আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৩ মে, ২০২২ ১৯:৫৭ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৫৮ বার
শ্রীলংকা এখন এক সন্ধিক্ষণে-এক তীব্র অর্থনৈতিক সংকট দেশটির দু'কোটি ২০ লাখ মানুষের জীবনে উলট-পালট ঘটিয়ে দিয়েছে।
শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধে বিজয়ের পর রাজাপাকসেদের বীর হিসেবে বন্দনা করেছে অনেকে, কিন্তু এখন শ্রীলংকার সবচেয়ে ধিক্কৃত এবং সমালোচিত রাজনীতিকে পরিণত হয়েছেন। কীভাবে এরকম ঘটল এবং এর পর কী ঘটতে যাচ্ছে?
এপ্রিলের শুরু থেকে শ্রীলংকায় প্রেসিডেন্ট গোটাভায়া রাজাপাকসে এবং তার ভাই, প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবি জানাতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। শ্রীলংকার অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদেরকে দায়ি করা হচ্ছিল। কিন্তু এ সপ্তাহে পরিস্থিতি একেবারে নাটকীয় মোড় নিল।
প্রথমত, সরকার বিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর মাহিন্দা রাজাপাকসের সমর্থকরা হামলা চালানোর পর দেশজুড়ে তীব্র সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ল। এর পর প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসেকে পদত্যাগ করতে হলো। এক ডজনের বেশি রাজনীতিকের বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হলো-এর মধ্যে কিছু বাড়ি ছিল রাজাপাকসেদের।
বিক্ষুব্ধ জনতা ৭৬-বছর বয়সী রাজাপাকসের সরকারি বাসভবনও ঘেরাও করেছিল, সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে আনতে হয়। এখন তিনি নিজের নিরাপত্তার জন্য শ্রীলংকার উত্তর-পূর্বে একটি নৌ-ঘাঁটিতে গিয়ে লুকিয়ে আছেন। শ্রীলংকার আদালত তার দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যিনি দুই দুইবার শ্রীলংকার প্রেসিডেন্টও ছিলেন, তার জন্য এটি এক বিরাট অবমাননা।
কিন্তু পদত্যাগ করে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালেও মানুষের ক্ষোভ কমেনি, তার ৭২-বছর বয়সী ছোট ভাই, প্রেসিডেন্ট গোটাভায়া রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভকারীরা অটল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট এখনো পর্যন্ত পদত্যাগের দাবি উপেক্ষা করেছেন, তবে তাকে বাধ্য হয়ে কিছু ছাড় দেয়ার প্রস্তাব দিতে হয়েছে। প্রেসিডেন্ট গোটাভায়া রাজাপাকসে তার কিছু নির্বাহী ক্ষমতা পার্লামেন্টের কাছে হস্তান্তরে রাজী হয়েছেন। তিনি ঝানু রাজনীতিক রানিল বিক্রমাসিংহেকে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছেন একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনের লক্ষ্যে।
কিন্তু তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনো সুতায় ঝুলছে। অনেকে মনে করেন, তাকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর শ্রীলংকা যখন এ যাবতকালের সবচেয়ে শোচনীয় অর্থনৈতিক সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন দেশটিতে এরকম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা পরিস্থিতিকে আরো ভয়ংকর করে তুলতে পারে। জিনিসপত্রের দাম যেরকম বেড়ে গেছে, খাদ্য এবং জ্বালানির যে সংকট তৈরি হয়েছে, তাতে জনগণ এখন ক্রোধে ফুঁসছে।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শ্রীলংকার রাজনীতিতে ছিল যে পরিবারের বিরাট আধিপত্য, তাদের জন্য এটি এক বিরাট পতন। এক সময় শ্রীলংকার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি জাতিগোষ্ঠীর কাছে মাহিন্দা রাজাপাকসে ছিলেন বীর নায়ক। কারণ তিনি প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ২০০৯ সালে তামিল বিদ্রোহীদের নির্মমভাবে দমনের মাধ্যমে তিন দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি টেনেছিলেন।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপর যেসব বড় বড় বিজয় শোভাযাত্রা এবং জনসভা হয়েছিল, সেগুলোতে তাকে সিংহলি বৌদ্ধ রাজাদের সাথে তুলনা করা হত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক কুশল পেরেরা বলেন, ‘স্বাধীনতা উত্তর শ্রীলংকায় তিনি ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় সিংহলি বৌদ্ধ নেতা। অনেকে তো তাকে এমনকি সম্রাট মাহিন্দা বলেও প্রশংসা করতো।’
কুশল পেরেরা ২০১৭ সালে ‘রাজাপাকসে : দ্য সিনহালা সেলফি’ বলে যে বই লেখেন, তাতে এই দ্বীপ রাষ্ট্রের রাজনীতিতে রাজাপাকসে পরিবারের ভূমিকা এবং কীভাবে মাহিন্দা রাজাপাকসে নিজেকে ক্ষমতার জন্য তৈরি করেছেন, তা তুলে ধরেছেন।
তার বাবা ছিলেন একজন সংসদ সদস্য এবং মাহিন্দা সংসদে একজন বিরোধী নেতা থেকে ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হন।
এক বছর পর তিনি যখন প্রেসিডেন্টের পদে আসীন হন, তখন তার ভাই গোটাভায়াকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নিয়োগ করেন। গোটাভায়া শ্রীলংকার সামরিক বাহিনী থেকে অবসরে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে নিভৃত জীবনযাপন করছিলেন। তার জন্য এটা ছিল এক বিরাট রাজনৈতিক উত্থান।
তিনি দেশে ফিরে তার ভাইয়ের সরকারে যোগ দিলেন এবং বিরাট খ্যাতি অর্জন করলেন তার নিষ্ঠুরতার জন্য। এরপর রাজাপাকসে পরিবারের আরো অনেক ভাই এবং আত্মীয়-স্বজন সরকারে যোগ দিলেন। তবে রাজাপাকসে সাম্রাজ্যের মূল ব্যক্তি ছিলেন মাহিন্দা, বলা যেতে পারে তিনিই এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।
এ পর্যন্ত দুই ভাইকে সবসময় ঐক্যবদ্ধই দেখা গেছে। কিন্তু সম্প্রতি তাদের মধ্যে সম্পর্কে ফাটল দেখা যাচ্ছিল। বিশেষ করে যখন গোটাভায়া তার ভাই মাহিন্দাকে বিক্ষোভাকারীদের দাবির মুখে পদত্যাগ করতে বলেন সব কিছুর দায় নিয়ে।
মাহিন্দা রাজাপাকসের জন্য এটি ছিল এক বিরাট অপমান, কারণ তিনিই তার ছোটভাই গোটাভায়াকে ক্ষমতায় এনেছেন। রাজনীতি থেকে তাকে এভাবে বিদায় নিতে হবে সেটা তিনি কখনো কল্পনাও করেননি।
‘আসলে তরুণদের বিরাট প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দমনে তিনি ইতস্তত করেছিলেন, এরপর তার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল, তিনি পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন ‘ বলছেন কুশল পেরেরা।
তবে মাহিন্দার বড় ছেলে নামাল দুই ভাইয়ের মধ্যে এরকম কোনো দ্বন্দ্বের কথা অস্বীকার করেছেন।
মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের আগে এ সপ্তাহেই তিনি বলেছিলেন, ‘তবে প্রেসিডেন্ট এবং (সাবেক) প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে নিশ্চয়ই নীতিগত প্রশ্নে পার্থক্য ছিল।’
নামাল রাজাপাকসে বলেন, তার বাবা মাহিন্দা রাজাপাকসে সবসময় কৃষক এবং জনগণের পক্ষে ছিলেন, অন্যদিকে গোটাভায়া রাজাপাকসে ক্ষমতাসীন দল এসএলপিপির মূল সমর্থক এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চেয়ে দোদুল্যমান ভোট টানতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন।
মাহিন্দা রাজাপাকসে যে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছেন, তাতে হয়তো বিক্ষোভকারীরা খুশি, তবে গোটাভায়া রাজাপাকসেকেও ক্ষমতা থেকে তাড়াতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তবে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের সমর্থকরা এ রকম পদত্যাগের সম্ভাবনা নাকচ করে দিচ্ছেন।
