ত নম্বরের সাবজেক্ট ম্যাপিং করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার এই পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা দিয়ে এবার বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছে শিক্ষার্থীরা।
এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় সারাদেশের ৯৩ দশমিক ৫৮ ভাগ ছাত্রছাত্রী পাস করেছে। গতবার তা ছিল ৮২.৮৭ শতাংশ। ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৭ লাখ ৯২ হাজার ৩১২ জন। এর মধ্যে পাস করেছে ১৬ লাখ ৮৬ হাজার ২১১ জন। সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোতে এসএসসি পাসের হার ৯৪ দশমিক শূন্য ৮।
মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের দাখিল পরীক্ষায় দুই লাখ ৯২ হাজার ৫৬৯ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে দুই লাখ ৭২ হাজার ৭২২ জন। পাসের হার ৯৩ দশমিক ২২ শতাংশ। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি (ভোকেশনাল) পরীক্ষায় এক লাখ ৫৫ হাজার ৫১৪ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে এক লাখ ৩৭ হাজার ৬১৩ জন। পাসের হার ৮৮ দশমিক ৪৯। ১১টি শিক্ষা বোর্ড মিলে এ বছর সারাদেশে জিপিএ ৫ পেয়েছে এক লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ পরীক্ষার্থী।
গতকাল সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি প্রেস ব্রিফিংয়ে ফলাফলের বিস্তারিত তুলে ধরেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব আমিনুল ইসলাম খান এ সময় উপস্থিত ছিলেন। ১১টি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানরাও সেখানে ছিলেন।
ফল প্রকাশের পরপরই সারাদেশের স্কুল ও মাদ্রাসায় আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। পরীক্ষার্থীরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে উল্লাস-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। অভিভাবক ও শিক্ষকরাও ছিলেন উল্লসিত।
সূচক কেন ঊর্ধ্বমুখী :পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের সকল সূচকই ঊর্ধ্বমুখী। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা, সর্বোচ্চ ফল প্রাপ্তির সংখ্যা, পাসের হার, শতভাগ পাসের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা- সবই বেড়েছে। গতবার সারাদেশের ১০৪ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করেনি। এবার এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমে মাত্র ১৮টিতে নেমে এসেছে। কেউ পাস করেনি, এমন কোনো স্কুল সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোতে এবার নেই।
নজরকাড়া সাফল্য পেয়েছে মেয়েরা। পাসের হারে ছেলেদের পেছনে ফেলেছে মেয়েরা, জিপিএ ৫ পাওয়ার দৌড়েও তারাই এগিয়ে। এ বছর ৯৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ছাত্রী মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় পাস করেছে, যেখানে ছাত্রদের পাসের হার ৯২ দশমিক ৬৯ শতাংশ। পূর্ণাঙ্গ জিপিএ, অর্থাৎ পাঁচে পাঁচ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীরা এগিয়ে রয়েছে বড় ব্যবধানে। জিপিএ ৫ পাওয়া এক লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৭৯ হাজার ৭৬২ জন ছাত্র; আর এক লাখ তিন হাজার ৫৭৮ জন ছাত্রী। সেই হিসাবে ২৩ হাজার ৮১৬ জন বেশি ছাত্রী জিপিএ ৫ পেয়েছে।
১১টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে পাসের হারে সবচেয়ে এগিয়ে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ড। আর পিছিয়ে বরিশাল শিক্ষা বোর্ড। তবে জিপিএ ৫ প্রাপ্তিতে বরাবরের মতোই শীর্ষে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। সাফল্যের দিক থেকে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরাই আবারও সেরা। তবে এবার মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে উত্তীর্ণের হার বেড়েছে।
