ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

সিনহা হত্যা: সেদিন যা ঘটেছিল

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারী, ২০২২ ১২:০০ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫০৬ বার


সিনহা হত্যা: সেদিন যা ঘটেছিল

দেড় বছর আগে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সেদিন যা ঘটেছিল, তা উঠে আসে।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে সিনহাকে (৩৬) গুলি করে হত্যা করা হয়। এ হত্যার ঘটনায় তাঁর বোন বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় টেকনাফ মডেল থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ১৫ আসামি রয়েছেন। আজ সোমবার এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য রয়েছে।

সিনহা হত্যার ঘটনার এক মাসের মাথায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেয়। তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেন।

প্রতিবেদনে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে পুলিশের হঠকারী (অবিমৃশ্যকারী), প্রস্তুতিহীন ও অপেশাদারি আচরণ বলে উল্লেখ করে তদন্ত কমিটি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, যথাযথ তদারকি ও জবাবদিহির অভাবে গুলিবর্ষণের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মনে অসংবেদনশীলতা তৈরি হয়েছে। আত্মরক্ষার আইনি সুবিধার অপপ্রয়োগ হচ্ছে। এসব বন্ধে কমিটি ১৩ দফা সুপারিশ করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সিনহা তাঁর সঙ্গী সিফাতকে সঙ্গে নিয়ে মারিশবুনিয়ার টুইন্যার পাহাড়ে ‘টাইম ল্যাপস’ ভিডিও করতে গিয়েছিলেন। সন্ধ্যার পর পাহাড়ে আলো দেখে স্থানীয় কয়েকজন তাঁদের ডাকাত বলে সন্দেহ করেন।

লিয়াকত কাউকে জানাননি 
তদন্ত কমিটির কাছে লিয়াকত বলেছেন, মারিশবুনিয়া গ্রামের কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সেক্রেটারি নুরুল আমিন তাঁকে ফোন করে বলেছিলেন যে পাহাড়ে ডাকাতেরা ছোট ছোট আলো ফেলে ঘোরাঘুরি করছে। লিয়াকত তখন মাদক উদ্ধার অভিযান থেকে ফিরছিলেন। নুরুল আমিন আবার ফোন করে বলেন, সেনাবাহিনীর পোশাক পরা সেই লোকেরা গ্রামবাসীকে গুলি করেছেন। তাঁরা সিলভার রঙের গাড়িতে করে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছেন। নুরুল আমিনও কমিটির কাছে একই কথা বলেছেন। কমিটি বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের ৩৫ জন পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, যাঁরা কেউই এ কথা জানতেন না। কথা হয়েছে শুধু লিয়াকত ও নুরুল আমিনের মধ্যে।

 প্রতিবেদনে বলা হয়, লিয়াকত সে খবর কাউকে জানাননি। এমনকি ওসি বা ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তাকেও না। তিনি খবর যাচাই করার জন্য ইউপি সদস্য, চেয়ারম্যান বা স্থানীয় কাউকে ফোন করেননি। কোনো সহকর্মীকেও সেটা বলেননি। লিয়াকত কমিটিকে বলেছেন, খবর যাচাই করার সময় তিনি পাননি। মারিশবুনিয়ার মসজিদ থেকে যখন ‘ডাকাত’ বলে মাইকিং করা হচ্ছিল, তখন নিষেধ করেছিলেন ইমাম জহির আলম। তিনি বলেছিলেন, তাঁরা সেনাবাহিনীর লোক। পাহাড়ে যাওয়ার সময় তাঁর সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়েছিল।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এভাবে লিয়াকতকে বারবার ফোন করা শুধু ডাকাতের ভয়, নাকি অন্য কোনো কারণে, তা জানতে অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন।   

সিদ্ধান্ত লিয়াকতের একার 
পাহাড় থেকে নেমে শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে আসার আগে সিনহা বিজিবির একটি চৌকিতে থেমেছিলেন। বিজিবির সদস্যরা সিনহার পরিচয় জানার পর তাঁকে স্যালুট করেছিলেন। সেখান থেকে ছয় কিলোমিটার আসার পর শামলাপুর তল্লাশিচৌকি, যেখানে সিনহাকে গুলি করা হয়। এর এক থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে সেনাবাহিনীর তল্লাশিচৌকি। এপিবিএনের সদস্যরা কমিটিকে বলেছেন, লিয়াকত চৌকিতে এসে কিছু বলেননি। তিনি শুধু তল্লাশিচৌকির এসআই শাজাহানকে ফোন করেছিলেন। তা ছাড়া তিনি যখন ফোনে ডাকাতের খবর পেয়েছিলেন, তখনো তাঁর সঙ্গে পুলিশের একটি দল ছিল। কিন্তু তিনি কাউকে না জানিয়ে একাই অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। 

কমিটি বলেছে, লিয়াকতের এমন কর্মকাণ্ড অপেশাদারি, খামখেয়ালি, রহস্যজনক ও প্রশ্নসাপেক্ষ। 

সিনহার কোন হাত কোথায় ছিল
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সিনহার গাড়ি তল্লাশিচৌকিতে এলে কনস্টেবল রাজীব সংকেত দেন। গাড়ি থেমে যায়। বাঁ দিকের কাচ নামিয়ে সিনহা পরিচয় দিলে এসআই শাজাহান পেছনে সরে যান। গাড়ি আবার চলতে শুরু করে। এরপর লিয়াকত এসে ব্যারিকেড দিয়ে পিস্তল তাক করেন। সিনহাকে গাড়ি থেকে নামতে বলেন। 

