ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৭ জানুয়ারী, ২০২৩ ১১:০২ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৩২৬ বার
একসময় উন্নত চিকিৎসা মানেই ছিল বিদেশযাত্রা। ক্যানসার-হৃদরোগের মতো রোগে মৃত্যুর ঘটনা ঘটতো হরহামেশা। কিন্তু বিগত এক যুগে বদলে গেছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত।
টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের ১৪ বছরের শাসনকাল পূর্ণ হলো। শত অর্জনের মধ্যে বর্তমান সরকারের অন্যতম অর্জন স্বাস্থ্যখাতে আমূল পরিবর্তন। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতকে এমনভাবে ঢেলে সাজানো হয়েছে যাতে নিঃসন্দেহে বলা যায়, এদেশের স্বাস্থ্যখাত এখন আন্তর্জাতিক মানের।
চৌদ্দ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ সময় সংবাদকে বলেন, একটি দেশের স্বাস্থ্যখাতের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ইনডেক্স হচ্ছে মাতৃমৃত্যুর হার, শিশু মৃত্যুর হার ও গড় আয়ু। বিগত সব সময়ের তুলনায় তিনটা খাতেই বাংলাদেশ এখন ভালো অবস্থানে আছে।
এছাড়া স্বাস্থ্যখাতের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে আবদুল হামিদ বলেন, দেশে মেডিকেল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, আঞ্চলিকভাবে গড়ে উঠেছে কমিউনিটি ক্লিনিক, ডাক্তার-নার্সের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, গ্যাস্ট্রোলিভার ও নিউরোসাইন্সের মতো কয়েকটি স্পেশালাইজড হাসপাতাল হয়েছে। এছাড়া করোনাকালে টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশের সাফল্য সন্তোষজনক।
শক্তহাতে করোনা সামাল
করোনা মহামারিতে যখন সারা পৃথিবী পর্যদুস্ত তখন বাংলাদেশ বেশ শক্ত হাতেই সামাল দিয়েছে এ মহামারি। করোনা সামাল দেয়ার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ও বিশ্বে পঞ্চম। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ যাদের স্বাস্থ্যখাতে অবকাঠামো, লোকবল ও প্রযুক্তি বাংলাদেশের থেকেও বেশি তারাও এতকিছু নিয়ে বাংলাদেশের থেকে পিছিয়ে আছে।
অন্যদিকে করোনা টিকাদানে যেখানে যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশে সাফল্যের হার ৫০-৬০ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশের সাফল্যের হার ৯৮ শতাংশ বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গত বছর জুন মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ টিকাদানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে দেশের ৮০ শতাংশেরও বেশি মানুষ টিকার আওতায় এসেছে। মাত্র পাঁচ মাসে বাংলাদেশ টিকা তৈরি না করেও ক্রয় করা টিকা দিয়ে এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে বিশ্বদরবারে কামিয়েছে অঢেল প্রশংসা।
নতুন রূপে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
পঁচিশ বছরের পুরনো বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এক যুগে হয়েছে আরও স্বনির্ভর ও আধুনিক। এখানেই চালু হতে যাচ্ছে ৭৫০ শয্যা বিশিষ্ট দেশের প্রথম সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল। এ হাসপাতালে জটিল সব অস্ত্রোপচার থেকে শুরু করে দেয়া হবে উন্নত সব আধুনিক চিকিৎসা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া অধিকাংশ মানুষই এখন তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে পারবে দেশের মাটিতে। ইতোমধ্যে যারা উন্নত চিকিৎসা দিবেন এমন মেধাবী চিকিৎসক ও নার্সদের দক্ষিণ কোরিয়া থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছে। কেবল চিকিৎসা নয় গবেষণা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও থাকবে এ হাসপাতালে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ৬টি বিশেষায়িত সেন্টারের মাধ্যমে চলবে হাসপাতালের কার্যক্রম। শুরুর দিকে সেন্টারে ২ বছরের জন্য নিয়োজিত থাকবেন ৬ জন কোরিয়ান ইঞ্জিনিয়ার ও ৫০ জন কোরিয়ান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। এতে করে দেশের চিকিৎসকরা পাবেন হাতে কলমে আধুনিক প্রশিক্ষণ আর রোগিদের মিলবে উন্নতমানের সেবা।
