ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল, ২০২৩ ১০:১০ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫৬২ বার
তাপদাহে পুড়ছে গোটা দেশ। ৫৮ বছরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ছাড়িয়েছে। তীব্র গরমে নাকাল জনজীবন। ঘরে কিংবা বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই। মৌসুমি জ্বর, সর্দি-কাশি, ডায়রিয়া, জন্ডিস, হিটস্ট্রোক, শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনি, পেটের সমস্যা, সর্দি-জ্বর, হাঁপানি, গ্যাসের সমস্যা, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, ত্বকের সমস্যা ও নানা ধরনের অ্যালার্জিতে আক্রান্ত রোগী বাড়ছে। ফলে রোগীর ভিড় বেড়েছে রাজধানীসহ সারা দেশের হাসপাতালে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, হিটস্ট্রোকসহ তাপদাহের কারণে সৃষ্ট অন্যান্য রোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ। হাসপাতালের তথ্য বলছে, গরমে সবচেয়ে বেশি অসুস্থ হচ্ছে বৃদ্ধ, প্রসূতি নারী ও শিশু। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের গরমে ভিন্নমাত্রা রয়েছে।
বাতাসের আর্দ্রতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম। তাই তাপদাহের মধ্যে ঠোঁট শুকিয়ে ও ফেটে যাচ্ছে। বাতাসের জলীয়বাষ্প কম থাকায় মূলত এমন হচ্ছে। গরমে অতিরিক্ত ঘামলে শরীর ডিহাইড্রেড হয়ে পড়ে। এর ফলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়ে তারা বলেন, এ ছাড়া রোজায় দীর্ঘসময় পানি না খাওয়া অবস্থায় প্রচুর ঘাম হলে শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি হতে পারে। তাই বেশি বেশি বিশুদ্ধ পানি পান করা, ফলমূলের শরবত পান, পচা-বাসি ও বাইরের খাবার না খাওয়া এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়ার পরামর্শও দেন বিশেষজ্ঞরা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে তীব্র তাপদাহে সারা দেশ থেকেই ডায়রিয়ার রোগী আসছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি)। গতকাল দুপুর পর্যন্তও ২৮৫ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। ডায়রিয়া শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। তবে এ পর্যন্ত হাসপাতালটিতে ডায়রিয়ায় কোনো রোগীর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। আইসিডিডিআরবি,র সিনিয়র ম্যানেজার (ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশন) এ কে এম তারিফুল ইসলাম খান বলেন, গত এক সপ্তাহে কলেরা হাসপাতালে তিন হাজার ৩৮৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। তার মধ্যে গতকাল সকাল থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ২৮৫ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়েছেন। তার আগের দিন ৫২২ জন রোগী, ১৫ এপ্রিল ৫৬৫ জন, ১৪ এপ্রিল ৫৩০ জন রোগী ভর্তি হয়। তার আগের দিন ৫১৫ ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হন। ১২ এপ্রিল ৪৯১ জন রোগী এবং গত ১১ এপ্রিল ৪৮৪ জন ডায়রিয়া রোগী রাজধানীর মহাখালী কলেরা হাসপাতালে ভর্তি হন। তিনি বলেন, গতকাল দুপুর পর্যন্ত রোগী ভর্তি কমেছে। তার মানে এই নয় যে, ডায়রিয়ার প্রকোপ কমে গেছে। ঈদ সামনে থাকায় অনেক মানুষ রাজধানী ছেড়ে গ্রামে গেছে।
এদিকে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে রোগীর চাপ গত কয়েক দিনে বেড়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রোজার কারণে
স্কুল-কলেজ বন্ধ। তবু প্রচণ্ড গরমে শিশুদের সর্দি, জ্বর-কাশি বেশি হচ্ছে। টাইফয়েড ও পানিবাহিত হেপাটাইটিস, জন্ডিসের প্রবণতা বেড়েছে। প্রতিদিন গড়ে এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ রোগী হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছে। স্কুল বন্ধ, তাই বেশিরভাগ শিশু বাসায়ই থাকছে। তবু এসব রোগ বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, সম্প্রতি গরম বেড়েছে। বাচ্চাদের পানিশূন্যতা, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, মৌসুমি জ্বর, সর্দি-কাশি, জন্ডিস ও টাইফয়েড আক্রান্তের হার অন্য সময়ের চেয়ে বেড়েছে। এর কারণ বাইরের ভাজা-পোড়া খাবার পেটের পীড়াজনিত রোগ সৃষ্টি করে।
