আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২২ ১২:৫৯ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৪২ বার
বসনিয়ার ক্রোয়েশিয়া সীমান্ত সংলগ্ন ভেলিকা ক্লাদুসার জঙ্গল, সেখানকার মিরাল ক্যাম্প ও আশেপাশের পরিত্যাক্ত ভবনে দেড় বছর আগে প্রায় ছয় শ' বাংলাদেশিসহ অনেক অভিবাসী ছিলেন৷ সে জায়গাটিতে এখন আর কেউ নেই৷ বছর দেড়েকের মধ্যে কোথায় গেলেন এই অভিবাসীরা?
গত কয়েক বছর ধরে ঝুঁকিপূর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে হাজার হাজার বাংলাদেশী ইউরোপে পৌঁছার চেষ্টা করছেন৷ অভিবাসন বিষয়ে ইউরোপের সংবাদমাধ্যম ইনফোমাইগ্রেন্টস-এর তথ্যমতে, গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে অবৈধপথে ইউরোপে পাড়ি জমানো অভিবাসীদের শীর্ষে রয়েছেন বাংলাদেশীরা৷
এসকল অভিবাসীর একটি বড় অংশই ইতালি পৌঁছার চেষ্টা করে থাকে৷ ইউরোপের বহিঃসীমান্তরক্ষী সংস্থা ফ্রনটেক্স-এর এই হিসাবে ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে অবৈধভাবে ইতালি প্রবেশের তালিকায় বাংলাদেশীরা রয়েছেন দ্বিতীয় অবস্থানে৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে পৌঁছার লক্ষ্যে পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অস্থায়ী ক্যাম্পে আটকে আছেন এমন অনেক বাংলাদেশী৷ সেখানকার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে বসনিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্প পরিদর্শন করছেন ডয়চে ভেলে বাংলার সাংবাদিক আরাফাতুল ইসলাম ও অনুপম দেব কানুনজ্ঞ৷
তারই অংশ হিসেবে বসনিয়ার সীমান্ত-সংলগ্ন ভেলিকা ক্লাদুসার জঙ্গলটি পরিদর্শনে গেলে ডয়চে ভেলের সাংবাদিকদের সাথে দেখা হয় কয়েকজন বাংলাদেশীর৷
সেখানে থাকা বাংলাদেশিদের একজন আশরাফুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘ওরা তো সবাই চলে গেছে৷ ইতালি, ফ্রান্সে চলে গেছে৷ কেউ কেউ ট্যাক্সি গেমে, কেউ কেউ হেঁটে হেঁটে চলে গেছেন৷’
অভিবাসীদের ভাষায়, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পছন্দমতো রাষ্ট্রে পৌঁছানোর নাম ‘গেম'৷ সীমান্ত পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পথ পাড়ি দেয়ে এভাবে অবৈধভাবে পৌঁছানোর পুরো প্রক্রিয়াটিকে তারা ‘গেম মারা' বলে থাকেন৷
জানা গেছে, এমন ‘গেম মারতে' গিয়ে তারা পাচারকারীদের সহায়তা নেন৷ কেউ কেউ আবার নিজের চেষ্টায়ই এমন ঝুঁকি নিয়ে থাকেন৷
জঙ্গলে আটক থাকা প্রায় ছয় শ' বাংলাদেশীর মধ্যে আর মাত্র নয়জন আছেন জানিয়ে আশরাফুজ্জামান বলেন, তিনি নিজেও ‘৩০-৩৫ বার এমন গেম মারতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন৷'
তাছাড়াও আটকে থাকা প্রায় ছয় শ' বাংলাদেশীর মধ্যে ৩০-৩৫ জনের একটি দল এখনো বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে আছেন বলে জানা গেছে৷
যারা ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে পৌঁছেছেন তাদের সাথে যোগাযোগ হয় কি না জানতে চাইলে আশরাফুজ্জামান বলেন, তাদের অনেকের সাথেই তার যোগাযোগ হয় এবং তারা ভালো আছেন৷
তবে তাদের অনেকেই দেশ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে না পারার কারণে ঝামেলায় আছেন বলে দাবি তার৷
কেন জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন তারা?
