ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১১ মে, ২০২২ ০৮:৪৯ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫০৯ বার
বাংলাদেশে সয়াবিন তেল মজুদের বিরুদ্ধে অভিযানে খুচরা বিক্রেতা এবং পাইকারি বিক্রেতারা ধরা পড়ছেন। কিন্তু সরবরাহ বিঘ্নিত করার মূল অভিযোগ যে আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে তাদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। বরং উল্টো তারা তেলের দাম আরো বাড়বে বলে ডিলারদের জানাচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রতিদিন সয়াবিন তেলের চাহিদা কম বেশি সাড়ে ছয় লাখ লিটার। অভিযানে সোমবার দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার হয়েছে এক লাখ লিটার। উদ্ধার করা তেল মাত্র এক দিনের চাহিদার ছয় ভাগের এক ভাগেরও কম। তাই এটা দেখে সিদ্ধান্তে আসার কোনো উপায় নেই যে খুচরা বিক্রেতা ও পাইকারি বিক্রেতারাই তেল মজুত করে রেখেছে। এর পেছনে মূল খোলোয়াড় হলো আমদানিকারকেরা। ভোক্তা অধিদপ্তর সেকথা স্বীকারও করেছে কাছে। কিন্তু তারা আইনগত ব্যবস্থা না নেয়ার পিছনে সরবরাহ ব্যবস্থা আরো বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কার কথা বলছে।
তেলের নানা তেলেসমাতি
গত ২০ মার্চ সয়াবিনের দাম প্রতি লিটার ১৬৮ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬০ টাকা নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু ওই দামে কখনোই বাজারে তেল পাওয়া যায়নি। যেটুকু পাওয়া গেছে তা ১৫ দিন পর। আর তখন থেকেই বাজারে তেলের সংকট শুরু হয়। এখন লিটারে ৩৮ টাকা বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা করার পরও বাজার স্বাভাবিক হয়নি। তবে বাজারে দ্রুত তেল আসছে। আবার বাজারে পুরনো বোতলে নতুন বিক্রয়মূল্য লিখে কেউ কেউ বিক্রি করছেন যা বেআইনি।
আমদানিকারকেরা তেল সরবরাহ করতে শুরু করেছেন। তবে এটা আগে আমদানি করা তেল যা তারা মজুত করে রেখেছিলেন সেই তেল বলে জানায় ভোক্তা অধিদফতর। বাজারে নতুন আমদানি করা তেল আসতে আরো সময় লাগবে। বাজারে এখনো নতুন দামেও তেল পাওয়া যাচ্ছে না। ২২০ টাকা দামেই প্রতি লিটার কিনতে হচেছ। কলাবাগানের দোকানদার মিন্টু মিয়া বলেন, ‘আমরা তো এখনো তেল পাচ্ছি না। সরবরাহ নাই। যাদের কাছে পুরনো তেল আছে তারা ২২০ টাকার নিচে প্রতি লিটার বিক্রি করছেন না।’
কারওয়ানবাজারের পাইকারি বিক্রেতা রহমান ট্রেডার্সের মালিক আবদুস সামাদ বলেন, ‘আমরা এখনো তেল পাইনি। বলা হচ্ছে দ্রুতই সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। আমাদের কাছে এখন সয়াবিন তেল নাই।’
তিনি বলেন, ‘১৫ রোজা থেকে আমরা কোনো তেল পাইনি। মিল থেকে কোনো তেল দেয়া হয়নি।’
এখন যে সয়াবিন তেল উদ্ধার হচ্ছে সেব্যাপারে তিনি বলেন, ‘তেলের দাম বাড়বে এটা শুনে কেউ কেউ তেল ধরে রেখেছিলো। সেটাই উদ্ধার হচ্ছে।’
আসল খেলোয়াড় যারা
কনজ্যুমারস অ্যাসেসিয়েশন অব বালাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এস নাজের হোসাইন বলেন, ‘এখন অভিযানে যে তেল উদ্ধার হচ্ছে তা মজুত করা তেলের খুবই সামান্য অংশ। আর যারা ধরা পড়ছেন তারা খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতা বা আঞ্চলিক সাব ডিলার। কিন্তু মূল ডিলার বা ডিষ্ট্রিবিউটর এবং আমাদানিকারকরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কারণ তারা ক্ষমতাধর এবং সরকার তাদের ধরতে চায় না। আর বাণিজ্যমন্ত্রী তার দায়িত্ব পালন না করে আবেগি কথা বলছেন। তিনিও ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই কাজ করেন।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘আমদানিকারকেরা দুইভাবে তেল মজুত করে সংকট তৈরি করে। প্রথমত তারা নিজেরাই মিলে তেল রেখে দেয়। আরেকটি হলো তাদের সিন্ডিকেটে সহায়তাকারি ডিলারদের গুদামে রেখে দেয়। সেই সব গুদাম বা মিলে অভিযান হচ্ছে না।’
