আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারী, ২০২২ ০৯:২০ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪২৪ বার
বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে আকাশপথে ভাড়ার নৈরাজ্য থামছে না। যাত্রীর চাপ বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে অতি মুনাফার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছে উড়োজাহাজগুলো। গত বছরের অক্টোবর থেকে অতিরিক্ত ভাড়ার এই দৌরাত্ম্য শুরু হলেও সব রেকর্ড ভেঙেছে চলতি জানুয়ারিতে। আড়াই মাস আগেও যেখানে সৌদি আরবের জেদ্দা, রিয়াদ, দাম্মাম, মদিনা, আরব আমিরাতের দুবাই, কাতার, ওমান, কুয়েতসহ অন্যান্য রুটে ইকোনমি ক্লাসের একমুখী ভাড়া ছিল সর্বোচ্চ ২৫-৩০ হাজার টাকার মধ্যে, এখন এই জানুয়ারিতে সেই টিকিটের মূল্য তিন-চার গুণ বেড়ে লাখ টাকা পেরিয়েছে। তাও একটি টিকিট যেন সোনার হরিণ! চাইলেই পাওয়া যাচ্ছে না!
আগামী মার্চ পর্যন্ত সৌদি আরবের টিকিট নেই ট্রাভেল এজেন্টগুলোর কাছে। ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলোর অভিযোগ, মধ্যপ্রাচ্যের রুটগুলোতে পর্যাপ্ত ফ্লাইট না থাকার সুযোগে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এয়ারলাইনসগুলো নিজেদের মতো করে টিকিট ব্লকের জমাজমাট বাণিজ্য করছে। রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইনসও এই সিন্ডিকেটে ঢুকে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের যাত্রীদের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বহন করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। স্বাভাবিক সময়ে রিয়াদ, জেদ্দা, মাসকাট ও দুবাই রুটে ইকোনমি ক্লাসের একমুখী ভাড়া ছিল ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। এখন সেটি ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক সভাপতি আবুল বাশার বলেন, দেশি-বিদেশি বিমান সংস্থাগুলো ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ফলে প্রবাসী, শ্রমজীবী, বিদেশগামী যাত্রী, ওমরাহ যাত্রী, রিক্রুটিং এজেন্সি, ট্রাভেল এজেন্সি, টু্যর অপারেটরসহ সবাই ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কার তুলনায় বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিমানের ভাড়া কয়েক গুণ বেশি। বর্তমানে ঢাকা থেকে ছয় ঘণ্টার জার্নি রিয়াদে যেতে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা। অথচ ঢাকা থেকে নিউ ইয়র্ক ২৩ ঘণ্টার জার্নিতে ভাড়া লাগছে মাত্র ৬৫ হাজার টাকা। ১০ জানুয়ারি ঢাকা থেকে দুবাইয়ে ওয়ান ওয়ে সৌদি এয়ারলাইনসের ভাড়া ১ লাখ ৩১ হাজার টাকা, জাজিরা এয়ারলাইনসের ভাড়া ৮৫ হাজার টাকা। এই গন্তব্যে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনসের ভাড়া ৯৩ হাজার টাকা, এমিরেটস ও ইতিহাদ এয়ারওয়েজের ৯৮ হাজার ৮০০ টাকা। ওমানের মাসকাটে আগে একমুখী ভাড়া ছিল ৩৫ হাজার, বর্তমানে সব এয়ারলাইনস ৭২ হাজার টাকা নিচ্ছে। অতীতেও সুযোগ বুঝে অনেক বার এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এয়ারলাইনসগুলো তাদের ইচ্ছামতো অতিরিক্ত ভাড়া যাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে কোনো সংস্থা বিষয়টি তদারক করছে বলে মনে হচ্ছে না।