তিনি বলেন, গরমের দিনে বাচ্চাদের বারবার বিশুদ্ধ খাবার পানি দিতে হয়। তরল খাবার, মৌসুমি ফলমূল খাওয়াতে হবে। মৌসুমি জ্বর সাধারণ প্যারাসিটামলে সেড়ে যায়। এ জন্য
দু-একদিন অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু গ্রাম থেকে শহরে সবখানে
মুড়ি-মুড়কির মতো অ্যান্টিবায়েটিক কিনে খাচ্ছে। কোনো অবস্থাতেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়েটিক ওষুধ কিনে খাওয়া যাবে না।
ডা. কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, প্রতিদিন গড়ে এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ রোগী শিশু হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসছে। তার মধ্যে মৌসুমি জ্বর, ডায়রিয়া, বমি, নিউমোনিয়া রোগী সবচেয়ে বেশি।
গরমে সুস্থ থাকার উপায় ও হিটস্ট্রোক থেকে বাঁচতে পরামর্শ দিয়েছেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ। তিনি কালবেলাকে বলেন, প্রচণ্ড গরমে মানুষের বিভিন্ন ধরনের অসুখ,
সর্দি-কাশি, জ্বরও হচ্ছে। এর সঙ্গে প্রচণ্ড গরমে হিটস্ট্রোকের ঝুঁকিও যুক্ত হয়েছে। যেসব বয়স্ক মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত, তাদের হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস রোগীদের বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এসব রোগীর হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। প্রচণ্ড গরমে মানুষের শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে প্রবল। এ অবস্থায় শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে হিটস্ট্রোক হয়। যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া তাদের বাইরে বের না হওয়াই ভালো। আর বাইরে যদি যেতেই হয় তাহলে আঁটসাঁট পোশাক এড়িয়ে চলতে হবে এবং ঢিলেঢালা কাপড় পরা ভালো। এ ছাড়াও বাইরে গেলে ছাতা, টুপি, ক্যাপ ব্যবহার করতে হবে এবং পানির বোতল রাখতে হবে। আর যারা কায়িক পরিশ্রম করেন কিংবা রিকশা শ্রমিক বা অন্যান্য কাজের সঙ্গে জড়িত, তারা যেন মাঝে মাঝে কাজের ফাঁকে ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন এবং বেশি করে পানি পান করেন।
তিনি বলেন, যদি কেউ হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। আর হিটস্ট্রোক হলে মাথা ঝিমঝিম করে, বমি বমি ভাব হয়, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি, শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনি পেটের সমস্যা, জ্বর, হাঁপানির সমস্যা হয়। আশপাশে কেউ হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হলে যত দ্রুত সম্ভব ছায়াযুক্ত স্থানে নিতে হবে। ঘরে থাকলে ফ্যান ও এসি চালু করে তাকে ঠান্ডা স্থানে রাখতে হবে। ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে। অজ্ঞান হয়ে পড়লে বিলম্ব না করে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। শিশু ও বৃদ্ধদের অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা অন্যদের চেয়ে বেশি। তাই তাদেরও নিরাপদে রাখতে হবে।
প্রখ্যাত চিকিৎসক বলেন, তীব্র গরমে রোজাদারদের দেখা দিতে পারে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা। তাদের মেজাজ খিটখিটে হয়, রাগ বেড়ে যায়। এ ছাড়া যাদের ব্লাড প্রেশার রয়েছে তীব্র গরমে তাদের মানসিক চাপ বেড়ে যায়।
সর্দি-কাশি, জ্বর, অ্যাসিডিটিসহ হার্ট অ্যাটাকেরও আশঙ্কা বেড়ে যেতে পারে। তাই গরমে সুস্থ থাকতে রোজাদারদের ইফতারের সময় সঠিক খাবার গ্রহণ করতে হবে। খেতে হবে এমন সব খাবার, যা সহজে হজম হয় ও যাতে পানির পরিমাণ বেশি রয়েছে। আর তৈলাক্ত খাবার, ভাজা-পোড়া খাবার এড়িয়ে চলতে হবে এবং প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। ডিহাইড্রেশন থেকে প্রচুর ঘাম ঝরে। তাই ফলের শরবত, ডাবের পানি, লেবুর শরবত, স্যালাইন, গ্লুকোজ এবং পুষ্টিকর রসালো ফল বেশি করে খেতে হবে। এতে শরীর থেকে ঘাম হয়ে বের হয়ে যাওয়ায় পানির চাহিদা পূরণ হবে। এক্ষেত্রে কোনো অবস্থাতেই রাস্তার খোলামেলা খাবার খাওয়া যাবে না। বাইরের শরবত এড়িয়ে চলতে হবে। এসব শরবতে ডায়রিয়া, জন্ডিস ও টাইফয়েডের জীবাণু থাকে।