আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১ এপ্রিল, ২০২২ ২৩:১৫ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫১০ বার
রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের মধ্যে যুদ্ধ থামানোর জন্য কয়েক দফা আলোচনা হয়ে গেছে। যার সবশেষটি হলো ইস্তুাম্বুলে। এছাড়াও বিভিন্ন দেশের নেতারা নানা ভাবে পর্দার আড়ালে দু’পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ তো চালাচ্ছেনই। যার সব খবর সংবাদ মাধ্যমে বিস্তারিত আসে না।
দু’পক্ষই এর আগে যুদ্ধ বন্ধের শর্ত হিসেবে তাদের প্রধান কিছু কিছু অবস্থান বা দাবি তুলে ধরেছে।
ইউক্রেন পক্ষ-বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি-বলেছেন, তারা মস্কোর তোলা নিরপেক্ষতার দাবি বিবেচনা করতে রাজী আছে, তবে ভূখণ্ডের ব্যাপারে কোনো আপোষ করবে না।
তাদের ইঙ্গিতটা বোধগম্যভাবেই ডনবাস এলাকা এবং ক্রাইমিয়া নিয়ে। ডনবাসের দোনিয়েৎস্ক এবং লুহানস্ক এলাকাগুলোতে দীর্ঘদিন ধরেই বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা চালাচ্ছে রুশ-সমর্থিত বিদ্রোহীরা, আর রাশিয়া ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে অভিযান শুরুর ঠিক আগে এ দুটো এলাকাকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিও দিয়েছে।
তাছাড়া ২০১৪ সাল থেকেই ক্রাইমিয়া অঞ্চলটি রাশিয়া দখল করে নিয়ে এটিকে তাদের অংশ করে নিয়েছে।
মোদ্দা কথা হচ্ছে-এ দুটি এলাকা কিয়েভের সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। কিন্তু ইউক্রেন বলছে, যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে তাদের দাবির একটি হচ্ছে এসব ভূখণ্ডের ব্যপারে কোনো আপোষ না করা।
এর মধ্যে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে ইউক্রেনের শহরগুলোতে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে, ৪০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে বিদেশে পালিয়েছে। এক কোটি লোক দেশের ভেতরে ঘরছাড়া হয়েছে। কিন্তু এ যুদ্ধ থামানোর শর্ত হিসেবে রাশিয়া কী চাইছে?
রাশিয়া চায় একটি 'নিরপেক্ষ' ইউক্রেন-
রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছে যে ইউক্রেনকে পশ্চিমা নেটো জোটের সম্প্রসারণের বাইরে থাকতে হবে, নিতে হবে নিরপেক্ষ বা ‘নির্জোট' অবস্থান। কিছু বিশ্লেষক বলেছেন, এটিই রাশিয়ার ইউক্রেনে অভিযান চালানোর প্রাথমিক উদ্দেশ্য।
জাপানের ওয়াসেদা ইনস্টিটিউট ফর এ্যাডভান্সড স্টাডিজের একজন বিশেষজ্ঞ পাস্কাল লোটাজ বলছেন, রাশিয়া চায় যে ইউক্রেন তার সংবিধানে এমন একটি অঙ্গীকার সংযোজন করবে এবং রাশিয়ার সাথে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করে এই অবস্থানকে জোরদার করবে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তিনি নিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনা করতে রাজি-কিন্তু ইউক্রেন যদি ভবিষ্যতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দেয় তাহলে এর অর্থ কি দাঁড়াবে তা ততটা স্পষ্ট নয়। কারণ, ইইউ’র সদস্যপদের সাথে পারস্পরিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা আসতে হবে এবং রাশিয়া ব্যাপারটিকে কিভাবে দেখবে তা স্পষ্ট নয়।
ইউক্রেনের অসামরিকীকরণ করতে হবে-