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) সভাপতি মনছুর আহমেদ কালাম বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিমান ভাড়া তিন গুণের বেশি বেড়েছে। যাত্রী পরিবহনে দৈনিক দরকার সাড়ে পাঁচ হাজার আসন। এর বিপরীতে এখন সব এয়ারলাইনস মিলে আসন আছে সাড়ে তিন হাজার। চাহিদা ও জোগানের সংকট কাজে লাগানোর অনৈতিক প্রতিযোগিতা চলছে এখন। এয়ারলাইনসগুলো সিন্ডিকেট করে টিকিট ব্লক করে রাখছে। তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে না। তিনি বলেন, সৌদি আরব ও ইউএই ভিসা দেওয়া বাড়িয়েছে। ওমানসহ আরো কয়েকটি দেশে ভিজিট ভিসা দেওয়া হচ্ছে। অনেকে করোনার নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশে ফিরতে পারেননি, এখন করোনা কমে আসায় তারা ফিরছেন। অনেক প্রবাসী কর্মস্থলে ফিরতে চান। এদিকে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা বাড়তি দামে টিকিট কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।
আটাবের সাবেক সভাপতি এস এন মঞ্জুর মোর্শেদ মাহবুব বলেন, সৌদি আরবে ওমরাহ হজের জন্য যাত্রীদের চাপ বেড়েছে। আবার সৌদি আরব ও দুবাইয়ে জনশক্তি রপ্তানিও বেড়েছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির আগে যতসংখ্যক ফ্লাইট পরিচালিত হতো, এখন তার চেয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ কমে গেছে। চাহিদার প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা না থাকায় এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এছাড়া কোনো কোনো এয়ারলাইনসের অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে গুটি কয়েক এজেন্সি সিন্ডিকেট করে যাত্রীর নাম ও পাসপোর্ট ছাড়াই ফ্লাইটের আসন ব্লক করে রাখছে। এভাবে কৃত্রিম একটি সংকট তৈরি হয়েছে।
বায়রার পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রায় প্রতিদিনই দাম বাড়ছে টিকিটের। সিট নেই, চাহিদা বেশি—এসব অজুহাত দেখিয়ে যাত্রীদের পকেট কাটা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন অভিবাসী ব্যয় বেড়েছে, তেমনি অস্থিরতা ও নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে দেশের অ্যাভিয়েশন খাতে।
ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের জেনারেল ম্যানেজার (পিআর) মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ভাড়া বৃদ্ধির মূল কারণ হলো করোনাকালীন বিভিন্ন নিয়মকানুন পরিপালন করতে গিয়ে অপারেশন ব্যয় বাড়ছে। এর মধ্যে করোনাবিষয়ক স্বাস্থ্যসেবা দিতে হচ্ছে। স্বাস্থ্যসচেতনার জন্য সিট খালি রেখে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে। এসব কারণে ব্যয় বেড়েছে। এছাড়া জেট ফুয়েলের দাম বেড়েছে। তাই টিকিটের দাম বেড়েছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি আটাব জানিয়েছে। ফ্লাইটের ভাড়ার ব্যাপারে আমরাও সংবেদনশীল। আমরাও চাই যেসব কর্মী প্রবাসে যান, তারা যেন কম ভাড়ায় যেতে পারেন। আমরা এটা নিয়ে মন্ত্রণালয়েও মিটিং করেছি। ভাড়া সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সিভিল অ্যাভিয়েশনকেও অনুরোধ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকেও এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন বলেন, ‘অত্যধিক ভাড়া দিয়ে আমাদের প্রবাসী কর্মীদের যাওয়া সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি ভাড়া লিমিট করে নিয়ে আসা। সিভিল অ্যাভিয়েশন সব এয়ারলাইনসকে নিয়ে বসেছে, যাতে করে ভাড়ার একটা লিমিট থাকে, অসহনীয় পর্যায়ে না যায় সে বিষয়ে আমরা কাজ করছি। আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করা হচ্ছে।’
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলেন, ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি দুঃখজনক। যদিও কমার্শিয়াল ইসু্যতে বেবিচকের হস্তক্ষেপ করার তেমন সুযোগ নেই। তার পরও আমরা এয়ারলাইনসগুলোকে ডেকে ভাড়া কমানোর নির্দেশ দিয়েছি। কারণ ভারত, নেপাল, পাকিস্তানসহ আশপাশের কোনো দেশের ভাড়া বাড়েনি। শুধু ঢাকায় কেন এত ভাড়া বাড়বে? তবে এয়ারলাইনসগুলো উলটো গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের চার্জ কমানোর দাবি জানিয়েছে।
সূত্র : ইত্তেফাক