‘বাইরে বিশৃঙ্খলা চলছে বলেই, হতে পারে এর যৌক্তিক কারণ আছে, আমরা সবাই তা মানছি-তার মানে এই নয় যে প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ করতে হবে’ বলছেন সাবেক গণমাধ্যমমন্ত্রী নালাকা গোডাহেওয়া।
যে ভোটারদের সমর্থনে ২০১৯ সালে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই সমর্থন হারানোর পর প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে এখন কি করবেন, তা স্পষ্ট নয়।
রাজাপাকসে নাকি তার ঘনিষ্ঠজনদের বলেছেন যে, তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে আগ্রহী নন, তবে দেশকে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে তিনি বের করে আনতে চান।
শ্রীলংকায় এখন রাজাপাকসেদের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে যে তীব্র ক্ষোভ, তাতে এই কাজ যে তিনি করতে পারবেন, সেই সুযোগ কম। তিনি যেরকম কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন, তাতে এ রকম আশংকা আছে, তিনি হয়তো ক্ষমতায় টিকে থাকতে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করতে পারেন।
অনেক বছর ধরে শ্রীলংকার সিংহলিদের মধ্যে রাজাপাকসেদের বিরাট জনপ্রিয়তা ছিল, যদিও তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন এবং গণমাধ্যমের ওপর মারাত্মক সব হামলার অভিযোগ ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিদের অনেকেই তখন এসব নিয়ে কথা বলেনি। কিন্তু এখন পুরো দেশ যখন সংকটে পড়েছে, তখন জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ সব জাতিগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। সিংহলি বিক্ষোভকারীরাও এখন সংখ্যালঘুদের অধিকারের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেছেন।
‘অর্থনৈতিক দুর্দশা আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকেই সংকটে ফেলেছে এবং হঠাৎ সবাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমার মনে হয়, রাজাপাকসে অনেক বছর ধরে অনেক কিছু থেকে পার পেয়ে গেলেও এবারের ক্ষোভের মাত্রা দেখে তারাও অবাক হয়েছে,’ বলছেন মানবাধিকার আইনজীবী ভবানী ফনসেকা।
তবে রাজাপাকসে সহজে ক্ষমতা ছেড়ে দেবে বলে মনে হয় না। তারা নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েই যে শুধু চিন্তিত তা নয়, নতুন কোন সরকার ক্ষমতায় এলে তখন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও তারা চিন্তিত।
একজন ঝানু বিরোধী নেতা রানিল বিক্রমাসিংহেকে যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে, তার পেছনে হয়তো এ রকম কোনো শংকাই কাজ করেছে। রাজাপাকসেদের সাথে রানিল বিক্রমাসিংহের বেশ ভালো সম্পর্ক।
তবে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে ক্ষমতা ধরে রাখতে এখন যেসব কূটকৌশল নিচ্ছেন, তাতে শ্রীলংকার অনেক মানুষ তাদের ধৈর্য হারাচ্ছেন। একটি স্থিতিশীল সরকার ছাড়া শ্রীলংকার পক্ষে আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে নতুন ঋণ পাওয়া বা বিদ্যমান ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা নতুন করে নির্ধারণ করা কঠিন হবে। নতুন সরকার যদি সেটা তাড়াতাড়ি না করতে পারে, তখন আরো বেশি বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি সংকট দেখা দেবে।
‘দেশ যারাই চালাক, আমাদের মানুষের মৌলিক চাহিদা তো মেটাতে হবে’, বলছেন কলম্বোর বাসিন্দা চান্দানি মানেল।
‘আমার দুটি বাচ্চা আছে, পরিবার আছে। রাজনীতিকদের তো সম্পদ আছে, তারা টিকে যাবেন। কিন্তু আমরা তো বাঁচবো না,’ বলছেন তিনি।
সূত্র : বিবিসি