আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২৩ মে, ২০২২ ০৯:৪৯ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫৬৪ বার
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব মারা গেছেন ৩০০ বছরেরও বেশি সময় আগে, কিন্তু তাকে নিয়ে ভারতে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে উত্তপ্ত বিতর্ক চলছে।
আওরঙ্গজেবকে বলা হয় ‘সর্বশেষ কার্যকর মুঘল সম্রাট’, যিনি ভারতকে ১৬৫৮ থেকে ১৭০৭ এই অর্ধ-শতাব্দী কাল ধরে শাসন করেছেন।
অন্যান্য মুঘল শাসকদের তুলনায় তার খুব একটা সুনাম ছিল না। তার প্রপিতামহ আকবরকে দেখা হয় একজন ধর্মনিরপেক্ষ শাসক হিসেবে, তার দাদা জাহাঙ্গীর শিল্প-সাহিত্যের প্রতি আগ্রহের কারণে পরিচিত ছিলেন এবং বাবা শাহজাহান ছিলেন একজন রোমান্টিক শাসক যিনি তার স্ত্রীর নামে তাজমহল নির্মাণ করেছেন।
কিন্তু ষষ্ঠ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। তিনি কঠোর শরিয়া আইন চালু করেছিলেন।
বলা হয়ে থাকে যে তিনি সঙ্গীতসহ অন্যান্য শিল্পকলাকে ঘৃণা করতেন এবং তিনি বেশ কয়েকটি মন্দির ধ্বংস করে ফেলারও নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এসবই ঘটেছে কয়েক শ’ বছর আগে। কিন্তু সম্প্রতি তার প্রতি যে ধরনের ঘৃণা দেখা যাচ্ছে সেটা নজিরবিহীন।
হিন্দুদের পবিত্র শহর বারাণসীতে জ্ঞানবাপী মসজিদকে কেন্দ্র করে বিতর্কের মধ্য দিয়ে এটা শুরু হয়।
এখন সোশাল মিডিয়াতে তাকে নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে আওরঙ্গজেবের জন্য মর্যাদাহানিকর হাজার হাজার রেফারেন্স, আদালতের ফাইলেও এসব পাওয়া যাচ্ছে এবং ভারতের বর্তমান হিন্দু জাতীয়তাবাদী শাসকরাও এসব বক্তব্য তুলে ধরছেন।
ডিসেম্বর মাসে বারাণসীতে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আওরঙ্গজেবের বিষয়ে কথা বলেছেন। গোঁড়ামির মাধ্যমে তিনি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চেষ্টা করেছেন বলে টুইট করেন প্রধানমন্ত্রী মোদি।
গত মাসেও শিখ গুরু তেগ বাহাদুরের ৪০০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি এই মুঘল সম্রাটের নাম উল্লেখ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, আওরঙ্গজেব আমাদের বিশ্বাসে নাড়া দিতে পারেননি।
তার এই মন্তব্যে ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলেন একজন কানাডীয়-আমেরিকান সাংবাদিক যিনি টুইটারে প্রশ্ন তুলেছিলেন ‘ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কেন ৩০০+ বছর আগে মারা যাওয়া একজন মুঘল সম্রাটকে আক্রমণ করে লম্বা বক্তৃতা দিচ্ছেন?’
