ঢাকা, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

চাকরির শেষ বয়সেও জ্যেষ্ঠতার স্বীকৃতি পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন সলিমুল্লাহ কলেজের নাছরীন

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর, ২০২৪ ১০:৫৩ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫৭ বার


চাকরির শেষ বয়সেও জ্যেষ্ঠতার স্বীকৃতি পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন সলিমুল্লাহ কলেজের নাছরীন

রাজধানীর টিপু সুলতান রোডে অবস্থিত সলিমুল্লাহ কলেজের অর্থনীতি বিভাগে ১৯৯৪ সালে যোগদান করেন অধ্যাপক কানিজ নাছরীন। তবে চাকরির শেষ বয়সেও জ্যেষ্ঠতার স্বীকৃতি পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন এই শিক্ষিকা। নিয়োগের পরেই অজানা কারণে ১৯৯৬ সালে জ্যেষ্ঠতা হারানোর খবর পান তিনি। বিভিন্ন সময়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের গঠিত একাধিক তদন্ত কমিটি জ্যেষ্ঠতা ফিরিয়ে দেয়ার সুপারিশ করলেও তা আর ফিরে পাননি তিনি। সম্প্রতি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রেও হয়েছেন বঞ্চিত।

জানা যায়, সর্বশেষ গত ১৮ জুলাই সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাকালীন আওয়ামীলীগের প্রভাব দেখিয়ে নতুন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় কলেজটির আরেক শিক্ষক বিভাষ চন্দ্র সাহাকে। বিভাষ চন্দ্র সাহাকে নিয়োগ দিতে গভর্নিং বডির মিটিংয়ে সাবেক অধ্যক্ষ শিরিণ আখতারকে বল প্রয়োগের অভিযোগ উঠে সভাপতিসহ কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে। যদিও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পাওয়ার কথা ছিল কানিজ নাছরীনের।

অধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রে চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ থেকে একটি পরিপত্র জারি করা হয়। পরিপত্রটির ‘ক’ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘স্নাতক (পাস) কলেজে সহকারী প্রধান শিক্ষক বা উপাধ্যক্ষ ব্যতীত অন্য কোন শিক্ষককে প্রধান শিক্ষক অধ্যক্ষের দায়িত্বভার অর্পণ করা যাবে না। তবে সহকারী প্রধান শিক্ষক বা উপাধ্যক্ষের পদ শূন্য থাকলে কর্মরত শিক্ষকদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠতম সহকারী শিক্ষক বা জ্যেষ্ঠতম সহকারী অধ্যাপককে প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদান করতে হবে।’ 

তবে কলেজের একটি সূত্র জানায়, কলেজটির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বিভাষ চন্দ্র সাহা উপধ্যক্ষ পদে আবেদন করেছেন। যদিও এই শিক্ষকের কাগজপত্রে ত্রুটি থাকায় উপাধ্যক্ষ পদে তার নিয়োগের সম্ভাবনা কমে যায়। এছাড়া সম্প্রতি কলেজের হিসাবরক্ষকসহ বেশকিছু পদে নিয়োগের সার্কুলার হয়েছে, সাবেক অধ্যক্ষ শিরিণ আখতার পদটিতে থাকায় পদগুলোতে অনিয়মের সুযোগ ছিল না। তাই গত ১৮ জুলাই জোরপূর্বক শিরিণ আখতারের সম্মতি নিয়ে বিভাষ চন্দ্র সাহাকে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ করা হয়। এতে সহায়তা করেন গভর্নিং বডির তৎকালীন সভাপতি আব্দুল্লাহ মন্নাফী (মার্শাল) যিনি ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফীর দ্বিতীয় পুত্র। তবে ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিবেদন ও কানিজ নাছরীনের আবেদন যাচাই করে দেখা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালযয়ের এই পরিপত্র অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হওয়ার কথা কানিজ নাছরীনের। এই শিক্ষিকা ১৯৯৪ সালে সলিমুল্লাহ কলেজে যোগদান করেন এবং ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে তার এমপিও শুরু হয়। অপরদিকে প্রায় ৩ মাস পরে বর্তমান অধ্যক্ষ বিভাষ চন্দ্র সাহার এমপিও শুরু হয়। একইসাথে নিয়োগ পান আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষক। কানিজ নাছরীন জ্যেষ্ঠতা হারানোর খবর পান ১৯৯৬ সালে। পরে এবিষয়ে ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলে জ্যেষ্ঠতা ফিরেও পান।

ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৫ সালে বিষয়গুলো নিয়ে পুনরায় বিতর্ক সৃষ্টি হলে কলেজ কর্তৃপক্ষ আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করলে সেখানেও কানিজ নাছরীনকে বিভাষ চন্দ্র সাহার জ্যেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ২০০৯ সালেও একইরকম বিতর্ক সৃষ্টি হয় এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে গভর্নিং বডির একটি সভায় সর্বসম্মতিক্রমে কানিজ নাছরীনকে জ্যেষ্ঠতার স্বীকৃতি দেয়া হয়। একইসাথে বিষয়টি নিয়ে কোন বিতর্কের সুযোগ নেই বলেও সুপারিশ করা হয়।

