ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২ মে, ২০২২ ১১:৫৮ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৮৬ বার
কখনো খুবই আনন্দিত, আবার কখনো খুবই বিষণ্ণ। সহজ ভাষায় বলতে, দীর্ঘসময় ধরে একজন ব্যক্তির মুডের, আবেগের বা মানসিক অবস্থার বিপরীতমুখী পরিবর্তন ঘটতে থাকলে তাকে বাইপোলার ডিসঅর্ডার বলে বর্ণনা করে থাকেন চিকিৎসকরা। অর্থাৎ এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা কখনো কখনো দীর্ঘসময় ধরে বিষণ্ণতা বা মন খারাপের মধ্যে থাকেন। কখনো কখনো সেটা কয়েক মাস ধরে চলতে থাকে। আবার একই ব্যক্তি একসময় সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী আচরণ করতে শুরু করেন। সেই সময় তিনি অতিরিক্ত হাসিখুশি বা উচ্ছ্বাস প্রবণ হয়ে ওঠেন।
ডায়াবেটিসের মতো বাইপোলার ডিসঅর্ডার একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ। ওষুধ এবং চিকিৎসার মাধ্যমে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তবে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলা যায় না।
বাইপোলার ডিসঅর্ডার কী?
বাইপোলার মানে হচ্ছে দুই মেরু। অর্থাৎ একজন ব্যক্তির মানসিকতার এক প্রান্তে থাকে উৎফুল্লতা, অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস প্রবণতা, যাকে চিকিৎসকরা বলেন ম্যানিয়া এপিসোড। রোগী অতিরিক্ত উৎফুল্ল থাকেন, কথা বেশি বলেন, অনেক সময় জিনিসপত্র বিলিয়ে দেন।
আরেকপ্রান্তে থাকে বিষণ্ণতা, যাকে চিকিৎসকরা বলেন ডিপ্রেশন এপিসোড। এই সময় তার কিছুই ভালো লাগে না, হতাশায় ভোগেন, দুঃখ বোধ প্রবল থাকে। অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যায়।
এই দুইয়ের মাঝামাঝি সময়ে রোগী ভালো থাকেন। সেই সময় অন্য সব মানুষের মতোই স্বাভাবিক আচরণ করেন।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা: মেখলা সরকার বলছেন, একেকটি এপিসোড (ম্যানিয়া অথবা ডিপ্রেশন) কখনো কখনো কয়েকদিন, কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস ধরেও চলতে পারে।
বাইপোলার ডিসঅর্ডার কেন হয়?
বাইপোলার ডিসঅর্ডার ঠিক কোন কারণে হয়, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে এর পেছনে কয়েকটি উপাদান কাজ করে থাকতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি এক শ’ জন মানুষের মধ্যে কমপক্ষে একজন জীবনের কোন একটি পর্যায়ে বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগে থাকেন।
অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার বলছেন, অনেক সময় জেনেটিক্যালি বা বংশগত কারণে বাইপোলার রোগটি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে চলে আসে।
বিশেষত মস্তিষ্কে সেরোটোনিন, ডোপামিন, নরঅ্যাড্রেনালিন ইত্যাদি নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্যহীনতা, স্বায়ুবিকাশজনিত সমস্যা, মানসিক রোগের ভুল চিকিৎসা ইত্যাদি কারণে বাইপোলার হতে পারে।
সাধারণত তরুণ বয়সে এই রোগের প্রকাশ দেখা যায়। নারী ও পুরুষ-উভয়েরই এ রোগটি হতে পারে। একজন থেকে আরেকজনের সাথে লক্ষণের পার্থক্য থাকতে পারে।
বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৪ জন বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগছেন
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে গবেষণায় অংশ নেয়া প্রতি এক হাজার জনের মধ্যে চারজন বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডারে ভুগছেন।
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবী একজন তরুণী বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই বাইপোলার রোগে ভুগতে শুরু করেছিলেন। সেই সময় তিনি দিনের পর দিন ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকতেন। কয়েক সপ্তাহ ধরে ঘরের বাইরে বের হতেন না। পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন- কারো সঙ্গে কথা বলতেন না। ঠিকমতো খাবার খেতেও ইচ্ছা করতো না।
আবার কিছুদিন পরেই সেই একই মানুষ একেবারে উল্টো আচরণ করতে শুরু করতেন। তখন বাসায় পার্টি করা, বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়া শুরু হয়। ইচ্ছামতো দরকারি-অদরকারি জিনিসপত্র কিনতে শুরু করেন। রাতে ঘুমাতেন না, টাকা পয়সার খরচে কোন হিসাব থাকতো না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই তরুণী বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘পরিবারের সদস্যরা প্রথমে ভেবেছিলেন, আমি কোনো মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছি কিনা। সেটা হয়নি বোঝার পর তারা আমাকে মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। তখন চিকিৎসক জানালেন, আমি বাইপোলারে আক্রান্ত।’