ঈদের আগে ভোক্তা অধিদফতর মিল পর্যায়ে অভিযান চালিয়ে অনিয়ম পায়। তারা তখন ওই অনিয়ম নিয়ে তেল আমদানিকারকদের ডাকলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিক্তি সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘আমরা আমাদের তদন্তের প্রতিটি পর্যায়েই সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব পেয়েছি। খুচরা, পাইকারি, ডিলার এবং আমদানিকারক সবখানেই সিন্ডিকেট কাজ করে। আমদানিকারক বা মিল পর্যায়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য তিন ধরনের কৌশল অবলম্বন করা হয়। এসও (সেল অর্ডার) ধরে রাখা, এসওতে বিক্রয় মূল না লেখা এবং পরিশোধন (রিফাইন) কমিয়ে দেয়া।’
ডিলাররা আমদানিকারকদের কাছ থেকে এসও নিয়ে মিল থেকে তেলের সরবরাহ নেয়। ১৫ দিনের মধ্যে তাদের তেল পাওয়ার কথা থাকলেও তাদের অনেক দেরি করে তেল দেয়া হয়। এসওতে দাম লেখা না থাকায় ইচ্ছে মত দাম নেয়া যায়। আর উৎপাদন কমিয়ে তেল ধরে রাখা হয়।
তিনি বলেন,‘আমদানিকারকেরা সব ডিলারকে তেল না দিয়ে তাদের সিন্ডিকেটের সদস্য ডিলারদের সরবরাহ করে তেল তাদের মাধ্যমে মজুত করে রাখে বলে যে অভিযোগ আছে সেটাও সত্য।’
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের ক্ষমতা আছে , আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারতাম। কিন্তু অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তেল আমদানি করায় আমাদের অশঙ্কা ছিল আইনগত ব্যবস্থা নিলে সরবরাহ ব্যবস্থা আরো বিপর্যন্ত হতে পারে। তাই আমরা তাদের সাথে আলোচনা করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছি।’
আমদানিকারকেরা যা বলেন
বাংলাদেশে প্রতিমাসে সয়াবিন তেলের চাহিদা দুই লাখ টন। তেলের কোনো ঘাটতি নেই। এখন যে তেল আছে তা কয়েক মাস আগে আমদানি করা। ফলে মজুত করেই সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু টিকে গ্রুপের পরিচালক ও ভোজ্য তেল মিল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি মোস্তফা হায়দার মিল পর্যায়ে তেল মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন’ এখন যে তেল উদ্ধার হচ্ছে ডিলার বা পাইকারি বিক্রেতাদের কাছ থেকে তার দায় কিছুটা হলেও আমাদের আছে। আমাদের ডিলারেরা ঠিকমত বাজারে তেল দিচ্ছে কী না সেটা দেখাও আমাদের দায়িত্ব। তারা আমাদের কাছ থেকে তেল নিয়ে কী করে তা আমাদের দেখা উচিত।’
তেল আমদানির পর কতদিনের মধ্যে রিফাইন করতে হবে এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সেটাতো আমাদের বিষয়। এখানে কোনো সময় বেধে দেয়া যায়না। কারণ ঝুঁকিটা এককভাবে আমরা নিই।’ আর ১৫ দিনের মধ্যে এসওর তেল তারা সরবরাহ করেন বলে দাবি করেন তিনি।
তিনি বলেন,‘এসও বিক্রি করে আবার ডিলারদের মাধ্যমে তেল জমিয়ে রেখে সেখান থেকে প্রফিট গেইন আসলে কেউ করে না।
বাণিজ্যমন্ত্রী তো ঈদের আগেই বলেছেন দাম সমন্বয় করবেন। এখন প্রতি লিটারে ৩৮ টাকা যদি বেশি দাম হয় এই লোভে কোনো কোনো বিক্রেতা তেল ধরে রাখবে এটা তো ধরেই নেয়া যায়।’
এই আমদানিকারক জানান, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিদিনই তেলের দাম বাড়ছে। তাই আবারো তেলের দাম বাড়তে পারে এই কথা অমূলক নয়। তবে আমাদের এখানে সমস্যা দাম সমন্বয়ে এক মাসের মত টাইম গ্যাপ হয়। ফলে ভোক্তাদের মধ্যে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়।
তারা বলেন, বিশ্ববাজারে যখন বাড়ে তখন দাম বাড়ে যখন কমে তখন কমে না। কিন্তু এটা নিশ্চিত করতে হবে যে বোতলের গায়ে যে দাম লেখা থাকবে যখনই বিক্রি করুক সেই দামই নিতে হবে। এটা আইন।’
অভিযান চলছে
এদিকে তেল মজুতের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে। মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত আরো দুই লাখ লিটার তেল উদ্ধারের খবর পাওয়া গেছে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে। উদ্ধারের পর এই সব তেল গায়ে লেখা দামে (আগের দামে) বিক্রি করে দেয়া হয়। তাই মজুতদারেরা এখন বোতলের তেল ঢেলে খোলা হিসেবে বিক্রির কৌশল নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
সূত্র : ডয়চে ভেলে