সম্প্রতি কলেজের গভর্নিং বডিতে পরিবর্তন আসে। বর্তমান সভাপতি নিযুক্ত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ টি এম জাফরুল আজম। তিনি দ্যা ডিইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ‘এখানে কতগুলো সমস্যার বিষয়ে জেনেছি, তবে বিষয়গুলো আমার দায়িত্ব গ্রহণের আগের। এসব কলেজে অধ্যক্ষের পদটি স্থায়ী নয়। ৬ মাস পরে এটাতে অন্য কেউ আসবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বেশকিছু অনিয়মের কথাও শুনেছি, আমরা আপাতত সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। যতদূর জানি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী অধ্যক্ষের পদে জ্যেষ্ঠ ৫ জন শিক্ষকের যেকোনো একজনকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।’

তবে অধ্যাপক জাফরুল আজমের উল্লেখিত চিঠিটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ৬ জুলাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সলিমুল্লাহ কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি বরাবর প্রেরণ করা হয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘২০১৯ এর ধারা ৪(ক) এর ২(i) ও (ii) মোতাবেক অধ্যক্ষ পদ শূন্য হলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে উপাধ্যক্ষ বা জ্যেষ্ঠতম পাঁচ জন থেকে যেকোনো একজনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদান করে সেটা আগামী সাত কার্য দিবসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবহিত করার জন্য আপনাকে অনুরোধ করা বলা হয়।’

তবে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্র জারির পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ধরনের চিঠির প্রাধান্য থাকে না। তাছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চিঠিটি গত বছরের, আর শিক্ষা মন্ত্রণালযয়ের পরিপত্রটি চলতি বছরের শুরুতে। আর এ ধরনের কলেজগুলোর ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র প্রাধান্য পাবে। 

কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শিরিণ আখতারের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘কতিপয় শিক্ষক এবং সাবেক গভর্নিং বডির সদস্যরা সংঘবদ্ধ চক্র হয়ে কাজ করে। গত জুনের ২৪ তারিখে একটা মিটিং হয়, সেখানে কলেজের স্থায়ী অধ্যক্ষ নেয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়, তবে সভাপতি অধ্যক্ষের নাম প্রস্তাব করতে পারেননি। এর আগে এটা নিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন যায়, কলেজ কর্তৃপক্ষ যাছাই-বাছাই করে। মিটিংয়ে স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগের বিষয়ে কলেজের সভাপতির সাথে আমার কিছুটা মতপার্থক্য তৈরি হয়।’

শিরিণ আখতার আরও বলেন, ‘স্থায়ী অধ্যক্ষ না থাকায় প্রতি ৬ মাসের জন্য জ্যেষ্ঠতম শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদানের একটি পরিপত্র আছে। সেটা অনুযায়ী আমার অধ্যক্ষ পদের মেয়াদ শেষ হয় ১৮ জুলাই। কিন্তু ‍নতুন অধ্যক্ষ নিয়োগের কোন সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত না হওয়ায় সেদিন আমরা সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকি। সন্ধার পরে গভর্নিং বডির সভাপতি এসে অধ্যক্ষ পদে বিভাষ চন্দ্র সাহার নাম প্রস্তাব করেন। আমি সেখানে রাজি হইনি। কারণ কোনক্রমেই বিভাস চন্দ্র সাহা সিনিয়র নয়। পরবর্তীতে তারা আমাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য করেন। তবে সেই মিটিংয়ের রেজুলেশনে আমার স্বাক্ষর নেই। কারণ জ্যেষ্ঠতম শিক্ষক হলেন কানিজ নাসরীন।’

তবে অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য জানতে কলেজের অধ্যক্ষ বিভাষ চন্দ্র সাহার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এগুলো আমার কাছে প্রশ্ন করছেন কেন? আমি কি এগুলোর উত্তর দিতে পারব নাকি? অধ্যক্ষের বিষয়ে যখন মিটিং হয়েছে তখন আমি উপস্থিত ছিলাম না। এগুলোর বিষয়ে গভর্নিং বডি ভালো বলতে পারবে।’ তবে জ্যেষ্ঠতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সরাসরি সাক্ষাৎ ছাড়া কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

অধ্যাপক কনিজ নাছরীনের সাথে কথা হলে তিনি জানান, ‘ষড়যন্ত্রের মুখে আমার জ্যেষ্ঠতা কেড়ে নেয়া হয়। এটা একইসাথে সম্মানহনিকর এবং আমি আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছি। সর্বশেষ গত ১৮ জুলাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা অবস্থায় সন্ধ্যার পর জ্যেষ্ঠতম শিক্ষক শিরিন আখতারকে জোরপূর্বক বিভাষ চন্দ্র সাহা'র নিকট ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব হস্তান্তর করতে বাধ্য করা হয়।’

কনিজ নাছরীন আরও বলেন, ‘এ কাজের মূল হোতা ছিলেন কলেজটির গভর্নিং বডির তৎকালীন সভাপতি আব্দুল্লাহ মন্নাফী। যিনি ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফীর দ্বিতীয় পুত্র। আমি চাই আমার সিনিয়রিটির বিষয়টি স্বীকার করা হোক। বিভাষ চন্দ্র সাহা এবং বাকি যারা অবৈধ আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন তারা সেটা সরকারকে ফেরত দিক। সর্বক্ষেত্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠা হোক।’


   আরও সংবাদ