ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২ জানুয়ারী, ২০২২ ০৯:২৭ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫৭৯ বার
ভারতীয় রুপির সুপার নোট (অবিকল আসল, যা যন্ত্রেও ধরা পড়ে না) কারবারে জড়িত আন্তর্জাতিক চক্রের সন্ধান পেয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখা। চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশকে ব্যবহার করছে ট্রানজিট রুট হিসাবে। বিভিন্ন অঙ্কের নোটের চালান বাংলাদেশে এনে ভারতে পাচার করছে তারা।
পাকিস্তানের একটি কারখানায় ছাপানো এ নোট মোজাইক পাথরবাহী কনটেইনারে শ্রীলংকা হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে এনে খালাস করা হয়। এরপর সড়কপথে ঢাকায় এনে পৌঁছে দেওয়া হয় ডিস্টিবিউটরদের কাছে। তারাই নিজস্ব লোক দিয়ে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে নোটগুলো ভারতে পাচার করে। বাহকদের বেশিরভাগ ওই দুই জেলার সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা। কারবারে জড়িত চক্রের পাকিস্তানি গডফাদার, এ দেশীয় এজেন্ট, ডিস্টিবিউটরসহ অন্তত ১০ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে।
এদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান ডিস্টিবিউটরসহ চারজন গ্রেফতার হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে ভারতীয় রুপির সুপার নোট কারবারের চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার উপকমিশনার (গুলশান) মশিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশে কখনো ভারতীয় রুপির সুপার নোট বা জালনোট তৈরি হয়নি। এগুলো অন্য দেশ থেকে আসে। কারা কিভাবে এগুলো আনছে সে ব্যাপারে বিস্তারিত তদন্ত করে দেখছি। বাংলাদেশকে কেউ যাতে স্মাগলিংয়ের রুট হিসাবে ব্যবহার করতে না পারে সে লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বয়ে কাজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ধারাবাহিক অভিযানের ফলে পাচারকারীরা এখন স্থল ও আকাশপথ পরিহার করে সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। সুপার নোট পাচারের সঙ্গে তৃতীয় দেশের কারা কিভাবে জড়িত সে সংক্রান্ত তথ্য নিশ্চিত হতে আমরা ওই দেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করছি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, পাকিস্তানের করাচির একটি কারখানায় ছাপানো হচ্ছে ভারতীয় রুপির সুপার নোট। ওই কারখানা চালায় শফি ও তার ছেলে সুলতান। দীর্ঘদিন ধরে তারা এ কারবারে জড়িত। বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসাবে ব্যবহার করছে চক্রের সদস্যরা। মুন্সীগঞ্জের একটি ব্যবসায়ী পরিবার অবৈধ এ কারাবারে জড়িয়ে পড়েছে। এ পরিবারের সদস্য ফজলুর রহমান ওরফে ফরিদ পাকিস্তানে থাকেন। তিনিই মূলত সুলতানের কারখানা থেকে সুপার নোট সংগ্রহ করে বাংলাদেশে পাঠানোর শিপমেন্টসংক্রান্ত সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দেন। তবে করোনা মহামারির সময় তাদের কারবার বন্ধ ছিল। চক্রটি ফের মরিয়া হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি পাকিস্তান থেকে শ্রীলংকা হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা কনটেইনার ভর্তি সুপার নোটের একটি চালান আটক করা হয়েছে। এই চক্রের আরেক সদস্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ব্যবসায়ী আবু তালেব। তিনি পাকিস্তান থেকে শুঁটকি ও পাথর আমদানি করেন। পাথরের কনটেইনারের আড়ালে ৯৫টি বস্তাভর্তি করে আনা হয় ভারতীয় রুপির সুপার নোট। এই চালান আটকের পর গ্রেফতার করা হয় আবু তালেবকে।