আট বছর ধরে ইউরোপে পৌঁছার চেষ্টা করছেন বাংলাদেশের রাজু৷ বর্তমানে আটকে আছেন বসনিয়াতে৷ ২০১৪ সালে তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করে আড়াই বছর ওমানে থাকার পর চার বছর ইরানে কাটান৷
কেন আট বছর ধরে ঝুঁকিপূর্ণ এমন চেষ্টা- জানতে চাইলে তিনি বলেন ‘টেকা পয়সা কম, আছে কষ্ট৷ তারপর ফ্যামিলিরে দিলেও হয় না, নিজেরও হয় না৷ এ কারণে এই পথে রওনা দিছি৷’
এত কষ্ট করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে পৌঁছার চেষ্টা করার কী দরকার- এমন প্রশ্নের জবাবে রাজু বলেন, ‘ফ্যামিলিকে সুখে রাখতে গিয়ে কষ্ট করা লাগে৷ বাংলাদেশে তো কাজ নাই যে তাদেরকে কাজ করে খাওয়াব৷ এ কারণেই এই পথে আসা৷’
আর আশরাফুজ্জামান জানান, ২০১৮ সালে তিনি ইউরোপের পথে যাত্রা শুরু করেন৷ যাত্রাপথের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি জানান, প্রায় প্রায় ৫-৬ লাখ টাকা খরচ করে তিনি বসনিয়া এসেছেন৷ চার বছর আগে যাত্রা শুরু করে তিনি ওমান থেকে ইরান হয়ে তুরস্কে পৌঁছান৷ তুরস্ক থেকে গ্রিস হয়ে সার্বিয়া এবং সবশেষ তিনি বসনিয়া এসে পৌঁছান৷
কেন জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে আশরাফুজ্জামান বলেন, 'বাংলাদেশে যদি ব্যবস্থা ভালো হতো তাহলে তো আসা লাগত না৷ মাস্টার্স পাশ করেও কাজ পাওয়া যায় না৷ তরুণেরা নিজে ঠিকে থাকবে বা ফ্যামিলিকে ঠিক রাখবে সেই ব্যবস্থা নেই৷’
নিজে ‘গেম মারতে’ শিখে গেছেন
ইতালি পৌঁছার লক্ষ্যে আশরাফুজ্জামান বসনিয়া থেকে প্রায় দেড় বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছেন৷ প্রথম দিকে দালালদের সহায়তায় গেম মারার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন৷ একপর্যায়ে নিজেই গেম মারতে শুরু করেন বলে জানান তিনি
‘ইতালিতে পৌঁছার লক্ষ্যে বসনিয়া থেকে দালালদের সহায়তায় ১০ - ১৫ বার গেম মারার চেষ্টা করেছি৷ যাইতে যাইতে শিখে গেছি কিভাবে যাইতে হয়৷ মোবাইলে লোকেশন দেখে হেঁটে হেঁটে চলে যাই৷'
তবে ‘গেম মারতে' গিয়ে বার বারই স্লোভেনিয়াতে আটকে গেছেন তিনি৷ যে কারণে এত বার চেষ্টার পরও ইতালি পৌঁছাতে পারছেন না৷
‘আমি বেশিরভাগই স্লোভেনিয়াতে ধরা খাইছি৷ স্লোভেনিয়াতে গাড়িতে উঠতে গিয়ে, গাড়িতে উঠার আগেই পুলিশ এসে, আবার কুকুর এসে ধরে ফেলছে৷’
জানা গেছে, ক্রোয়েশিয়া ও স্লোভেনিয়া পুলিশ সীমান্ত পাহারায় তৎপর রয়েছে৷ পুলিশের হাতে ধরা পড়লে নানা ধরনের নির্যাতনের মুখেও পড়তে হয় বলে দাবি অভিবাসীদের৷
সূত্র : ডয়চে ভেলে