ঢাকা, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

অদক্ষ ধাত্রীসেবায় বাড়ে মাতৃমৃত্যু

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ২৮ মে, ২০২৩ ০৯:১০ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫৯৯ বার


অদক্ষ ধাত্রীসেবায় বাড়ে মাতৃমৃত্যু

শরীয়তপুরের পদ্মার চরের বাসিন্দা ইয়াকুব হোসেন। গত বছরের মার্চে তার স্ত্রী আয়েশা দ্বিতীয় সন্তান প্রসবকালে মারা যান। এক দিন পর ছোট্ট শিশুও নিউমোনিয়ায় মারা যায়। গত শুক্রবার কথা হয় ইয়াকুবের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রসব ব্যথা ওঠার পর পাশের বাড়ির ধাত্রী আলেয়া কাকির সহায়তায় আমার দ্বিতীয় ছেলের জন্ম হয়। প্রথম ছেলের জন্মও কাকির সহায়তায় হয়। দ্বিতীয় ছেলের জন্মের কিছুক্ষণ পর শুনি বউয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছে না। সেই রাতে ট্রলার নিয়ে পদ্মা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পথে স্ত্রীর মৃত্যু হয়। সেদিনের স্মৃতি আমাকে আজও পোড়ায়। আমি চাই সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে আর কোনো মায়ের যেন মৃত্যু না হয়। শুধু আয়েশা নন, সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে দেশে প্রতি লাখে ১৬৩ জন মায়ের মৃত্যু হয়। যার নেপথ্যে অদক্ষ ধাত্রীসেবা।


সরকারি তথ্যমতে, দেশের অর্ধেক শিশুর জন্ম হয় নিজ বাড়িতে অদক্ষ ধাত্রীর হাতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বাড়িতে সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে পেশাদার ধাত্রী আছেন মাত্র ৪ হাজার ৩৯৬ জন। সহযোগী ধাত্রী ৭ হাজার ২০২ জন। প্রসূতিদের তুলনায় এ সংখ্যা অপ্রতুল। ফলে সন্তান প্রসবকালে প্রতি লাখে অন্তত ১৬৩ মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। অথচ ৮০ শতাংশ সন্তান জন্মদান দক্ষ গাইনি চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে উন্নতি করা প্রয়োজন। নয়তো এ মৃত্যুহার কমিয়ে আনা সম্ভব নয়।

চিকিৎসকরা বলছেন, মাতৃমৃত্যু রোধে প্রধান প্রতিবন্ধকতা মায়েদের হাসপাতালে না আনা। প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনির কারণে মাতৃমৃত্যু হয়ে থাকে। যা বাড়িতে অদক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের কারণে হয়ে থাকে। প্রাতিষ্ঠানিক সন্তান জন্মদান বাড়াতে পারলে এ সমস্যা বহুলাংশেই কমে আসত। অনেকে প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারির জন্য হাসপাতালে যান না। গর্ভাবস্থায় মাত্র ৪৭ শতাংশ মা চারবার চিকিৎসকের কাছে আসেন।

 

মায়েদের এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। দেশের এমন পরিস্থিতিতে আজ রোববার পালিত হচ্ছে জাতীয় নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, গর্ভকালে চারবার সেবা গ্রহণ করি, নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করি। দিবস ঘিরে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, দেশি-বিদেশি বেসরকারি সহায়তা সংস্থা একাধিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, প্রতিবছর দেশে প্রায় ৩০ লাখ শিশুর জন্ম হয়। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক শিশুর জন্ম হয় বাড়িতে। সম্প্রতি জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (নিপোর্ট) বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস) ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরে ৫০ শতাংশ নবজাতকের জন্ম হয় বাড়িতে, ১৪ শতাংশের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে, ৩২ শতাংশের বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে এবং ৪ শতাংশের জন্ম হয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সুবিধাসংবলিত প্রতিষ্ঠানে। সংখ্যার হিসাবে গত বছর ঘরে শিশু জন্মদান হয়েছে ১২ লাখ ৬২ হাজার ৩২৪ জন, সরকারিতে ৬ লাখ ৪৭ হাজার ৪৩৮, বেসরকারি হাসপাতালে ১৬ লাখ ৩১ হাজার ২৫৫ ও এনজিওতে ৬১ হাজার ৪৮৯ জন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে দক্ষ গাইনি চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সন্তান প্রসব ৮০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর দেশে ১ লাখ প্রসূতির মধ্যে ৫০০ মা মারা যেতেন। বর্তমানে তা ১৬৩ জন। ২০২৫ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যু কমিয়ে প্রতি লাখে ৮৫ জনে নামিয়ে আনতে হবে। ২০৩০ সালের টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে প্রসূতি মৃত্যু লাখে ৭০ জনে নামিয়ে আনতে হবে।

ওজিএসবির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা বেগম কালবেলাকে বলেন, মাতৃমৃত্যু কমাতে হলে বাড়িতে প্রসব বন্ধ করতে হবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি যা গ্রামে সচরাচর হচ্ছে। ফলে মা-শিশুর মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক ক্ষেত্রে বেড়ে যায়। দেশে মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, খিঁচুনি বা একলামশিয়া, বিলম্বিত প্রসব এবং প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে মায়েদের হাসপাতালে আনা। তাদের হাসপাতালে আনতে পারলে মাতৃমৃত্যুর সমস্যা বহুলাংশেই সমাধান সম্ভব। স্বাভাবিক প্রসবের জন্য ধাত্রীদের যে মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ দরকার সেটি আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত সেভাবে গড়ে উঠেনি। বিশেষ করে পরিবেশ, ওষুধপত্র, যন্ত্রপাতি ও দক্ষ লোকবলের সংকট এখনো রয়ে গেছে। প্রসবসেবা, প্রসব-পরবর্তী সেবা, নবজাতকের সেবা ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে আরও বেশি সচেতন হতে হবে।


   আরও সংবাদ