সেই সময় থেকেই তিনি নিয়মিত ওষুধ এবং চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। পড়াশোনা শেষ করার পর এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেছেন এই তরুণী।
’এখনো মাঝে মাঝে মুড চেঞ্জ হয়, আমি টের পাই। মন খারাপ হয়, বা অযথা কেনাকাটা করতে ইচ্ছা করে। কিন্তু এখন নিজেকে খানিকটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। তারপরও এমন সব আচরণ করে ফেলি, যা হয়তো করতে চাই, পরে অনুশোচনা হয়,’ তিনি বলছিলেন।
আচরণ পরিবর্তনের কারণে কর্মক্ষেত্রে বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অনেক সময় তার সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলেও তিনি জানান।
বাইপোলার ডিসঅর্ডারের লক্ষণ
বাইপোলারে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যেহেতু দুই ধরনের মুড বা আচরণ প্রকাশ করেন, তাই এর লক্ষণও দুই প্রকার বলা যায়। একই ব্যক্তির মধ্যে সময়ের ব্যবধানে এরকম পরস্পর বিপরীত আচরণ দেখা গেলে মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
ম্যানিয়া এপিসোড
- অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ, অতি উৎফুল্ল মনোভাব
- অতিরিক্ত কথা বলা
- নিজেকে বিশাল শক্তিশালী, বড় কেউ, ক্ষমতাশালী মনে করতে শুরু করা
- হাই এনার্জি বা অতিরিক্ত কাজের প্রবণতা
- খাবারে অনীহা
- অযৌক্তিক কথা বা দাবি করা, চিন্তাভাবনা করা
- বাড়তি উচ্ছ্বাস প্রবণতা
- নিদ্রাহীনতা, ঘুম এলেও ঘুমাতে না চাওয়া
- হঠাৎ রেগে যাওয়া, ঝগড়াঝাঁটি বা মারামারি করা
- বেপরোয়া মনোভাব
- বেশি বেশি খরচ করতে শুরু করা, অদরকারি জিনিসপত্র কিনতে চাওয়া
- মনোযোগ হারিয়ে ফেলা
- যৌন-স্পৃহা বেড়ে যাওয়া
- নিজের জিনিসপত্র অন্যদের বিলিয়ে দেয়া
ডিপ্রেশন ডিজঅর্ডার
ম্যানিয়া ডিসঅর্ডারের ঠিক বিপরীত হচ্ছে ডিপ্রেশন ডিসঅর্ডার। একই ব্যক্তি পরস্পর বিপরীতমুখী এধরনের মানসিক পরিবর্তনে ভোগেন বলেই বাইপোলার ডিসঅর্ডার বলা হয়।
- দীর্ঘসময় বা দীর্ঘদিন ধরে বিষণ্ণতায় ভুগতে থাকা, হতাশায় ভোগা
- বিনা কারণে কান্নাকাটি করা, উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠা
- আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা
- নিজেকে ক্ষুদ্র, তুচ্ছ বলে মনে করা
- আত্মহত্যার প্রবণতা, জীবন সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, মরে যেতে চাওয়া
- কোন ঘটনাতেই আনন্দ বা খুশী হতে না পারা
- খাবারের আগ্রহ হারিয়ে ফেলা বা অতিরিক্ত খাবার খাওয়া
- অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ, কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা
- অপরাধ বোধ, নিজেকে দোষী ভাবা
- যৌন-স্পৃহা কমে যাওয়া
- স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, মনোযোগ হারিয়ে ফেলা
- খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া
অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার বলছেন, ‘যখন কেউ বাইপোলার মুডে ভুগতে থাকেন, তখন নিজেকেই সঠিক বলে মনে করেন। হয়তো পরবর্তীতে তার অনুশোচনা হয়, কিন্তু সেই সময় অন্যদের সম্পর্কে তিনি ভাবতে থাকেন, যে তারা তাকে বুঝতে পারছে না, সহায়তা করছে না।’
কারো কারো ক্ষেত্রে আচরণের এই পরিবর্তন দ্রুত হয়, কারো কারো ক্ষেত্রে দীর্ঘসময় পরে হতে পারে।
বিষণ্ণতার সঙ্গে বাইপোলারের একটি বড় পার্থক্য হচ্ছে, এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা একটা সময় বিষণ্ণতায় ভুগলেও আরেকটা সময় ঠিক বিপরীত আচরণ করেন।
সাধারণত দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বিষন্নতা বা অতিরিক্ত উচ্ছ্বাসে ভুগলে তখন বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগছেন বলে ধারণা করা যেতে পারে।
বাইপোলার ডিসঅর্ডারের কী চিকিৎসা রয়েছে?
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা: মেখলা সরকার বলছেন, এখন বাংলাদেশের প্রায় সব জেলা শহরেই মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। কারো মধ্যে বাইপোলার ডিসঅর্ডারের লক্ষণ দেখা গেলে মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
‘আমরা বলি না, এটা একেবারে নিরাময় সম্ভব। তবে ডায়াবেটিস রোগের মতো নিয়মিত চিকিৎসার মধ্যে থাকলে এটা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব,’ বলছেন অধ্যাপক সরকার।
এরপর চিকিৎসকের দেয়া ওষুধ এবং পরিবারের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে থাকলে এ রোগটি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব বলে তিনি বলছেন।
তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন, কারো মধ্যে বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা যেকোনো মানসিক রোগ দেখা গেলে অবশ্যই স্বজনদের উচিত তার সঙ্গে সতর্ক আচরণ করা। বিশেষ করে তার সঙ্গে সরাসরি কোনো তর্ক না করা, জোরাজুরি করা উচিত নয়।
সূত্র : বিবিসি