অসামরিকীকৃত ইউক্রেনের প্রশ্নটিও আরেকটি সমস্যার বিষয় হয়ে উঠতে পারে। কারণ নেটো বা ইউরোপিয়ান অংশীদারদের ছাড়া একটি অসামরিকীকৃত ইউক্রেন সবসময়ই আরেকটি রুশ অভিযানের ঝুঁকির মুখে থাকবে। কিন্তু লোটাজ মনে করেন এই দাবির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হচ্ছে-ইউক্রেনকে বিলীন করে দেয়া নয়, বরং এটা নিশ্চিত করা যে তাদের হাতে যেন রাশিয়ার নিরাপত্তা হুমকিতে ফেলার মতো কোনো পারমাণবিক অস্ত্র বা নেটো জোটের অন্য কোনো আক্রমণাত্মক অস্ত্র না থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র একমত হয়েছিল যে, জাপানের আত্মরক্ষামূলক বাহিনী নতুন করে তৈরি করা উচিত। জাপান তখন আন্তর্জাতিক বিবাদ নিষ্পত্তি করার উপায় হিসেবে যুদ্ধকে ব্যবহার করা সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করেছিল। এর বিনিময়ে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং তখন থেকে জাপান তার নিরাপত্তার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
লোটাজ মনে করেন রাশিয়া হয়তো এতদূর পর্যন্ত যাবে না এবং সম্ভবত: ইউক্রেনের কোনো আক্রমণাত্মক সক্ষমতা থাকবে না এটা নিশ্চিত করেই খুশি থাকবে।
ইউক্রেনকে ‘নাৎসীমুক্ত' করতে হবে-
ভ্লাদিমির পুতিন অভিযোগ করেছেন যে, ইউক্রেনের সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে নব্য-নাৎসী গ্রুপগুলো। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অবশ্য এর সাথে একমত নন।
এই অভিযোগ তোলার মধ্যে দিয়ে ভ্লাদিমির পুতিন সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর হিটলারের আক্রমণের স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে চান। এর সমান্তরালে পূর্ব ইউক্রেনের রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ওপর আক্রমণকেও তুলে ধরেন তিনি।
এখন এই নাৎসীবাদ সংক্রান্ত অভিযোগ তোলাটা প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির জন্য একটা ব্যক্তিগত আক্রমণের শামিল-কারণ তিনি নিজেই জন্মেছেন একটি ইহুদি পরিবারে এবং তার দাদা-দাদী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছেন।
লোটেজ বলছেন, সম্ভবত রাশিয়ানরা ইউক্রেনে ক্ষমতার পটপরিবর্তন ঘটানোর ব্যাপারটিতে আড়াল করার জন্য দেশটিকে ‘নাৎসীমুক্ত' করার কথা বলে থাকে। কিন্তু এই সম্ভাবনাটি এখন অনেকটা সুদূরপরাহত হয়ে পড়েছে-কারণ ইউক্রেনের বাহিনী রাশিয়ার বাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা লড়াই করে তাদের অগ্রাভিযান ঠেকিয়ে দিতে পেরেছে।
এখন রাশিয়া তার মুখ-রক্ষা করার জন্য এটা মেনে নিতে পারে যে, জেলেনস্কিই ইউক্রেনের ক্ষমতায় থাকবেন-কিন্তু তাকে অ্যাজোভ ব্যাটালিয়ন নামের উগ্র-দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীটিকে সরিয়ে দিতে হবে। এই গোষ্ঠীটি ইউক্রেনের ন্যাশনাল গার্ডের চালানো প্রতিরোধ-যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে।
লোটাজ বলছেন, এটা খুব কঠিন কাজ হবে না এবং ইউক্রেনের ন্যাশনাল গার্ডেরও এতে ক্ষতি হবে না।
দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক ছেড়ে দিতে হবে-
তুরস্কে অনুষ্ঠিত রুশ-ইউক্রেন শান্তি আলোচনার পর রাশিয়া এক নতুন সামরিক নীতি ঘোষণা করে জানায় যে, তারা রাজধানী কিয়েভ ও চেরনিহিভের ওপর তাদের আক্রমণ ‘নাটকীয়ভাবে’ কমিয়ে দেবে।