যে কারণে ভালো ফল :ফল বিশ্নেষণে দেখা গেছে, নৈর্ব্যক্তিক (এমসিকিউ) পরীক্ষায় বেশিরভাগ পরীক্ষার্থীই এবার শতভাগ নম্বর পেয়েছে। কারণ তাদের পছন্দের সুযোগ (অপশন অব চয়েস) বেড়ে গেছে। বিষয়টি তুলে ধরে সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রমা বিজয় সরকার সমকালকে বলেন, এমসিকিউতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের ২৫টির মধ্যে মাত্র ১২টির উত্তর দিতে হয়েছে। মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের এটা ছিল ৩০টির মধ্যে ১৫টি। এতে একটি না পারলে পরবর্তী প্রশ্নে সে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। অন্যান্যবার ৩০টির মধ্যে ৩০টিরই উত্তর দিতে হতো। আবার লিখিত সৃজনশীল পরীক্ষায় বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের ১১টি প্রশ্নের মধ্যে মাত্র দুটির উত্তর দিতে হয়েছে। আর মানবিক ও বাণিজ্যে ১১টির মধ্যে উত্তর দিতে হয়েছে তিনটির।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, সিলেবাস সংক্ষিপ্ত ছিল, মাত্র তিনটি বিষয়ে পরীক্ষা হওয়ায় শিক্ষার্থীদের সাফল্য বেশি এসেছে। আবার পরীক্ষার্থীর সংখ্যা গতবারের চেয়ে দুই লাখ বেড়ে যাওয়ায় জিপিএ ৫ও বেড়েছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের সুফল পেয়েছে পরীক্ষার্থীরা। বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের মতো বিষয়ে অষ্টম শ্রেণির জেএসসির একই বিষয়ের ফল ম্যাপিং করা হয়েছে। যেমন চতুর্থ বিষয় হিসেবে কারও জীববিজ্ঞান থাকলে অষ্টম শ্রেণির বিজ্ঞানের নম্বর ম্যাপিং করা হয়েছে।
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. মো. আসাদুজ্জামান সমকালকে বলেন, সাধারণত শিক্ষার্থীরা বেশি ফেল করে ইংরেজিতে, গণিতে। মানবিকের শিক্ষার্থীরা গণিতেই বেশি ফেল করে। এ বছর এসব বিষয়ে পরীক্ষা না হওয়ায় পাসের হারে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
তবে ৬ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ফেল করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, শিক্ষার্থীরা গত দেড় বছর প্রচ মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে গেছে। কেউ কেউ ভীষণ ট্রমার মধ্যে ছিল। কেউ কেউ আত্মীয়স্বজনদের হারিয়ে দিশেহারা ছিল। এটাও একটা কারণ।
আগামী বছরের পরীক্ষা কেমন হবে :ব্রিফিংয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আগামী বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা সব বিষয়ে হবে, নাকি এবারের মতো গ্রুপভিত্তিক নৈর্বাচনিক বিষয়ে হবে, তা নির্ভর করছে করোনা পরিস্থিতির ওপর। সম্ভব হলে সব বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়া হবে। একেবারেই সম্ভব না হলে নৈর্বাচনিক বিষয়ে পরীক্ষা হবে।
ফল পুনর্নিরীক্ষার আবেদন ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত :পরীক্ষায় যারা কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি, তারা আজ ৩১ ডিসেসম্বর থেকে ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ফল পুনর্নিরীক্ষার আবেদন করতে পারবে। আবেদন করতে টেলিটকের প্রিপেইড মোবাইল ফোন থেকে মেসেজ অপশনে গিয়ে জঝঈ লিখে স্পেস দিয়ে বোর্ডের নামের প্রথম তিন অক্ষর লিখে স্পেস দিয়ে রোল নম্বর লিখে স্পেস দিয়ে বিষয় কোড লিখে ১৬২২২ নম্বরে পাঠাতে হবে। ফিরতি এসএমএসে আবেদন বাবদ কত টাকা কেটে নেওয়া হবে তা জানিয়ে পিন নম্বর দেওয়া হবে। পরে জঝঈ লিখে স্পেস দিয়ে ণঊঝ লিখে স্পেস দিয়ে পিন নম্বর লিখে স্পেস দিয়ে যোগাযোগের জন্য একটি মোবাইল নম্বর লিখে ১৬২২২ নম্বরে এসএমএস পাঠাতে হবে।
পুনর্নিরীক্ষার ক্ষেত্রে একই এসএমএসের মাধ্যমে একাধিক বিষয়ের (যেসব বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছে) জন্য আবেদন করা যাবে। সেক্ষেত্রে 'কমা' দিয়ে বিষয় কোডগুলো পর্যায়ক্রমে লিখতে হবে। প্রতি বিষয়ের জন্য ১২৫ টাকা করে ফি দিতে হবে।
সূত্র : ইত্তেফাক