ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৬ জুলাই, ২০২৩ ০৮:৫৭ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ২৪৬ বার
ঈদের আগের দিন অর্থাৎ গত ২৮ জুন থেকেই কখনো ভারি আবার কখনো মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হয়েছে নগরীতে। বিভিন্ন বাসা-বাড়ি, ছাদবাগান, নির্মাণাধীন ভবন, বেজমেন্ট, বস্তি এলাকাসহ অনেক জায়গায় জমেছে বৃষ্টির পানি। তবে ঈদের ছুটি থাকায় অধিকাংশ জায়গা থেকে পানি অপসারণ করা যায়নি। ফলে বেড়েছে মশার উপদ্রব। এর সঙ্গে তালমিলিয়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, তিন দিনের বেশি জমে থাকা পানি থেকে এডিস মশার বিস্তার ঘটতে পারে।
এ বছর বর্ষা শুরুর আগেই আগ্রাসী রূপ নিয়েছে ডেঙ্গু। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এবার ডেঙ্গুর মৌসুম গত বছরের মতো দীর্ঘ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। সিটি করপোরেশনের জোরালো কার্যক্রমের পাশাপাশি নগরবাসী সচেতন না হলে পরিস্থিতি ভয়ানক রূপ নিতে পারে। চলতি বছরের সাত মাস না যেতেই সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। এরই মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৬২ জনের। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের দৌড়ঝাঁপের শেষ নেই। প্রতিদিনই চলছে অভিযান। নগরবাসীকে করা হচ্ছে জরিমানা। এমনকি ড্রোন দিয়ে খোঁজা হচ্ছে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজননস্থল।
রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগীর ক্রমবৃদ্ধি প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে দুই সিটির মশা নিধন কার্যক্রমকে। মশা নিধন কর্মকর্তারা বলছেন, বৃষ্টিপাতের কারণে ছাদবাগান, টব, টায়ার ও নির্মাণাধীন ভবনে পানি জমার সুযোগ থাকে বেশি। বিশেষ করে নির্মাণাধীন ভবন ও বেজমেন্টে জমে থাকা পানিতে ডেঙ্গুর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। বৃষ্টি হলে এসব ভবনের নানা জায়গায় পানি জমে থাকে। এ পানি থেকেই জন্ম নিচ্ছে এডিসের লার্ভা।
কয়েক বছর ধরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নাগরিকদের ছাদবাগান করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এমনকি ছাদবাগান করলে ১০ শতাংশ গৃহকর ছাড় দেওয়ার ঘোষণাও এসেছে। কিন্তু সেই ছাদবাগানই এখন গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ছাদবাগানের গাছের টবে পানি জমলেও তা অনেকে নিয়মিত পরিষ্কার করেন না। ফলে সেখানে এডিস মশার জন্ম হচ্ছে। তাই ছাদবাগানই এখন ডেঙ্গু বিস্তারের অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে।
গতকাল সরেজমিন মোহাম্মদপুর এলাকায় বেশ কয়েকটি বাড়ি ঘুরে ছাদবাগানে পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। সেখানে এডিসের লার্ভা জন্ম নিয়েছে। জানতে চাইলে এক বাসিন্দা বলেন, ঈদের ছুটিতে বেশিরভাগ মানুষ বাড়ি যাওয়ায় ভবনের বিভিন্ন জায়গায় পানি জমেছে।
এদিকে ঈদের ছুটির পর আগামী রোববার খুলছে দেশের সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অভিভাবকরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ এডিস মশার প্রজননের জন্য বেশ উপযোগী। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেক ফাঁকা জায়গায় পানি জমে থাকে। ঈদুল আজহার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল স্কুল। এর মধ্যে গত কয়েকদিন টানা বৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং এবার স্কুলগুলোতে এডিস মশার বিস্তার ঘটতে পারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, যে ছাদে সরাসরি রোদ পড়ে, সেখানে এডিস মশা হবে না। যদি পানি জমেও, দুপুরে জায়গাটি গরম হয়ে যাবে। এই গরমে এডিসের লার্ভা বাঁচবে না। তবে যে ছাদবাগান নিয়মিত পরিচর্যা করা হয় না, সেখানে এডিস মশা হতে পারে। গবেষণায় তিনি দেখছেন, যেসব স্থানে পানি জমা পাত্র পাওয়া যাচ্ছে, তার প্রায় সবকটিতেই এডিসের লার্ভা মিলছে।
তিনি বলেন, এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জটিল। বহুতল ভবনে সিটি করপোরেশনের একজন মশককর্মীর জন্য প্রবেশ করা কঠিন। নগরবাসীকে সম্পৃক্ত না করতে পারলে এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দেওয়া মুশকিল। ডেঙ্গুর হটস্পটগুলোকে (বেশি সংক্রমণ এমন এলাকা) আলাদা গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।
দক্ষিণ সিটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির বলেন, ছাদবাগান নিয়মিত পরিচর্যা করতে হবে। প্রতিদিনকার পানি প্রতিদিনই পরিষ্কার করতে হবে। এটা না করার কারণে ছাদবাগান অনেকের জন্য মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, দোকানপাট যেখানেই হোক কোনোভাবেই এক দিনের বেশি কোথাও পানি জমতে দেওয়া যাবে না। আমাদের সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তার কারণ নির্মাণাধীন ভবন ও বেজমেন্ট, সেখানে সবচেয়ে বেশি লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। জরিমানা করছি, সতর্ক করছি। সামনে আমরা আরও কঠোর পদক্ষেপ নেব।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, এ বছর এডিস মশা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এডিস মশা উন্মুক্ত জায়গায় পানি জমে থাকলে সেখানে ডিম ছাড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এডিস মশার বংশবিস্তারের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বৃষ্টি হচ্ছে, আবার রোদ উঠে যাচ্ছে। তিন দিন পানি জমে থাকলে সেখানে এডিস মশার লার্ভা হয়ে যাচ্ছে। এখন আর বলছি না যে, ‘তিন দিনে এক দিন, জমা পানি ফেলে দিন।’ এখন বলছি, প্রতিদিন জমা পানি ফেলে দিন।
দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ২০১৯ সালে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাক-বর্ষা জরিপের তথ্য বলছে, এবারের পরিস্থিতি ২০১৯ সালের চেয়েও কয়েক গুণ খারাপ। গত ১৭ জুন থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত এবারের প্রাক-বর্ষা জরিপ চালানো হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৪০টি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৫৮টি ওয়ার্ডে গেছেন জরিপকারীরা। এসব ওয়ার্ডের ৩ হাজার ১৪৯টি বাড়ি পরিদর্শন করে ৫৪৯টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। ডিএনসিসির ২৭১ এবং ডিএসসিসির ২৭৮টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, এবার বহুতল ভবনে (প্রায় ৪৪ শতাংশ) এডিস মশার লার্ভা বেশি পাওয়া গেছে। এরপর সবচেয়ে বেশি লার্ভা (প্রায় ৪০ শতাংশ) পাওয়া গেছে একক বাড়ি ও নির্মাণাধীন ভবনে। এসব স্থানে পানি জমে থাকা ভেজা মেঝে, প্লাস্টিক ড্রাম ও পাত্র এবং ফুলের টবে লার্ভা বেশি ছিল।