দুটি বেসমেন্টসহ ১৩ তলা ভবনের এ হাসপাতালে থাকছে ১৪টি অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার, ১০০ শয্যার আইসিইউ ও জরুরি বিভাগের সিট, ৬ টি ভিভিআইপি কেবিন, ২২টি ভিআইপি কেবিন ও ২৫টি ডিল্যাক্স শয্যা।
শুরুর দিকে এখানে থাকছে স্পেশালাইজড অটিজম সেন্টার, মেটারনাল অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ কেয়ার সেন্টার, ইমার্জেন্সি মেডিকেল কেয়ার সেন্টার, হেপাটোবিলিয়ারি ও গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি সেন্টার, কার্ডিও ও সেরিব্রো ভাসকুলার সেন্টার এবং কিডনি সেন্টার। দ্বিতীয় পর্যায়ে থাকবে রেসপিরেটরি মেডিসিন সেন্টার, জেনারেল সার্জারি সেন্টার, অপথালমোলজি, ডেন্টিস্ট্রি, ডার্মাটোলজি সেন্টার এবং ফিজিক্যাল মেডিসিন বা রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার।
অত্যাধুনিক চিকিৎসার মধ্যে এখানে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন, রোবোটিক অপারেশন ও জিন থেরাপির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
কল্যাণময়ীররূপে কমিউনিটির ক্লিনিক
এক সময়ে সাধারণ কলেরা-ডায়রিয়াতেও প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে প্রাণ হারানোর মতো বিষয়টি ছিল নিছক আটপৌড়ে ঘটনা। বহুকাল ধরে গ্রামের মানুষ রোগে ভুগে এক রকমের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেছে। ডাক্তার দেখাতে হলে হয় তাদেরকে যেতে হতো শহরে, নয়তো গ্রাম্য হাতুড়ে ডাক্তারের হাতে নিজের জীবনে সপে দিতে হতো বাধ্য হয়ে।
গ্রামের এমন অসহায় মানুষদের জীবনে আশার প্রদীপ হয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক। মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের পাশাপাশি প্রায় সব ধরনের রোগিদের নীরবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে এ কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এ প্রকল্পের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন স্বাস্থ্যসেবা।
যেখানে একসময় বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হতো না, সেখানেই সেই বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিক নিয়ে 'কমিউনিটি ক্লিনিক: হেলথ রেভ্যুলেশন ইন বাংলাদেশ' নামে আলাদা বই লিখেছে ডব্লিউএইচও। গ্রামে প্রতি ৬ হাজার মানুষের জন্য রয়েছে একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক। শুরুতে ৫ শতাংশ জায়গার ওপরে নির্মিত হলেও এখন ৮ শতাংশ জায়গা জুড়ে অনেক গ্রামেই সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে স্বাস্থ্যসেবার আশীর্বাদ কমিউনিটি ক্লিনিক।
প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে রয়েছে চারটি করে রুম। দুটি রুম স্বাস্থ্যকর্মীদের বসা ও রোগীকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য। বাকি একটি ওয়েটিং রুম ও অন্যটি প্রসূতি মায়েদের জন্য ডেলিভারি রুম। প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারের অধীনে কাজ করেন তিনজন সেবাকর্মী। প্রতিবছর দেশের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে সরকার ২৫০ কোটি টাকা মূল্যমানের ওষুধ সরবরাহ করে থাকে। সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটি ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯ টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত সেবা দিয়ে থাকে কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীরা।
ওষুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ
জাতিসংঘের শিক্ষা ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে ওষুধ রফতানির শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। এখন নিজ দেশেই উৎপাদিত ওষুধ নিয়ে ৯৭ শতাংশ চাহিদা মেটানো হচ্ছে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বহির্বিশ্বে ওষুধ রফতানি করে নিজেদের শক্তিমত্তা জানান দিচ্ছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে বাংলাদেশের ওষুধের একটি অংশ রফতানি হচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকায়। এছাড়া নেপাল, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা ও আফ্রিকার দেশগুলোতে ওষুধ রফতানি করছে বাংলাদেশ।
হেলথ ওয়াচের তথ্যমতে, ১৯৭২ সালে সদ্য জন্ম নেয়া বাংলাদেশের ওষুধের বাজার ছিল মাত্র ১০০ কোটি টাকার। ৯০ শতাংশ ওষুধের চাহিদা মিটতো আমদানির মাধ্যমে। তখন বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানি ছিল মাত্র দুটি যা বর্তমানে বেড়ে ২১৪টিতে এসে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবছর দেশে ৩০ হাজারেও বেশি প্রকারের অ্যালোপ্যাথি ওষুধ তৈরি হচ্ছে। ২০১২ সালেও ওষুধের বাজার ছিল ৯ হাজার কোটি টাকার যা বর্তমানে বেড়ে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি হয়েছে। দেশের রফতানি আয়ের তৃতীয় বৃহত্তম খাত এখন ওষুধশিল্প।
স্পেশালাইজড হাসপাতালের জাদুর কাঠি
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চক্ষু ইনস্টিটিউট, গ্যাস্ট্রোলিভার, ক্যানসার ও নিউরোসাইন্সের মতো অনেকগুলো স্পেশাইলজড হাসপাতাল গড়ে উঠেছে বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে। এসব স্পেশালাইজড হাসপাতালের খরচ ও সুবিধা যথেষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা সাধারণ মানুষকে দিচ্ছে নানা রকমের সুবিধা।
বিশেষ করে ২৫০ শয্যার জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ১০ টাকায় মিলছে বিশ্বমানের চক্ষুসেবা। যেখানে বর্তমান বাজারে ১০ টাকায় কোনো ধরনের সেবা পাওয়া যায় এটা অকল্পনীয় সেখানে নিভৃতে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন হাসপাতালটির বিশেষজ্ঞরা। বেসরকারি হাসপাতালে যেসব জটিল চোখের অপারেশনে ২-৩ লাখ টাকা খরচ হয়, এখানে সেসব অপারেশন হয়ে থাকে এক রকেমের বিনামূল্যে। হাসপাতালটিতে ১২টি অপারেশন থিয়েটারে ৭ ধরনের চোখের অপারেশন হয়ে থাকে। প্রতিদিন হাসপাতালটিতে প্রায় ৮০টি নানা ধরনের অপারেশন হয়ে থাকে। বর্তমানে হাসপাতালটিতে ক্যাটারাক্ট, কর্নিয়া, গ্লুকোমা, রেটিনা, অকুলোপ্লাস্টিক, পেডিয়াট্রিক অপথোমোলজি, নিউরো অপথোমোলজি, কমিউনিটি অপথোমোলজি ও লোভিশনের মতো ৯টি বিভাগ চালু রয়েছে।
এছাড়া পরিপাকতন্ত্র, লিভার ও প্যানক্রিয়াসজনিত গ্যাস্ট্রো ইন্টেসটাইনাল রোগিদের জন্য মহাখালিতে ২ একর জমির ওপরে নির্মিত হয়েছে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল। যেখানে প্রতি ১০ হাজার জনগোষ্ঠীর জন্য কমপক্ষে একজন গ্যাস্ট্রো ইন্টেসটাইনাল বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন, সেখানে ৩০ লাখ মানুষের বিপরীতে গ্যাস্ট্রো ইন্টেসটাইনাল বিশেষজ্ঞ ছিল মাত্র একজন। এদেশের মানুষের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হলেই আন্দাজে ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা অনেক দিনের। এতে করে দিনকে দিন তারা নিজেদের অজান্তেই লিভার, কিডনি ও হৃদপিন্ডের রোগের মতো জটিল সব সমস্যা বাধিয়ে বসেন। এসব রোগিদের প্রয়োজনীয় সেবা দিতে হাসপাতালটি এখন এক রকমের আশীর্বাদস্বরূপ।
শুক্রবার (৬ জানুয়ারি) দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী তার দেয়া ভাষণের শেষ দিকে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার কয়েকটি লাইন আবৃত্তি করেন। প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে সুকান্তের, ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার' কবিতার লাইনগুলো থেকে এটাই প্রমাণ হয় চৌদ্দ বছরে স্বাস্থ্যখাত থেকে শুরু করে নানা খাতে আওয়ামী লীগের করা কাজগুলোর সুফল দেশের মানুষ ভোগ করবে যুগ যুগ ধরে। আগামী প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশ হবে এক স্বপ্নপুরীর নাম যার প্রধান কারিগরদের একজন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।