ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

আমদানির আড়ালে টাকা পাচার

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ৫ অগাস্ট, ২০২২ ১৪:০৬ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৩৩৮ বার


আমদানির আড়ালে টাকা পাচার

শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির আড়ালে দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। গত অর্থবছরে বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি রেকর্ড হারে বেড়েছে। করোনার সময় বিশ্ব যখন অচল ছিল, তখনও এসব আমদানি হয়েছে।

করোনার আগেও অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে। কিন্তু যে হারে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে, ওই হারে নতুন শিল্পের প্রসার ঘটেনি। শিল্পের উৎপাদনেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির আড়ালে দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। তারা এসব আমদানির বিপরীতে ব্যাপকভিত্তিক তদন্ত করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে প্রস্তাব দিয়েছেন।

এর আগেও শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির নামে টাকা পাচারের অভিযোগ উঠেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করে বেশকিছু প্রমাণও পেয়েছিল। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বাংলাদেশ থেকে আমদানির আড়ালে টাকা পাচার হচ্ছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরে ৫৭২ কোটি ডলারের শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে। এলসি খোলা হয়েছে ৬৪৬ কোটি ডলারের। এলসির বাকি পণ্য আমদানির অপেক্ষায় রয়েছে।

একই সঙ্গে অনিষ্পন্ন এলসি বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরে ৫২৭ কোটি ডলারের এলসি অনিষ্পন্ন হয়েছে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৩৭৪ কোটি ডলার। অনিষ্পন্ন এলসি বেড়েছে প্রায় ৩৯ শতাংশ। 

জানা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে করোনার কারণে লকডাউন ছিল। সেপ্টেম্বরের পরও অনেক দেশে করোনার প্রকোপ ছিল। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করলে বৈশ্বিক পরিস্থিতি আবার অস্থির হয়ে ওঠে, যা বছরজুড়ে অব্যাহত ছিল।

এছাড়া চলতি বছরের শুরু থেকে ডলারের দাম বাড়ছিল। গত এপ্রিলে এসে তা প্রকট আকার ধারণ করে। ওই সময়ে উদ্যোক্তারা এক ধরনের অনিশ্চয়তায় ছিলেন। নতুন কোনো শিল্পোদ্যোগ বাস্তবায়ন কাজে হাত দেননি।

উলটো আগের যেসব প্রকল্প ছিল, সেগুলোর কার্যক্রমও স্থগিত রেখেছিলেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, এত শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি হলো, সেগুলো কোথায় গেল?

করোনার সময় বিশ্ব যথন একেবারে স্থবির ছিল, তখনও শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে ৩৭৪ কোটি ডলারের, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ কম ছিল।

২০১৯-২০ অর্থবছরও ৩৭৪ কোটি ডলারের যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে সাড়ে ৮ শতাংশ কম ছিল। অর্থনীতিবিদরা প্রশ্ন তুলেছেন, করোনার সময় বিশ্ব মন্দা এবং দেশেও অনিশ্চয়তা বিরাজমান ছিল। এর মধ্যে কীভাবে নতুন শিল্প স্থাপনের উদ্যোগী হয়েছেন? 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে ৪৮৫ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় সাড়ে ৩৭ শতাংশ বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৫১৬ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে সোয়া ৬ শতাংশ বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৪৭৪ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে সাড়ে ৯ শতাংশ কম। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ওই সময়ে তৈরি পোশাক, বস্ত্র খাত ও অন্যান্য শিল্পের যন্ত্রপাতি বেশি এসেছে। কিন্তু আলোচ্য সময়ে দেশে গার্মেন্ট শিল্পের সংখ্যা কমেছে। বস্ত্র শিল্প বাড়েনি। অন্যান্য শিল্প খাতে দারুণ মন্দা চলছে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অনেকদিন ধরেই বলা হচ্ছে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির নামে দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে।

যেভাবে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি হচ্ছে, এর ইতিবাচক প্রভাব শিল্প খাতে পড়ছে না। শিল্পের সংখ্যা যেমন বাড়ছে না, তেমনই বাড়ছে না উৎপাদন ও কর্মসংস্থান। এখন আবার বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে। এগুলো তদন্ত করে দেখা উচিত। 

