ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

সরকারি চাকরি বাগাতে বয়স কারসাজি

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ২৩ জুলাই, ২০২২ ১১:১৯ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৩৮ বার


সরকারি চাকরি বাগাতে বয়স কারসাজি

৫৩ বছর বয়সে সরকারি চাকরিতে যোগদান! বিস্ময়ে হতবাক হওয়ার মতো এ তথ্যে যে কেউ ধাঁধায় পড়বেন। কারণ, যে বয়সে সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যায় মানুষ, তেমন সময় চাকরিতে যোগ দেওয়া কীভাবে সম্ভব?

নিয়মমাফিক এটা অসম্ভব হলেও কারসাজির মাধ্যমে অবিশ্বাস্য এই নজির সৃষ্টি করেছেন ময়মনসিংহের মো. আব্দুল কাদির নামের এক ব্যক্তি। শুধু কাদির নন, তার মতো আরও ১৬ জন বয়স কারসাজি করে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে এখনো আছেন বহাল তবিয়তে। জাতীয় পরিচয়পত্র গোপন রেখে নতুন করে জন্ম নিবন্ধন সনদে ১ থেকে ২৮ বছর বয়স কমিয়ে চাকরি বাগিয়েছেন তারা। ২০১৯ সালে চাঞ্চল্যকর এই নিয়োগ কেলেঙ্কারি ঘটেছে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক অফিসে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

দুদক সূত্র জানায়, এ ঘটনায় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন সাবেক পাঁচ কর্মকর্তাসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। কিন্তু অভিযুক্তদের প্রভাবে অনুসন্ধান কর্মকর্তার সুপারিশ আমলে না নিয়ে অভিযোগটি নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। এই নিষ্পত্তির অর্থ হচ্ছে-অভিযোগটি নথিভুক্ত করা অর্থাৎ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এখন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

কমিশনের এই সিদ্ধান্তের নৈতিকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এটাও এক ধরনের দুর্নীতি। কমিশন অনেক সময় দুর্নীতি প্রতিরোধ না করে দুর্নীতিবাজদের সুরক্ষা দেয়-এটা তার বড় প্রমাণ। দুদকের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রেষণে আসা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের হাতে জিম্মি। এ ধরনের সিদ্ধান্ত দুদকের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা বাড়িয়ে দেবে। দুদকের উচিত হবে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কিংবা অনুসন্ধানে প্রমাণিত দুর্নীতির বিষয়গুলো চেপে না গিয়ে দোষীদের আইনের মুখোমুখি দাঁড় করানোর ব্যবস্থা নেওয়া।

দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা আমি মনে করতে পারছি না। আসলেই এটা হয়েছে কি না, না জেনে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’ যদি নিষ্পত্তি হয়ে থাকে, তাহলে সেটা সমীচীন হয়েছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হলে কোন পরিপ্রেক্ষিতে হয়েছে, সেটা না দেখে কিছু বলা যাবে না।’

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ-কোনো যৌক্তিক কারণ না দেখিয়ে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে বিশেষ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের রক্ষায় একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য অভিযোগ নিষ্পত্তির মাধ্যমে পরিসমাপ্ত করা হয়েছে, যা কমিশন কর্মকর্তাদের শপথ ভঙ্গের শামিল।

মঙ্গলবার বিকালে মোবাইল ফোনে কল করে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে ময়মনসিংহের সাবেক জেলা প্রশাসক ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস (বর্তমানে যুগ্মসচিব) জানান, ‘নিয়োগ কমিটির সুপারিশ মোতাবেক তিনি চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগপত্র ইস্যু করেছেন। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের অর্থ লেনদেন হয়নি। কারণ, নিয়োগ কমিটির কর্মকর্তারা সবাই সৎ। তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ নেই।’

জন্ম নিবন্ধন সনদে বয়স যাই থাকুক, ৫৩ বছর বয়সের একজন প্রার্থীর নিয়োগ কমিটির সামনে বয়স লুকানোর সুযোগ আছে কি-এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি একটা মিটিংয়ে আছি। এখন বেশি কিছু বলতে পারব না। আর যদ্দূর শুনেছি অভিযোগটি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।’ তবে প্রভাব খাটিয়ে অভিযোগ নিষ্পত্তি করানোর কথা তিনি অস্বীকার করেন।

নিয়োগ কমিটির অন্যতম সদস্য ময়মনসিংহের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শেখ মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেনের (বর্তমানে উপসচিব, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ) কাছে নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

অনুসন্ধান প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালের ২৮ ও ২৯ অক্টোবর দুটি জাতীয় পত্রিকায় ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে অফিস সহায়ক, নিরপত্তা প্রহরী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।

অফিস সহায়ক পদে ৬ হাজার ৬৮৮, নিরাপত্তা প্রহরী পদে ১৪৫ ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে ১৪৬টি আবেদন জমা পড়ে। যাচাই-বাছাই কমিটি তিন পদে জমা হওয়া মোট ৬ হাজার ৯৭৮টি আবেদনের মধ্য থেকে ৩০১টি আবেদন বাতিল করে। ২০১৭ সালের ২৮ নভেম্বর নিয়োগ কমিটি গঠন করার পর তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. খলিলুর রহমান বদলি হন। ২০১৮ সালের ১২ মার্চ তার স্থলাভিষিক্ত হন ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস। আগের গঠন করা নিয়োগ কমিটির মাধ্যমেই তিনি এই নিয়োগ প্রক্রিয়া এগিয়ে নেন।