বলা হয়, তারা এখন মনোনিবেশ করবে পূর্ব ইউক্রেনের রুশ-ভাষী অঞ্চলের দিকে। যে এলাকাগুলোর অনেকটাই রুশ-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নিয়ন্ত্রণ করে।
পর্যবেক্ষক ও সংবাদদাতারা অবশ্য বলছেন, কিয়েভ ও চেরনিহিভে রুশ আক্রমণ কমার তেমন কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না, যদিও কিছু রুশ সৈন্য তাদের অবস্থান ছেড়ে চলে যাচ্ছে বলে দেখা গেছে। তবে মস্কো এখন এমন দাবি তুলতে পারে যে, ইউক্রেনকে দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের ভেতরের বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিটমহলগুলা ছেড়ে দিতে হবে।
ডনবাসের-যার আসল অর্থ ডোনেট নদীর অববাহিকা অঞ্চল-এই এলাকাগুলো আসলে এই সংঘাতের কেন্দ্রীয় একটি ইস্যু।
ক্রাইমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে মেনে নিতে হবে-
রাশিয়ার আরেকটি দাবি হচ্ছে, ক্রাইমিয়াকে তারা যে রাশিয়ার অংশ করে নিয়েছে তা সরকারিভাবে মেনে নিতে হবে ইউক্রেনকে। রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রাইমিয়ায় ঢুকে অভিযান চালায় এবং এলাকাটি এখন কার্যত মস্কোর শাসনাধীন। কিয়েভ যদি এটা মেনে নেয় - তাহলে ইউক্রেন তার একটি বড় ভূখণ্ড হারাবে।
১৯৯৭ সালে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল যাতে ক্রাইমিয়ার ওপর ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। অবশ্য তখনও ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতায় আসেন নি।
ইউক্রেনে রুশ ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে হবে-
যুদ্ধ বন্ধ করার শর্ত হিসেবে ক্রেমলিন আরো যা দাবি করছে তার একটা হলো-ইউক্রেনে রুশ ভাষার ব্যবহার যে সংরক্ষিত হবে তার নিশ্চয়তা।
ইউক্রেনে ২০১৪ সালে মস্কোর সাথে দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে ওঠার পর থেকেই রুশ ভাষা রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে। রাশিয়ার অন্যতম দাবি ইউক্রেন কোনোমতেই নেটো জোটে যোগ দিতে পারবে না
২০১৭ সালে ইউক্রেনের আদালত স্কুলে রুশ ভাষা শেখানো নিষিদ্ধ করে। তার পর থেকে দেশটিতে আরো কিছু আইন হয়েছে যার লক্ষ্য ইউক্রেনে রুশ ভাষা ব্যবহার কমানো।
জানুয়ারি মাস থেকে নিয়ম করা হয় যে, সেখানে সকল সংবাদপত্র ও সাময়িকী ইউক্রেনীয় ভাষায় প্রকাশ করতে হবে।
শান্তি চুক্তি হতে অনেক সময় লাগবে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব বিষয়ে ভ্লাদিমিরি পুতিনের দাবি যাই হোক না কেন - রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি নিয়ে দরকষাকষিতে অনেক সময় লেগে যাবে। কিন্তু একটা শান্তি চুক্তি আসলে দুটি দেশের জন্যই দরকার।
ইউক্রেনের দরকার, কারণ তাদের বেসামরিক মানুষের মৃত্যু বন্ধ করতে হবে, শহরগুলোর ধ্বংসের ফলে যে গুরুতর বাস্তব ক্ষতি-তার হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে। যেভাবে দেশটি থেকে লাখ লাখ মানুষ প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালাচ্ছে তাও ঠেকাতে হবে।
অন্যদিকে রাশিয়াও একটি শান্তি চুক্তি চাইবে কারণ এ যুদ্ধে বড় সংখ্যায় তাদের সৈন্যরা মারা যাচ্ছে। তাছাড়া পশ্চিমা দেশগুলো যেসব অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তা এর মধ্যেই সাধারণ রুশদের জীবনে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। এ ক্ষতিগুলোও তাদের ঠেকাতে হবে।
সূত্র : বিবিসি