ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারী, ২০২২ ০৯:২৯ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫০১ বার
উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের তিন মাসের মধ্যে সমাপ্ত প্রতিবেদন (পিসিআর) দেওয়ার বিধান থাকলেও রহস্যজনক কারণে তা দেয়নি ১৩৬টি প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি শেষ হয়েছে আড়াই থেকে তিন বছর আগে। ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রান্তিক মূল্যায়নের কাজ। সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে কিনা, প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কতটুকু পূরণ হয়েছে-এ ধরনের নানা বিষয় সরেজমিন পরিদর্শন করে খতিয়ে দেখা হয়। পিসিআর না পেলে সেটি করা সম্ভব হয় না। দীর্ঘদিন এই প্রতিবেদন না দেওয়ায় প্রকল্পগুলোতে নানা অনিয়ম থাকতে পারে-এমন আশঙ্কা করছেন তারা।
২০২০-২১ অর্থবছরের এসব প্রকল্পের প্রজেক্ট কমপ্লিশন রিপোর্ট (পিসিআর) সংক্রান্ত আইএমইডির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে উল্লিখিত সব তথ্য।
এ প্রসঙ্গে আইএমইডির সাবেক সচিব ও বর্তমান পরিকল্পনা সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী সোমবার বলেন, প্রকল্প শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে পিসিআর জমা দেওয়া প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের জন্য বাধ্যতামূলক। ২০১৬ সালের সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন পদ্ধতি সংক্রান্ত পরিপত্রে এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। কিন্তু অনেকেই সেটি দিতে অনিয়মের আশ্রয় নেন। আমি দায়িত্বে থাকার সময় পিসিআর দিতে একাধিকবার ডিও (আধা সরকারি পত্র) দিয়েছি। এমনটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি তুলে ধরেছিলাম। এতে অনেকে উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিলেন, এসব কেন তুলে ধরেন? কিন্তু আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি। কিছু কিছু পিসিআর এলেও অধিকাংশ আসেনি। এ বিষয়ে আইএমইডি কঠোর হতে পারে। কেননা এটা পরিকল্পনা শৃঙ্খলারপরিপন্থি কাজ।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২২৩টি প্রকল্পের পিসিআর পাওয়া যায়। তবে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার সময় পর্যন্ত ১৩৬টি প্রকল্পের পিসিআর পাওয়া যায়নি। এসব প্রকল্পের মধ্যে ‘মীরসরাই-ফেনী অর্থনৈতিক অঞ্চলে রেললাইন নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা বিশদ ডিজাইন শীর্ষক প্রকল্পটি শেষ হয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু গত অক্টোবর মাসে প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত হওয়ার সময় পর্যন্ত এর পিসিআর পাওয়া যায়নি। অথচ পেরিয়ে গেছে প্রায় তিন বছর। একই অবস্থা ‘বরিশাল সিটি করপোরেশনের অবকাঠামো নির্মাণ ও সৌন্দর্য বর্ধন’ প্রকল্পে। এটি ২০১৫ থেকে শুরু হয়ে ২০১৮ সালের জুনে শেষ হয়। কিন্তু তিন বছরের বেশি সময় পার হলেও পিসিআর পাওয়া যায়নি। রাজশাহী মহানগরীতে পানি সরবরাহ ব্যবস্থার পুনঃসংস্কার প্রকল্পটি ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয়। কিন্তু পিসিআর জমা পড়েনি। ‘সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং প্রত্নতত্ত্ব অবকাঠামোর উন্নতি সাধন ও সংরক্ষণের মাধ্যমে রাজশাহী মহানগরীর টেকসই উন্নয়ন (সংশোধিত)’ প্রকল্পটিও শেষ হয় ২০১৮ সালের জুন মাসে। পিসিআরও পায়নি আইএমইডি। ‘বরিশাল সিটি করপোরেশেনের বিভিন্ন স্থানে সড়ক উন্নয়ন ও প্রশস্তকরণ ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ’ প্রকল্পটি ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের জুনে শেষ হয়। প্রায় সাড়ে তিন বছরেও পিসিআর জমা হয়নি। ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্পটি শেষ হয় ২০১৯ সালের জুন মাসে। দুই বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও পিসিআর জমা দেওয়া হয়নি।
জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট অব ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএমএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফা কে. মুজেরী বলেন, যে কোনো নিয়ম না মানলেই সেটিকে অনিয়ম বলা হয়। পিসিআর সময়মতো জমা না দেওয়াও একটি বড় অনিয়ম। কেননা এটি পেলেই কেবল আইএমইডি প্রকল্পটির সার্বিক অবস্থার মূল্যায়ন করতে পারে। এটি না দেওয়ার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে কোনো ঘাপলা থাকতে পারে। তিন মাসের নিয়ম থাকলেও সেখানে ৬ মাস সময় লাগতে পারে। কিন্তু এক বছর, দুই বছর, তিন বছর পর্যন্ত পিসিআর আসবে না, এটা কী করে হয়। এ বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। জবাবদিহিতা করতে যারা ভয় পায় তারাই পিসিআর নিয়ে গড়িমসি করবে। এ বিষয়ে আরও কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন।
আইএমইডির প্রতিবেদনে যেসব প্রকল্পের তালিকা যুক্ত করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে-মাগুরা জেলার সদর ও শ্রীপুর উপজেলায় গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প। ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসন উপজেলায় অবকাঠামো উন্নয়ন এবং পল্লি সড়কে গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণে সমীক্ষা প্রকল্প। এছাড়া ইন্ট্রোডাকশন অব মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) অ্যান্ড মেশিন রিডেবল ভিসা (এমআরভি) ইন বাংলাদেশ। পাসপোর্ট তথ্য সংরক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প। ইমপ্রুভমেন্ট অব দ্য রিয়েল সিচুয়েশন অব ওভার ক্রাউডিং ইন প্রিজন্স ইন বাংলাদেশ। ১৫টি জেলা শিল্পকলা শিল্পকলা একাডেমি সংস্কার ও মেরামত। ইমপ্লিমেন্টেশন অব দ্য ন্যাশনাল এমপ্লয়মেন্ট ইনজুরি ইন্স্যুরেন্স স্কিম অব বাংলাদেশ। আরও রয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ের মাধ্যমে সমীক্ষা নিরাপত্তা শক্তিশালীকরণ প্রকল্প।
কথা হয় চাকরি জীবনে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালনকারী এবং পরে অতিরিক্ত সচিব হিসাবে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে জানান, অনেক সময় প্রকল্প পরিচালক নেওয়া হয় ভাড়াটে কিংবা অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে। এসব কারণে প্রকল্প শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা অন্যত্র চলে যান। এমনকি কর্মকর্তারাও অস্থায়ী হওয়ায় চাকরি থেকে চলে যান। ফলে পরবর্তীকালে রেকর্ডপত্র আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এর দায়-দায়িত্ব তখন বর্তায় প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা মন্ত্রণালয়ের ওপর। কিন্তু তারা তো আর পিসিআর দিতে পারে না। এ সমস্যা সমাধানে প্রকল্প শেষ হওয়ার তিন মাস আগে থেকেই পিসিআর তৈরির কাজ শুরু করা উচিত। অথবা পিডিসহ কর্মরতদের পিসিআর দিয়ে যাওয়া বাধ্যতামূলক করা দরকার। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে গড়িমসির ঘটনা যে ঘটে না সেটি বলা যায় না। তবে ঢালাওভাবে বলাটা ঠিক নয়।
সূত্র : যুগান্তর