২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর নিয়োগ কমিটির সভার সিদ্ধান্তক্রমে জেলা ও উপজেলা কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগবিধি/১৯৮৬ মোবাবেক ৩৯ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। ওইদিনই নিয়োগ কর্তৃপক্ষ হিসাবে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস নিয়োগ কমিটির সুপারিশ অনুমোদন করে নিয়োগপত্র ইস্যু করেন। ৩৯ জনের মধ্যে ১৭ জন নিয়োগ কমিটির যোগসাজশে বয়স কারসাজির মাধ্যমে মোটা টাকা ঘুস দিয়ে চাকরি নেওয়ার অভিযোগ ওঠে।

জানা যায়, দুদক প্রধান কার্যালয়ের নথির (নম্বর ০০.০১.৬১০০.৬১৬.২৬.০০২.১৯) পরিপ্রেক্ষিতে এই অভিযোগের অনুসন্ধান করেন দুদক কর্মকর্তা সাধন চন্দ্র সূত্রধর। অনুসন্ধান শেষে নিয়োগ দুর্নীতির দায়ে ২৩ জনকে অভিযুক্ত করে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেন তিনি।

প্রতিবেদনে ময়মনসিংহের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শেখ মো. বেলায়েত হোসেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) এম রকিবুল হাসান, মাহমুদ হাসান, মো. তরিকুল ইসলাম ও জেলা প্রশাসন অফিসের তৎকালীন প্রশাসনিক কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান খানকে অভিযুক্ত করা হয়। অভিযুক্তের তালিকায় বয়স কারসাজি করে নিয়োগ পাওয়া ১৭ জনও আছেন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/১০৯ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলার সুপারিশ করা হয়।

অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ময়মনসিংহের সাবেক জেলা প্রশাসক সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাসসহ নিয়োগসংক্রান্ত কমিটির সদস্যরা যোগসাজশে লাভবান হওয়ার অসৎ উদ্দেশ্যে প্রতারণা ও অপরাধমূলক অসদাচরণের মাধ্যমে ৩০ বছরের অধিক বয়সের ১৭ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন। লাখ লাখ টাকার অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করে নিয়োগ কমিটি ১৭ প্রার্থীর জাতীয় পরিচয়পত্র আমলে না নিয়ে নতুন ইস্যু করা জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রাধান্য দিয়ে নিয়োগের সুপারিশ করেন। এতে নিয়োগ কমিটি প্রার্থীদের সরকারি বেতনভাতা উত্তোলন করে আত্মসাতে সহযোগিতা করেছেন।

অনুসন্ধান প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, জাতীয় পরিচয়পত্র থাকার পরও চাকরি পাওয়া ১৭ জন নতুন করে জন্ম নিবন্ধন সনদে ১ থেকে ২৮ বছর পর্যন্ত বয়স কমিয়েছেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন অফিস থেকে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের বয়স পরিবর্তন করা হয়নি। তাদের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্রের চেয়ে ৫ বছর কমিয়ে অফিস সহায়ক পদে নিয়োগ পেয়েছেন মো. বাবুল হোসেন ও মো. আব্দুস সাত্তার।

৮ ও ৪ বছর কমিয়ে একই পদে নিয়োগ পেয়েছেন যথাক্রমে মো. শহিদুল ইসলাম ও মাহমুদ আল ফয়সাল তামিম। একই পদে শিহাব হোসেন মানিক ১ বছর, শামসুল আলম ১১ বছর, মো. ওবায়দুর রহমান ৭ বছর, আবুল কাশেম ২২ বছর, জোবায়ের আলম খান ৩ বছর, ওমর ফারুক ১১ বছর, একাব্বর হোসেন আকন্দ ১০ বছর করে বয়স কমিয়ে চাকরি বাগিয়েছেন।

তবে ২৮ ও ২০ বছর করে বয়স কমিয়ে এই পদে চাকরি বাগিয়ে নজির স্থাপন করেছেন যথাক্রমে মো. আব্দুল কাদির ও মো. আকরাম হোসেন। আব্দুল কাদিরের জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্ম তারিখ ১৯৬৫ সালের ১ অক্টোবর। জন্ম নিবন্ধনে জন্ম তারিখ দেওয়া হয়েছে ১৯৯৩ সালের ৩০ নভেম্বর। আর আকরাম হোসেনের জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্ম তারিখ ১৯৬৯ সালের ১ মার্চ। জন্ম নিবন্ধন সনদে তিনি জন্ম তারিখ দিয়েছেন ১৯৮৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর। নিরাপত্তা প্রহরী পদে রুহুল আমিন ৪ বছর, আব্দুল মান্নান ৯ বছর, আব্দুল কাদের জিলানি ৩ বছর করে কমিয়ে চাকরি নিয়েছেন। আর ৬ বছর বয়স কমিয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে চাকরি নিশ্চিত করেছেন লক্ষ্মী রাণী দাস।

বয়স কারসাজি করে চাকরি পাওয়া একজনের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন এদেশটা হলো চোরের খনি। কথা ঠিক। তা না হলে ২৮ বছর, ২২ বছর, ২০ বছর, ১০ বছর লুকিয়ে কেউ সরকারি চাকরি নিতে পারে। যে যেভাবে পেরেছে চাকরি নিয়েছে। এজন্য টাকা খরচ করতে হয়েছে।’ দুদকের অনুসন্ধান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যতদূর শুনেছি ডিসি স্যাররা সব ম্যানেজ করেছে। দুদক আমাদের পক্ষে রিপোর্ট দিয়েছে। আমরা সবাই নির্বিঘ্নে চাকরি করছি। বেতনভাতাও পাচ্ছি।’

যুগান্তর


   আরও সংবাদ