ঢাকা, শনিবার, ১৮ মে ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চ খেলাপি ঋণ ও জালিয়াতিতে অস্বস্তি

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ১০ জানুয়ারী, ২০২২ ০৯:৪৬ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৯৫৭ বার


নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চ খেলাপি ঋণ ও জালিয়াতিতে অস্বস্তি

দেশের নয়টি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের ঋণ জালিয়াতির কারণে সার্বিকভাবে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। জালিয়াতির অর্থ আদায় না হওয়ায় প্রায় সব প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের মোটা অঙ্কের অর্থ আটকে রয়েছে। এগুলোর বিপরীতে কোনো আয় হচ্ছে না। উলটো এগুলোর ব্যবস্থাপনা ও আইনি কাঠামোতে খরচ বাড়ছে। এসব মিলে চরম অস্বস্তিতে পড়েছে আর্থিক খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, ৩৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আর্থিক সংকটের কারণে ১১টিই আমানতকারীদের অর্থ সময়মতো ফেরত দিতে পারছে না। একদিকে আগের ঋণ আদায় করতে না পারা, অন্যদিকে নতুন আমানতের প্রবাহ কমে যাওয়ায় এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোয় তহবিল সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। একই সঙ্গে কমে গেছে বিনিয়োগ। গ্রাহকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অনাস্থা। কমে যাচ্ছে গ্রাহক। বিভিন্ন সূচকে নেতিবাচক অবস্থা দেখা দিয়েছে। এসব মিলে অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান কমে গেছে, যা নিয়ে শঙ্কিত নীতিনির্ধারকরা।

করোনার আগে ও পরে নানা ধরনের সুবিধা দিয়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণ অনুসন্ধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি গবেষণায় দেখা যায়, বেসরকারি খাতের ঋণের একটি অংশ আসত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। এ খাতের জোগান কমে যাওয়ায় সার্বিকভাবে ঋণ প্রবাহ বাড়ছে না।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক অবস্থা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোয় খেলাপি ঋণ বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত হারে। খেলাপির কারণে প্রভিশন খাতে আটকে গেছে বিপুল অঙ্কের অর্থ। ওইসব অর্থ থেকে কোনো আয় হচ্ছে না। বেড়ে গেছে নন-পারফর্মিং লোন বা অকার্যকর ঋণ। এতে একদিকে আয় কমেছে, অন্যদিকে বেড়েছে ব্যয়।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় নজিরবিহীন দুর্নীতির কারণে আমানতকারীদের অর্থ ঋণের নামে গায়েব করে দেওয়া ও গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে না পারায় গ্রাহকদের আস্থায় চিড় ধরেছে। এ কারণে গ্রাহকরা নতুন আমানত রাখা কমিয়ে দিয়েছেন। ঋণগ্রহীতারাও চাহিদামতো ঋণ বা লিজ না পেয়ে ব্যবসা গুটিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছেন। এতে এ খাতের ব্যবসা কমে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই অর্থনীতিতে অবদান কমছে।

প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, আর্থিত প্রতিষ্ঠানগুলোয় আমানত ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ছিল ৪৩ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা। ওই সময়ে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তা কমে হয়েছে ৪২ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। ওই সময়ে প্রবৃদ্ধি কমে হয়েছে শূন্য দশমিক ৪৪ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে আমানত কমেছে ৫৩১ কোটি টাকা। আমানতের প্রবৃদ্ধি কমেছে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ওই সময়ে সরকারি ও বেসরকারি সব খাতের আমানত কমেছে।

২০২০ সালে সেপ্টেম্বরে ঋণ বা লিজ বিতরণের স্থিতি ছিল ৫৫ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ওই সময়ে ঋণ প্রবাহে প্রবৃদ্ধি কমেছিল ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে ঋণ বা লিজ বেড়ে হয়েছে ৫৬ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ঋণ বাড়লেও প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৫৯ শতাংশ হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের প্রায় অর্ধেকই বিতরণ করে শিল্প ও ভোক্তা খাতে। এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের আয়ের একটি বড় অংশ আসে শেয়ারবাজার থেকে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ কমেছিল ৫ দশমিক ২১ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে কমেছে ২ দশমিক ৩১ শতাংশ। বিনিয়োগ কমায় আয় কমে গেছে।

প্রতিষ্ঠানগুলোয় গ্রাহকদের বিনিয়োগ হিসাবও কমেছে। গত মার্চে ঋণ হিসাব ছিল ১ লাখ ৯২ হাজারটি। গত সেপ্টেম্বরে তা কমে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৪০০তে দাঁড়িয়েছে। আলোচ্য সময়ে ঋণ হিসাব কমেছে দেড় শতাংশ।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালের জুন থেকে এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হচ্ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল শূন্য দশমিক ৪৩ শতাংশ। গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়েছে ১৫ দশমিক ০১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নেতিবাচক হয়েছে ১৫ দশমিক ০৪ শতাংশ। নতুন বিনিয়োগ কমা ও আগের বিনিয়োগ খেলাপি হওয়া এবং করোনার কারণে ঋণ আদায় স্থগিত থাকায় দুই বছর ধরে প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় বাড়েনি। বরং অনেক খাতে কমেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সার্বিক সূচকে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের হার মাত্রাতিরিক্ত বাড়ায় মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসাবে দেখা দিয়েছে।

এফএএস ফাইন্যান্সের পর্ষদের আদালত কর্তৃক নিয়োজিত চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, একবার দুর্নাম হয়ে গেলে গ্রাহকরা আর টাকা রাখতে চায় না। বেশকিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্নাম হয়ে গেছে। যে কারণে মানুষ টাকা রাখতে চাচ্ছে না। যদিও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই ভালো চলছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ৫ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণ বা লিজের ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। ঋণ জালিয়াতির অর্থ আদায় না হওয়ায় খেলাপি হতে শুরু করায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর খেলাপি ঋণ এক লাফে বেড়ে ১০ হাজার ২৫০ কোটি দাঁড়ায়, যা মোট ঋণের সাড়ে ১৫ শতাংশ। ডিসেম্বরে সামান্য কমে ১০ হাজার ৬ কোটি টাকা হয়। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাময়িক হিসাবে তা আরও বেড়ে ১০ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা হয়েছে, যা মোট ঋণের প্রায় ১৬ শতাংশ। পৌনে তিন বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণ।

ঋণ জালিয়াতি হওয়া সাত আর্থিক প্রতিষ্ঠানেই খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের ৩ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭৫ শতাংশ। এফএএস ফাইন্যান্সের ১ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্সের ৮০০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯৬ শতাংশ। প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ৬৬০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬২ শতাংশ। ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ৪৮০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫০ শতাংশ। ফার্স্ট ফাইন্যান্সের ২৮০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩২ শতাংশ। পিপলস লিজিংয়ের ৭৮৮ কোটি টাক, যা মোট ঋণের ৬৮ শতাংশ। অর্থাৎ ৭টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৮ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। বাকি ২৬টি প্রতিষ্ঠানের ১ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা খেলাপি। অর্থাৎ মোট খেলাপি ঋণের ৮২ শতাংশই রয়েছে ৭ প্রতিষ্ঠানে। বাকি ১৮ শতাংশ ২৬ প্রতিষ্ঠানে। এছাড়া রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের (পিএফআই) ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় তাদেরও খেলাপি ঋণ বেড়েছে।


   আরও সংবাদ