সিনহার সঙ্গী সিফাত কমিটিকে বলেছেন, সিনহার নির্দেশে তিনি গাড়ি থেকে নেমে যান। গাড়ির দুই সিটের মাঝখানে রাখা পিস্তলে সিনহাকে হাত দিতে দেখেন সিফাত। কিন্তু নামার সময় কী হয়েছিল, তা তিনি আর দেখেননি। 

সিনহার গাড়ি থেকে নামা নিয়ে পুলিশের একেক সদস্য কমিটির কাছে একেক রকম তথ্য দিয়েছেন। 

এসআই শাজাহান বলেছেন, সিনহাকে তিনি নামার সময় দেখেননি, দাঁড়ানোর সময় দেখেছেন। তিনি পিস্তল তাক করেননি। 

কনস্টেবল রাজীব বলেছেন, সিনহার এক হাত ওপরে, আরেক হাত নিচে ছিল।

কনস্টেবল আবদুল্লাহ বলেছেন, তিনি সিনহাকে অস্ত্র তাক করতে দেখেননি। তাঁর পিস্তল খাপের মধ্যে ছিল। সেটা বের করতে গেলেই লিয়াকত গুলি করেন। 

এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত কমিটিকে বলেন, লিয়াকত ব্যারিকেড দিয়ে অস্ত্র তাক করে গাড়ির সামনে দাঁড়ান। এরপর...শুট শুট বলেই গুলি করেন লিয়াকত। 

গুলিবর্ষণকারী লিয়াকত কমিটিকে বলেছেন, ‘সিনহা গাড়ি থেকে নেমে উত্তেজিত হয়ে আমার দিকে গুলি করেন।’ তবে কমিটির জেরায় লিয়াকত বলেছেন, গাড়ি থেকে নামার সময় সিনহা ডান হাত কোমরে রাখেন, এরপর পিস্তল তাক করে গুলি করেন।

কমিটি প্রতিবেদনে বলেছে, সবাই বলেছেন, সিনহার বাঁ হাত ওপরে ছিল। কিন্তু ডান হাত কোথায় ছিল, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। একেকজন একেক কথা বলেছেন।

লিয়াকতের জীবনের শঙ্কা ছিল কি
তদন্ত কমিটির কাছে লিয়াকত বলেছেন, তিনি জানমালের নিরাপত্তার জন্য গুলি করেছিলেন। 

কিন্তু এসআই শাজাহান বলেন, ওই সময় লিয়াকতের স্থলে তিনি হলে গুলি করতেন না। গুলি করার কারণ হিসেবে তিনি লিয়াকতের অনভিজ্ঞতা ও সোর্সের ওপর অতিনির্ভরশীলতাকে দায়ী করেছেন। 

কনস্টেবল রাজীব বলেছেন, লিয়াকত গুলি না করলে সিনহা গুলি করতেন কি না, তা তিনি বুঝতে পারেননি। 

আবার নন্দদুলালের কাছে কমিটি জানতে চেয়েছিল, ওই সময় লিয়াকতের জীবনের কোনো শঙ্কা ছিল কি না? জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আমি এ রকম চিন্তা করিনি।’

সিনহাকে মেরে ফেলার জন্য গুলি
অন্য সব সাক্ষী কমিটির কাছে যেসব কথা বলেছেন, তাতে কমিটি মনে করে, সিনহাকে মেরে ফেলার জন্য গুলি করা হয়েছে। 

ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক কমিটিকে বলেছেন, একটি গুলি দূর থেকে করা হলেও পরের সব গুলি খুব কাছ থেকে করা হয়েছিল। 

কমিটি লিয়াকতের কাছে জানতে চেয়েছিল, আত্মরক্ষার জন্য কটি গুলির প্রয়োজন? জবাবে লিয়াকত বলেছেন, তখন সেটা গোনার সময় ছিল না। 

কমিটি মনে করে, সঠিক তথ্য যাচাই করলে, অভিযানের আগে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানালে, প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা নিলে গুলিবর্ষণ এড়ানো যেত। দরকার হলে লিয়াকত বিজিবি ও সেনাবাহিনীরও সহযোগিতা নিতে পারতেন। একে ‘অপেশাদারি, চরম সমন্বয়হীনতা ও ক্রেডিট হাইজ্যাকের কুফল’ বলে মনে করে কমিটি। 

বিনা চিকিৎসায় মারা যান সিনহা
সিনহাকে গুলি করার ২০ থেকে ২৫ মিনিট পর প্রদীপ ঘটনাস্থলে আসেন। এর আগে সিনহাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রদীপ আসার ২২ মিনিট পর সিনহাকে ট্রাকে তোলা হয়। 

কমিটি বলেছে, হাসপাতালে যেতে অস্বাভাবিক দেরি হওয়ায় বিনা চিকিৎসায় সিনহা মারা যান। 

কক্সবাজার জেলা দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি ফরিদুল আলম বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষী ও উপযুক্ত প্রমাণ উপস্থাপন করেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে। তাই আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে বলে আশা করে রাষ্ট্রপক্ষ।


   আরও সংবাদ