ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৭ মার্চ, ২০২২ ২২:০৯ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫৮০ বার
আলেক্সান্দ্রা এবং আন্তোনিনা চার্চে একটি কফিন রাখা। রাশিয়ার তিন রঙা পতাকায় মোড়া। কাস্কেটের ওপর রাখা এক ফৌজি টুপি এবং একটি ছবি। মিখাইল অর্চিকভ ছিলেন মোটররাইফেল ব্রিগেডের ডেপুটি কমান্ডার। ইউক্রেনে লড়াই করতে গিয়ে নিহত হন তিনি। সশস্ত্র রুশ সেনারা তাকে গার্ড অব অনার দেয়ার জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে।
রুশ অর্থোডক্স চার্চের এক যাজক কফিনের চারপাশ দিয়ে হেঁটে প্রার্থনা জপ করছেন এবং একটি ধাতব পাত্র দুলিয়ে ধূপের গন্ধ ছড়াচ্ছেন। চার্চের ভেতরে এর তীব্র গন্ধ যেন মিশে যাচ্ছে গায়কদলের সুমিষ্ট সুরের মূর্ছনার সাথে। নিহত সেনা অফিসারের স্ত্রীর মাথা কালো স্কার্ফে ঢাকা, তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন নিকটাত্মীয়রা।
ইউক্রেনে কত রুশ সেনা এ পর্যন্ত মারা গেছেন? রাশিয়ায় সরকারের দেয়া তথ্যের বাইরে এ নিয়ে অন্য কিছু প্রকাশ করা ফৌজদারি অপরাধ। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রকাশ করা তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ইউক্রেনে তাদের ভাষায় ‘বিশেষ সামরিক অভিযানে' অংশ নিতে গিয়ে ৪৯৮ জন রুশ সেনা নিহত হয়েছে। নিহতদের ব্যাপারে এটাই সর্বশেষ তথ্য, যা প্রকাশ করা হয় গত ২ মার্চ। কিন্তু গত দুই সপ্তাহে এর পর আর কোনো নতুন তথ্য দেয়া হয়নি।
‘আমাদের দেশের অবস্থা এখন মোটেই সহজ নয়’ চার্চে সমবেত মানুষদের বললেন যাজক। ‘সবাই সেটা বোঝেন।’
ক্রেমলিন জনগণকে এমন কথা বিশ্বাস করাতে চায় যে ইউক্রেনে যাওয়া রুশ সেনারা হচ্ছে বীর এবং সেখানে রাশিয়া যা করছে, সেটা আত্ম-রক্ষার্থে তাদের করতে হচ্ছে।
রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশনের সংবাদ বিষয়ক এক সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানের সাম্প্রতিক এক পর্বে উপস্থাপক দাবি করলেন ‘যদি রাশিয়া এখনই হস্তক্ষেপ না করতো, তিন বছরের মধ্যেই ইউক্রেন নেটোতে যোগ দিত... তারা পরমাণু বোমা অধিকারী হতো।’ অনুষ্ঠানে যে চিত্র তুলে ধরা হচ্ছিল তা একেবারেই এক ‘ভিন্ন বাস্তবতা’, যেখানে ইউক্রেনই আগ্রাসন চালিয়েছে।
কোস্ট্রোমা শহরের রাস্তায় অনেকেই ক্রেমলিনের এই সরকারি ভাষ্য বিশ্বাস করেন।
এর একটা কারণ রাশিয়ায় জনমত প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে টেলিভিশন বেশ শক্তিশালী এক গণমাধ্যম। তবে এটাও সত্য, জাতীয় সংকটের রাশিয়ার বহু মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তাদের নেতার পক্ষে দাঁড়ায়-তারা বিশ্বাস করতে চায় না যে তাদের প্রেসিডেন্ট কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নেটো আমাদের দোরগোড়ায় ইউক্রেনে ঘাঁটি গাড়তে চায় এবং তাদের পরমাণু অস্ত্র আছে, বলছিলেন নিকোলাই। পুতিন বেশ ভালো কাজ করেছেন। তিনি এদের এই পরিকল্পনা সফল হতে দেননি।
নিনা ইভানোভা নামে পেনশনভোগী এক নারী বলছিলেন, রাশিয়ার উচিৎ এর শেষ দেখা।
রুশ টেলিভিশনে আপনি যা দেখছেন, তার কতটা আপনি বিশ্বাস করেন।
‘আমি বিশ্বাস করি। কেন করবো না। আমি বরং ইন্টারনেটকে বিশ্বাস করি না’ বলছেন তিনি।