সূত্র জানায়, এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক গোয়েন্দা তদন্ত অধিদপ্তর থেকে তদন্ত হয়েছে। এসব তদন্তে শিল্পের যন্ত্রপাতিভর্তি কনটেইনারে পাওয়া গেছে ছাই, ইট, বালি, পাথর ও সিমেন্টের ব্লক। শিল্পের কোনো যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়নি। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে একটি সরকারি ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির নামে টাকা পাচারের ঘটনা ধরা পড়েছে।

ওইসব ব্যাংকের কিছু শাখায় শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খুলে বিদেশে অর্থ পাঠানো হয়েছে। বাস্তবে কোনো যন্ত্রপাতি আসেনি। অনেক এলসি অনিষ্পন্ন রয়েছে। ফিয়াজ এন্টারপ্রাইজ, অ্যাগ্রি ইকোনমি, গ্রাডেনিয়া করপোরেশন, ইন্ট্রাসেক্স টেক্সটাইল, অ্যাগ্রো বিডি, এবি করপোরেশন, এসআর মেটাল-এসব প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এসেছে।

এর মধ্যে বেসিক ব্যাংক থেকে ১৭৫ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। কমার্স ব্যাংক থেকেও টাকা পাচারের তথ্য উঠে এসেছে। একটি শিল্পগ্রুপ সরকারি একটি ব্যাংকে ৩৬ লাখ ডলারের শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খুলে তা দেশে আনেনি। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে শিল্পের যন্ত্রপাতির ঘোষিত কনটেইনারে কিছুই পাওয়া যায়নি। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বৈশ্বিক ও দেশীয় মন্দায় এখন সবাই টিকে থাকার সংগ্রামে ব্যস্ত। এর মধ্যে কেউ শিল্প স্থাপন করবেন কীভাবে?

শিল্পের যন্ত্রপাতির মূল্য অনেক। ফলে এর মাধ্যমে টাকা পাচার করলে বেশি করা যায়। মূলত এ কারণেই পাচারকারীরা এ পথ বেছে নেয়। এর সঙ্গে দেশি-বিদেশি চক্র জড়িত। বিষয়টি নিয়ে একটি বড় সমীক্ষা হওয়া জরুরি। তাহলে শিল্পের গতিবিধি সম্পর্কে জানা যাবে। 

জিএফআই-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার বা ৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। গড়ে প্রতিবছর পাচার হচ্ছে ৭৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের ১৮ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে পাচার হচ্ছে। 

বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, করোনা ও যুদ্ধের কারণে এখন উদ্যোক্তারা যেগুলো আছে সেগুলোই সচল রাখছেন।

নতুন বিনিয়োগে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। তবে কিছু প্রতিষ্ঠান আগের কারখানার সংস্কার করছে। যে কারণে কিছু যন্ত্রপাতি আমদানি হচ্ছে। তবে তা খুবই কম। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ডলারের দাম যেভাবে বেড়েছে, তাতে তো এলসি খোলাই যাচ্ছে না। 

সূত্র জানায়, শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানিতে ন্যূনতম করহার অনেক কম। গড়ে ১ শতাংশ। এছাড়া এসব পণ্য বেশি অর্থেও এলসি খোলা যায়। যে কারণে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির নামে টাকা পাচার বেশি হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে শিল্প খাতে ঋণের প্রবাহ খুব বেশি বাড়েনি। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের চেয়ে মেয়াদি ঋণ বিতরণ কমেছে।

গত অর্থবছরে সামান্য বাড়লেও মূল্যস্ফীতির হিসাব বাদ দিলে তা খুবই কম। এদিকে শিল্প উৎপাদনও বাড়েনি। বস্ত্র খাতে গত অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত আগের অর্থবছরের তুলনায় কমেছে। তবে চামড়া খাতে উৎপাদন কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু চামড়া শিল্পের সংখ্যা বাড়েনি।


   আরও সংবাদ