আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২২ ২৩:৫১ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৪৯ বার
নয়া দিগন্ত অনলাইন
ছাত্রনেতা আনিস খানের হত্যা নিয়ে এখনো তোলপাড় চলছে পশ্চিমবঙ্গে৷ পুলিশের ভূমিকা, সুষ্ঠু তদন্তের সদিচ্ছা সবই এখনো সন্দেহের বেড়াজালে৷
পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ অজয়কুমার গুপ্ত এক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের আহ্বানে ঘটনাস্থলে গিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন পুরো ঘটনা৷ সব দেখে, যাচাই করে তিনি নিশ্চিত-কেউ ঠেলে ফেলে দিয়ে আনিসকে হত্যা করেছে, এমন আশঙ্কা প্রবল৷
ড্যামি ব্যবহার করে সব সম্ভাবনা যাচাই করার পর তিনি জানান:
১. অসাবধানতাবশত তিন তলা থেকে পড়ে গেলে আনিস নিজেকে বাঁচানোর জন্য বিদ্যুতের তার ধরতেন কিংবা গাছপালা ধরার চেষ্টা করতেন প্রাণ বাঁচাতে, তেমন কিছু মেলেনি৷
২. অসাবধানতাবশত পড়ে গেলে দেয়াল ঘেঁষেই তার পড়ার কথা৷ কিন্তু আনিসের দেহ পড়েছিল একটু দূরে৷ তাছাড়া এমন অবস্থায় তার পা উল্টোদিকে যাওয়ার কথা নয়৷
৩. আনিস পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে মারা গেলেন কিনা তা-ও খতিয়ে দেখেছেন অজয়কুমার গুপ্ত৷ পুলিশ বা পুলিশের বেশে আসা দুষ্কৃতীর সাথে আনিসের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হতেই পারে৷ হঠাৎ পালাতে গেলে কংক্রিটের রাস্তা থেকে দূরে পড়ার কথা তার৷ আবার পড়ার সময় বাড়ির পাশের বিদ্যুতের তারে লাগার কথা, সেই চিহ্নও থাকার কথা আনিসের শরীরে৷ কিন্তু তার দেহ এত দূরে পাওয়া যায়নি আর তারে গা লাগার চিহ্ন ছিল কি না তা জানা যাবে ময়নাতদন্তের বিশদ রিপোর্টে৷
থানায় বারবার ফোন আনিসের বাবার, পুলিশ আসে ছয় ঘণ্টা পর।
একটি টেলিফোন আলাপ ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়৷ যদিও সেটির সত্যতা যাচাই করেনি। তবে সংবাদ মাধ্যমকে আনিসের বাবা সালেম খান বলেছেন, সেটি তার সাথে আমতা থানার কর্মকর্তার কথোপকথনেরই রেকর্ড৷ সেখানে অন্য প্রান্তের পুলিশ অসংবেদনশীলতা বা তাড়াতাড়ি ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানোয় অনীহার ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট৷
আনিসের বাবা সালেম খান বলছিলেন, তার ছেলেকে তিন তলা থেকে ফেলে দেয়া হয়েছে, ছেলেটি মারা গেছে আর তার প্রতিক্রিয়ায় শীতল কণ্ঠে কথিত পুলিশ কর্মকর্তা জানতে চান, আনিসকে হাসপাতালে নেয়া হয়নি কেন? শুক্রবার রাত আনুমানিক তিনটার দিকে আমতা থানায় শেষ কথা হয় বলে সালেম খানের দাবি৷ তবে পুলিশ আসে শনিবার সকাল নয়টায়৷
সিবিআই তদন্ত চান সালেম খান
এদিকে আনিস হত্যার সুষ্ঠু বিচারের জোরালো দাবির মুখে সিট গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তবে আনিসের বাবা জানিয়েছেন, পুলিশের ওপর বিন্দুমাত্র ভরসা নেই তার৷ শুধু সিবিআই বা আদালতে ভরসা রয়েছে৷
মঙ্গলবার বিকেলে আমতায় আনিসের বাড়িতে গিয়েছিলেন আনিস মৃত্যু রহস্যের বিশেষ তদন্তকারী দল ‘সিট’-এর দুই সদস্য মিরাজ খালিদ এবং ধ্রুবজ্যোতি দে৷ আনিসের পরিবারের সাথে কথা বলতে এলে আনিসের বাবা জিজ্ঞাসা করেন, তারা কেন এসেছেন? ‘সিট’কে আলাদা করে বয়ান দিতে অস্বীকারই করেছেন সালেম খান৷
পুলিশের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
আনিসের পরিবার জানাচ্ছে, গত শুক্রবার রাত দেড়টায় পুলিশ পরিচয় দিয়ে বারবার ধাক্কা দেয়া হয়েছিল তাদের বাড়ির দরজায়৷ আনিসের বাবার কাছে জানতে চাওয়া হয় তার সন্তান কোথায়? বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে হুমকি দেয়া হয় সালেম খানকে৷ এরপরই তিনজন ওপরে ওঠে আনিসকে তিন তলা থেকে ফেলে হত্যা করা হয়।
আনিসের বড় বোন ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলেন৷ বাড়ির কাছে বসে থাকা সিভিক পুলিশকে জানিয়েছিলেন খুন করা হয়েছে তার ভাইকে৷ ওই সিভিক পুলিশরাও এগিয়ে আসেননি৷
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের প্রাক্তন আইজি পঙ্কজ দত্ত'র কথায়, ‘ঘটনার ৯ ঘণ্টার মধ্যে স্নিফার ডগ ঘটনাস্থলে যায়নি, জায়গা ঘেরা হয়নি, নমুনা নেয়া হয়নি, ময়নাতদন্তের সময় পরিবারের কেউ ছিল না, ময়নাতদন্তের ভিডিওগ্রাফি করা হয়নি৷ এর ফলে পুলিশের দিকেই আঙুল উঠছে বারবার৷’
এছাড়া আনিসের মৃত্যু হয়েছে জেনেও জেনারেল ডায়েরি করা হয়নি, নজরদারি বাহিনীও ঘটনাস্থলে পৌঁছায়নি অথচ আমতা থানা থেকে গাড়িতে আনিসের বাড়ি পৌঁছাতে ১০ মিনিট লাগে৷
তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের কোপানলে পড়ার কারণে?
জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা মঞ্চ-সহ একাধিক সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত আনিসের বন্ধু অভীক নাগ৷ তার দাবি, তৃণমূল সরকারের কোপে পড়েছিলেন আনিস৷
তিনি জানান, আনিসকে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছিল৷ এ কারণে আমতা থানাসহ বিভিন্ন সরকারি অফিস ও সরকারি, বেসরকারি ব্যক্তির কাছে চিঠি লিখে সহায়তার আহ্বানও জানিয়েছিলেন আনিস৷ ২৫ মে লেখা সেই চিঠি তার বন্ধুর প্রাণ রক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি বলে হতাশ অভীক নাগ৷
সেই চিঠিতে আনিস জানিয়েছিলেন, তাকে সর্বক্ষণ অনুসরণ করা হয়৷ এ কারণে সশরীরে থানায় না গিয়ে আনিস ডাকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন জানান অভীক৷ তার দাবি, এসডিপিও (আমতা)-র সাথেও কথা বলেছিলেন তারা৷ ওসির সাথেও কথা বলেছিলেন, মেলও করা হয়েছিল৷ কিছুতেই কাজ হয়নি৷
ছিল না সিসিটিভি
শুক্রবার গভীর রাতে আনিস নিহত হওয়ার পর তার বাড়ির কাছের রাস্তায় কোনো সিসিটিভির দেখা মেলেনি৷ ফলে হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা যাতে সম্ভব না হয় সে কারণেই এলাকা সিসিটিভিমুক্ত করা হয়েছিল কিনা এমন প্রশ্নও উঠেছে৷ এমন কাজ কে করতে পারে তা-ও এখন বড় প্রশ্ন৷
অন্য এক মুসকান
আনিসের ভাগ্নি মুসকান জানিয়েছেন, একাধিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন তার মামা৷ পাড়ার কিছু লোক তার মামার পরোপকারিতা, রক্তদান শিবিরের আয়োজন ইত্যাদিকে ভালো চোখে দেখেননি৷ একবার আনিসের বাড়িতে হামলাও চালিয়েছিল তারা৷
আনিসের মৃত্যুর পর তদন্তে প্রয়োজনের কথা বলে তার মোবাইল ফোন নিয়ে যেতে চেয়েছিল পুলিশ৷কিন্তু মুসকান ফোনের সুইচ অফ রেখে জানিয়ে দেন ফোনটা তারা খুঁজে পাচ্ছেন না৷ এখনো সেই ফোন আনিসের পরিবারের কাছে৷ বারবার সেই ফোন চাইছে পুলিশ৷ কিন্তু আনিসের পরিবারের সন্দেহ ফোন পেলে সব আলামত মুছে ফেলে উল্টো আনিসের বিরুদ্ধেই আরো বড় অভিযোগ করা হতে পারে৷
সালেম খানের সোজা কথা, ‘এই ফোন আমি শুধু সিবিআই বা আদালতের কাছে দেবো৷'
বিক্ষোভ অব্যাহত
মঙ্গলবার অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে মহাকরণ অভিযানে যান আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা৷ একই দাবিতে মঙ্গলবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে এসএফআই৷ অবস্থান বিক্ষোভসহ একাধিক কর্মসূচি রয়েছে ধর্মঘটী পড়ুয়াদের৷
প্রশাসনিক তৎপরতা
কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগে সাসপেন্ড করা হয়েছে আমতা থানার তিন পুলিশ কর্মীকে৷ সাসপেন্ড হওয়া পুলিশ কর্মীরা হলেন, এ এস আই নির্মল দাস, কনস্টেবল জিতেন্দ্র হেমব্রম এবং হোমগার্ড কাশীনাথ বেরা৷
সূত্র : ডয়চে ভেলে