বেশ কয়েকটি টুইটের মাধ্যমে ঐতিহাসিক অড্রে ট্রাশকি এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা বিশ্বাস করে যে ‘মুসলিমরা শত শত বছর ধরে হিন্দুদের পীড়িত করেছে, এবং একারণে আজকের দিনে অতীতের উচিত শাস্তি হিসেবে তাদেরও পীড়িত হতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান কালের মুসলিমদের ঘৃণা করা এবং তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা গ্রহণযোগ্য এই ইঙ্গিত দিতেই আওরঙ্গজেবের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে।’
টুইটারে এই আলোচনার পর আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে আরো অনেক ঘৃণা জমা হয়েছে।
আগ্রা শহরের মেয়র তাকে একজন ‘কসাই’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, সব জায়গা থেকে তার চিহ্ন মুছে ফেলতে হবে। টুইটারে মুঘল এই সম্রাটকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘একজন দখলদার’ হিসেবে যিনি হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চেয়েছিলেন।
একজন টুইটার ব্যবহারকারী এও বলেছেন হিন্দুদের পূজা করার জায়গায় মুঘলরা যেসব স্মৃতিস্তম্ভ এবং ভবন নির্মাণ করেছে সেগুলো বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলতে হবে।
ভারতের একজন আঞ্চলিক রাজনীতিবিদ আওরঙ্গজেবের সমাধির ‘অস্তিত্ব ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তার’ বিষয়ে প্রশ্ন তোলার পর পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রে তার সমাধিস্থল দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ওই নেতা আওরঙ্গজেবের সমাধি ধ্বংস করে ফেলারও আহ্বান জানিয়েছেন।
ইতিহাসবিদ, লেখক এবং আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাদিম রেজাভি বলেছেন, ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘু যারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হিন্দু জনরোষে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, তাদেরকে খারাপ হিসেবে তুলে ধরতে আওরঙ্গজেব ‘একটি সুবিধাজনক নামে’ পরিণত হয়েছে।
অধ্যাপক রেজাভি বলেন, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব হিন্দু মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সর্বোচ্চ পরিমাণে অনুদান দিয়েছেন, তার রক্তের দিক থেকেও তিনি নিজেও দুই-তৃতীয়াংশ হিন্দু ছিলেন কারণ তার প্রপিতামহ আকবর একজন রাজপুতকে (একটি হিন্দু সম্প্রদায়) বিয়ে করেছিলেন এবং তার শাসনামলে ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের মধ্যে আরো অনেক রাজপুত ছিলেন।
অধ্যাপক রেজাভি বলেন, আওরঙ্গজেব তার ব্যক্তিগত জীবনে মৌলবাদী ছিলেন না, যদিও এই ধারণাটি জনপ্রিয়, এবং বীণা বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন এবং অন্য যে কোন মুঘল শাসকের সময়ের তুলনায় তার অধীনেই সঙ্গীতের ওপর অনেক বেশি বই রচিত হয়েছে।’
তবে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক ব্যর্থতা ধামাচাপা দিতে এবং কর্তৃত্ব জোরালো করতে আওরঙ্গজেব ধর্মের আশ্রয় নিয়েছেন-যা অনেকটাই বর্তমান সময়ের ভারতীয় নেতাদের মতো। তবে প্রশ্ন হচ্ছে আওরঙ্গজেব যদি খারাপ ও দুষ্ট প্রকৃতির হন, আজকের দিনে কি আমাদেরকে তাকেও ছাড়িয়ে যেতে হবে?
‘আওরঙ্গজেব একজন স্বৈরশাসক এবং সম্রাট ছিলেন। যিনি ৩০০ বছর আগে বেঁচে ছিলেন। সে সময় আধুনিক গণতন্ত্র ছিল না, তাকে পরিচালনার জন্য কোনো সংবিধান ছিল না। কিন্তু এখন আমাদের ভারতীয় সংবিধান আছে এবং পার্লামেন্টের আইন আছে, তাহলে যেসব কাজ ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে করা হয়েছে সেগুলো এখন আমরা কিভাবে পুনরাবৃত্তি করতে পারি?’ প্রশ্ন করেন ড. রেজাভি।
তিনি বলেন, ‘কেউ যদি সপ্তদশ শতাব্দীর রাজনীতিকে আশকারা দেয়, তাহলে আওরঙ্গজেব সপ্তদশ শতাব্দীতে যেসব অপরাধ করেছিলেন, তারা এর চেয়েও আরো বড় অপরাধ করছে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি