ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৫ মে, ২০২৩ ০৯:৫১ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৩৭৮ বার
বৈশাখের ঝড়-বৃষ্টির সঙ্গে রাজধানীতে বাড়ছে এডিস মশার প্রকোপ। চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু। ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্ক। হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর ভিড়। প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুম এলেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এ বছরও এডিস মশার প্রকোপ বাড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এরই মধ্যে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, বছরের শুরু থেকেই মশা মারতে কাজ করছেন তারা। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে প্রচারও চলছে। এ বছর মশা মারতে উত্তর সিটি কর্মপরিকল্পনায় পরিবর্তন আনলেও দক্ষিণ সিটির কার্যক্রম চলছে আগের মতোই।
সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১১ মে পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ১ হাজার ১৯১ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ৬৭৮ জন ও ঢাকার বাইরের ৫১৩ জন। চিকিৎসা শেষে ১ হাজার ৮২ জন হাসপাতাল ছেড়েছেন।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি ও এডিস মশার ঘনত্ব বুঝতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তিনটি সার্ভে করা হয়—বর্ষা-পূর্ববর্তী, বর্ষাকাল ও বর্ষা-পরবর্তী মৌসুম। এপ্রিলের শেষ ও মে মাসটাকে ধরা হয় বর্ষা-পূর্ববর্তী, জুন ও জুলাইকে ধরা হয় বর্ষা মৌসুম এবং আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসকে ধরা হয় বর্ষা-পরবর্তী মৌসুম। সারা দেশে মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে প্রথম আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয় ৯ এপ্রিল। ওই সভায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছিলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সারা বছর কার্যক্রম চলবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রতি ১০০ বাড়ির মধ্যে চারটিতে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে ১২ নম্বর ওয়ার্ড, সেখানে মশার ঘনত্ব বা ব্রুটো ইনডেক্স ২৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ। গত ২৬ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯৮টি ওয়ার্ডে এ জরিপ চালানো হয়। এর মধ্যে উত্তর সিটির ৪০টি এবং দক্ষিণ সিটির ৫৮টি ওয়ার্ডের ৩ হাজার ১৫০টি বাড়িতে জরিপ করা হয়। জরিপে ১২৭টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়, যা ৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ৪০টি ওয়ার্ড পরিদর্শন করে পাঁচটি ওয়ার্ডকে মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে। অপেক্ষাকৃত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ৩, ২৩, ২৬ ও ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড। দক্ষিণ সিটিতে ৪ দশমিক ১৮ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ৫৮টি ওয়ার্ড পরিদর্শন করে ১৩টি ওয়ার্ডকে মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে। চারটি ওয়ার্ড অপেক্ষাকৃত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সেগুলো হলো ২, ১২, ১৬ ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ড।
মশা নিধনে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে শুধু কীটনাশকের জন্য ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে যা ছিল ২২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া এবার মশক নিধনে ফগার, হুইল ও স্প্রে মেশিনের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অন্য দিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। সেখানে মশার ওষুধ বাবদ ৪০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। কচুরিপানা, আগাছা পরিষ্কার ও পরিচর্যায় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ফগার, হুইল ও স্প্রে মেশিন পরিবহনে ৪ কোটি টাকা, আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ২৫ কোটি টাকা এবং মশক নিয়ন্ত্রণে চিরুনি অভিযানে ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এত টাকা বরাদ্দ করেও নগরবাসীকে মশার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারছে না দুই সিটি করপোরেশন।
ডেঙ্গু মোকাবিলায় বছরজুড়ে কর্মপরিকল্পনা রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। মশা নিধনে আগের পদ্ধতিতেই ভরসা রেখেছে সংস্থাটি। দক্ষিণের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির কালবেলাকে বলেন, বছরের শুরু থেকেই মশা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ওষুধ ছিটানো কার্যক্রমে সকালে লার্ভিসাইডিং আর বিকেলে ফগিং করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় ধারাবাহিকভাবে জনসচেতনতামূলক প্রোগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছি।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দক্ষিণ সিটি নতুন কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করবে কি না জানতে চাইলে ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের নেতৃত্বে কীটতত্ত্ববিদ ও বিশেষজ্ঞদের একটি কমিটি রয়েছে। তারা ঠিক করেন কীভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ করা হবে। তবে আমাদের চলমান পদ্ধতি ভালোভাবেই কাজ করছে। ৩০ বছর ধরেই জানা, ফগিংয়ের চাইতে লার্ভিসাইডিং বেশি কার্যকর। এটা নতুন করে কিছু বলার নেই। কেননা, এটা মশার লার্ভাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। ফলে মশার নতুন করে বংশবিস্তারের সুযোগ থাকে না।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, গত জানুয়ারিতে মেয়র যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামি ভিজিট করেছেন। সেখানে মশা নিয়ন্ত্রণে যেসব উপায় দেখেছেন; তা আমাদের এখানে নেই। সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ নিয়েছি। যেমন, আমরা লার্ভিসাইডিং আর ফগিংকে সমান গুরুত্ব দিয়ে আসছিলাম। কিন্তু সেখানে ফগিংটাকে কম গুরুত্ব দিয়ে লার্ভিসাইডিংকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। তাই আমরা কীটতত্ত্ববিদের পরামর্শে লার্ভিসাইডিংয়ের সময় পরিবর্তন করে সকাল ৮টার বদলে ভোর ৬টা থেকে শুরু করেছি। কেননা, সূর্যের উত্তাপ যত বাড়ে লার্ভাগুলো পানির নিচে চলে যায়, তাতে ওপরে লার্ভিসাইডিং করলে কার্যকারিতা পাওয়া যায় না।
এ ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত বেসিলাস থারিংগেসিস সাবস্পেসিস ইসরায়েলেনসিস (বিটিআই) টুল প্রয়োগ করতে যাচ্ছে ডিএনসিসি। জোবায়দুর রহমান বলেন, মেয়র যুক্তরাষ্ট্রে মশা নিধনে আরেকটা বিষয় দেখেছেন, বিটিআই পদ্ধতি। এটার কার্যকারিতা নিয়ে কীটতত্ত্ববিদের কোনো সন্দেহ নেই। কেননা, এটা বায়োলজিক্যালি মশা কন্ট্রোল করে, এতে পরিবেশেরও কোনো ক্ষতি হয় না। আমরা সেটাকে এরই মধ্যে কেনার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আছি। এরই মধ্যে আমরা ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করিয়েছি এবং ভালো রেজাল্ট পেয়েছি। এখন এটা আমরা মাঠপর্যায়ে প্রয়োগ করব। এ ছাড়া ডেঙ্গুর লার্ভা ধ্বংসে এলাকাগুলোর জলাশয় ও ড্রেনে গাপটি মাছও ছাড়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, চলতি মে মাসে এডিস মশা বেড়েছে। কেননা থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। তা ছাড়া এটি মৌসুম। তবে এখনই প্রকৃত চিত্রটা কী, তা বলা যাচ্ছে না। চলতি মাসে আমাদের একটি সার্ভে হবে। সেটি হলে হয়তো বলা যাবে। এটুকু বলা যায়, শঙ্কা বাড়াচ্ছে। আমরা এখন মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে এডিস মশার যে ঘনত্ব পাচ্ছি, তা একটু বেশি। এজন্য সতর্কবার্তা দিচ্ছি যে, এডিস মশা যেহেতু বেশি, ডেঙ্গুও বেশি হতে পারে।