আবু তালেব আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, ১৯৯৬ সালে প্রথম পাকিস্তান যান তিনি। সেখানে একটি ফার্মেসিতে কাজ করতেন। তাকে সবাই চিকিৎসক হিসাবে জানতেন। পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরেই তিনি সেখান থেকে শুঁটকি আমদানি শুরু করেন। তার মূল ব্যবসা শুঁটকি আমদানি হলেও ভারতীয় রুপির সুপার নোটের চালান আনার জন্য তিনি মোজাইক পাথর আমদানির একটি লাইসেন্স করেন। তার প্রতিষ্ঠানের নাম এমআর ট্রেডিং। মোজাইক পাথরের কনটেইনারের আড়ালেই আনতেন সুপার নোটের চালান। পাকিস্তান থেকে শ্রীলংকা হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে চালান খালাসের পর ডেমরা এলাকায় গোডাউনে তোলা হতো। সেখান থেকে সুযোগ বুঝে আবু তালেব নিজের লোকজন দিয়ে ভারতে পাচার করতেন চালান। একই সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে তিনি চালান পৌঁছে দিতেন ডিস্টিবিউটর ফাতেমা আক্তার পপির কাছে। ঢাকার দক্ষিণখানের কাউলা এলাকার বাসিন্দা ফাতেমার সঙ্গে আবু তালেবের কখনো দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। তারা একে অপরকে চেনেন না। ফাতেমার স্বামী পাকিস্তানি নাগরিক দানিশ আলমের মাধ্যমে ফাতেমার যোগাযোগ হতো পাকিস্তানের সুপার নোটের উৎপাদক সুলতান ও সফির সঙ্গে। তারাই ফামেতাকে চালানের তথ্য দিতেন। সংকেত হিসাবে ফাতেমার হোয়াটস অ্যাপে একটি ১০ রুপির নোট পাঠাতেন। আর আবু তালেবের কাছেও পাঠানো হতো একই সিরিয়ালের ১০ রুপির নোট। তালেবের বাহক চালান পৌঁছানোর সময় ওই ১০ রুপির নোট আগে ফাতেমাকে দিতেন। ফাতেমার কাছে থাকা ১০ রুপির নোটের সঙ্গে বাহকের রুপির সিরিয়াল মিললেই চালান হাতবদল হতো। যা সিনেমার চোরাচালান দৃশ্যের মতোই। চালান হাতে পাওয়ার পর ফাতিমা নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে সেগুলো ভারতে পাচার করতেন। এক লাখ রুপির সুপার নোটের বিনিময় মূল্য ৫০ হাজার রুপি। চালান পৌঁছে দেওয়ার পর আবু তালেব ও ফাতেমার লোকজন সুপার নোট বিনিময় করে যে অর্থ পেতেন তা হুন্ডি ব্যবসায়ী শাজাহানের মাধ্যমে ইসলামপুরের কাপড় ব্যবসায়ী সাইদুর রহমানের কাছে পাঠাতেন। সাইদুর রহমান মুন্সীগঞ্জের ওই পরিবারের আরেক সদস্য ও পাকিস্তানে বসবাসকারী ফজলুর রহমানের ভাই। সাইদুর রহমান বেসরকারি দুটি ব্যাংকের দুটি হিসাব নম্বরে ওই অর্থ জমা করার পর তা পাকিস্তানে ফজলুর রহমানের কাছে পাঠাতেন।
জানা যায়, বাংলাদেশের প্রধান ডিস্টিবিউটর ফাতেমা আক্তার পপি দীর্ঘদিন ধরে সুপার নোট কারবারে জড়িত। স্বামী দানিশ আলমের মাধ্যমে প্রথমে সুপার নোটের উৎপাদক সফির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরপর সফির ছেলে সুলতানের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তোলেন ফাতেমা। তবে সুলতান কিংবা সফির সঙ্গে ফাতেমার সরাসরি কথা হতো না। তাদের কথা হতো ‘কাট আউট পদ্ধতিতে’। সুলতানের লোকের সঙ্গে ফাতেমার লোকের কথা হতো। তারা আবার অন্য লোকের মাধ্যমে বার্তা পৌঁছাতেন সুলতান ও ফাতেমার কাছে। এটাকেই বলে ‘কাট আউট’ পদ্ধতি। তবে এত সাবধানতার পরও ২০১০ ও ২০১২ সালে দুদফা ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন ফাতেমা। জামিনে বের হয়ে ২০১৩ সালে তিনি পালিয়ে মালয়েশিয়া চলে যান। ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে আত্মগোপনে থাকেন। এরপর দেশে ফিরে ফের পুরোনো কারবার শুরু করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। আবার গ্রেফতার হয়েছেন ডিবির হাতে।
আরও জানা যায়, আবু তালেবের দেওয়া তথ্যেই সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ডিস্টিবিউটর ফামেতা, হুন্ডি ব্যবসায়ী শাজাহান ও ফরিদের ভাই সাইদুর রহমানকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। তাদের কাছ থেকে সুপার নোট কারবারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। চক্রের অনেক সদস্য শনাক্ত করতে পেরেছেন তারা। তাদের ধরতে সীমান্ত এলাকায় অভিযানও চালানো হয়েছে। একই সঙ্গে এ নিয়ে ডিবির একটি দল চট্টগ্রাম কাস্টমসের সঙ্গে বৈঠক করার জন্য প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কাস্টমসের চোখ এড়িয়ে সুপার নোটের চালানগুলো কিভাবে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকছে তা নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হবে। একই সঙ্গে চালানগুলো যাতে দেশে না আসতে পারে সে সম্পর্কে করণীয় ঠিক করা হবে।