কেন তিনি ইন্টারনেটে পাওয়া খবর বিশ্বাস করেন না? ‘আমি জানি না’ উত্তর দিলেন তিনি।
ইউক্রেনে রাশিয়ার এই অভিযানকে সবাই সমর্থন করেন না। নিকোলস্কোয়ি গ্রামে অর্থোডক্স পাদ্রি ফাদার ইয়োয়ান বার্ডিনের বাড়িতে গিয়েছিলাম আমি। সম্প্রতি তিনি চার্চে ধর্মোপদেশ দেয়ার সময় যুদ্ধবিরোধী কথাবার্তা বলেছেন। চার্চের ওয়েবসাইটেও তিনি এ নিয়ে সমালোচনা করেছেন।
এর পরে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং রাশিয়ার এক নতুন আইনে রুশ সামরিক বাহিনীকে অবমাননার দায়ে জরিমানা করা হয়।
‘আমি বিশ্বাস করি, যে কোনো রক্তপাত, সেটার কারণ যাই হোক বা যেভাবেই আপনি এটিকে যুক্তিসঙ্গত করার চেষ্টা করুন, এটা পাপ’ বলছেন ফাদার ইয়োয়ান।
তিনি বলেন, ‘যে রক্ত ঝরিয়েছে, তার হাতেই রক্তের দাগ। কেউ যদি এর নির্দেশ দিয়ে থাকে, তাহলে এটার দায় তার বা তাদের। যিনি এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন, বা এটি সমর্থন করেছেন বা এ নিয়ে নীরব ছিলেন, এর দায় তাদের। সবচেয়ে খারাপ যা ঘটেছে, তা হলো, ঘৃণা আবার ফিরে এসেছে। এই ঘৃণা আরো বাড়বে, আরো গভীর হবে। কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইউক্রেনের সাথে ঘটনা এখানেই থামছে না। এটিকে থামানোর জন্য কোনো রাজনৈতিক প্রচেষ্টাও নেই। দুদিকেই ঘৃণা আরো বাড়বে, এবং এই ঘৃণা আমাদের দুই দিকের জনগণের মাঝে একটা বিরাট দেয়াল তৈরি করবে সামনের দশকগুলোতে।
কোস্ট্রোমার সমাধিক্ষেত্রে আটজন সৈনিক মিখাইলের কফিন বহন করে কবরে নিয়ে গেল। সামরিক ব্যান্ডে বিষাদময় সুর বাজানো হচ্ছে। এরপর যখন কবরে কফিন নামানো হচ্ছে, তখন গান স্যালুট দেয়া হলো, বাজানো হলো রাশিয়ার জাতীয় সঙ্গীত।
সংক্ষিপ্ত একটি ভাষণও দেয়া হলো।
তিনি বলেন, ‘একজন ছেলে, একজন ভাই, একজন বাবার মৃত্যু সবসময় বেদনাদায়ক। কিন্তু আমরা গর্বিত যে তিনি নিজেদের দেশ, জনগণ এবং সন্তানদের রক্ষায় প্রাণ দিয়েছেন।’
কোস্ট্রোমার মানুষের কাছে মিখাইল হচ্ছেন, ‘পিতৃভূমিকে রক্ষার প্রতিরোধ যোদ্ধা।’
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট পুতিনের নির্দেশে রাশিয়ার সেনাবাহিনীই সীমান্ত অতিক্রম করে একটি সার্বভৌম দেশে আক্রমণ চালিয়েছে। প্রেসিডেন্ট পুতিন দাবি করছেন, তার এই ‘বিশেষ সামরিক অভিযানের’ লক্ষ্য ইউক্রেনকে নাৎসীমুক্ত করা, দেশটির অসামরিকীকরণ। ক্রেমলিনের কথা শুনে মনে হবে বুঝি ফ্যাসিস্টরা ইউক্রেন দখল করে নিয়েছে, যা আসলে মোটেই সত্য নয়।
তবে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে রুশ কর্মকর্তারা তাদের বৃহত্তর লক্ষ্য সম্পর্কে কোন রাখ-ঢাকের চেষ্টাই করছেন না। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, ইউক্রেনে যা ঘটছে তা রাশিয়ার জন্য জীবন-মৃত্যুর ব্যাপার, বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রে রাশিয়া তার পূর্ণ মর্যাদা এবং বৈধ স্বার্থ নিয়ে টিকে থাকবে কীনা, সেটা এর সঙ্গে যুক্ত।
অন্য কথায় বলতে গেলে, এটি আসলে ভূ-রাজনীতির হিসেব-নিকেশ। মস্কো চায় ইউক্রেনকে আবার রাশিয়ার প্রভাব বলয়ে ফিরিয়ে আনতে।
আর ইউক্রেনের সরকার যে কোনোভাবে সেটা থামানোর জন্যই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
সূত্র : বিবিসি