ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

ব্যাংকগুলোতে ডাকাতি শুরু ২০১৩-১৪ সালের পর থেকে

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ৬ অক্টোবর, ২০২৪ ১০:৪৩ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫৩ বার


ব্যাংকগুলোতে ডাকাতি শুরু ২০১৩-১৪ সালের পর থেকে

মুখলেসুর রহমান। ন্যাশনাল ব্যাংকের নবগঠিত পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান।

পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে ঋণখেলাপিতে জর্জরিত ন্যাশনাল ব্যাংকের আর্থিক সক্ষমতা পুনরুদ্ধারে দায়িত্ব নিয়েছেন। সম্প্রতি দেশের একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে দেশের ব্যাংক খাতের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। সেই সাক্ষাৎকার বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।   

 

প্রশ্ন: আপনি এনআরবি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন সিইও ছিলেন। যে উদ্দেশ্যে ব্যাংকটি করা হয়েছে, ব্যাংকটি কি সেই পথে আছে?

মুখলেসুর রহমান: এনআরবি ব্যাংককে দাঁড় করাতে গিয়ে অনেক সমস্যা হয়েছিল। ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদ অভি অত্যন্ত স্বপ্নদর্শী মানুষ ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন ব্যাংকটির মাধ্যমে দেশে আরো বিদেশি বিনিয়োগ আসবে এবং রেমিট্যান্সপ্রবাহ আরো বাড়বে, কিন্তু তা হয়নি।

মূলত যারা ব্যাংকটির উদ্যোক্তা হিসেবে এলেন, তাদের ভেতরে মতপার্থক্য ছিল। ব্যাংকটির পর্ষদে শুধু নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশি বা প্রবাসী উদ্যোক্তা থাকার কথা থাকলেও কিছু দেশীয় ব্যবসায়ী প্রবাসী বিনিয়োগকারী সেজে বিনিয়োগ করেছিলেন। অর্থাৎ দেশের টাকাই ঘুরিয়ে দেশে এনেছিলেন। ব্যাংকটিতে এমনও হয়েছে, ছেলের বয়সই হয়নি, কিন্তু তাদেরও উদ্যোক্তা বানানো হয়েছে।

প্রতিষ্ঠার শুরুতেই আমি বলেছিলাম, তিন বছরের মধ্যে কোনো মুনাফা নেওয়া যাবে না। কারণ একটি ব্যাংক শুরু করলে ব্রেক-ইভেন পয়েন্টে পৌঁছাতেই তিন বছর লাগে। পাশাপাশি পরিচালন ব্যয় কমাতে হবে। এ ছাড়া ব্যাংকটি প্রি-অপারেটিং কস্ট বা শুরুর আগেই অনেক বেশি ব্যয় করে ফেলেছিল।

যার কারণে ব্যাংকটি শুরুর আগেই দায়গ্রস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু তার পরও আমি তিন বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটিকে মুনাফায় নিয়ে গিয়েছিলাম। আরেকটি কারণ হচ্ছে, উদ্যোক্তারা মনে করছিলেন আমিই তো ব্যাংকের মালিক। আমি টাকাও তুলে নেব, আমার লোকজনকে চাকরিও দেব। তাই বিভিন্ন চাপ শুরু হয়। যার কারণে তিন বছর পর আমি বুঝতে পারলাম, আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না। তাই, আমি পদত্যাগ করেছি।

প্রশ্ন: ফারমার্স ব্যাংক হারিয়ে গেছে। পাশাপাশি নতুন অনুমোদন দেওয়া ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তি দুর্বল। এ ছাড়া পুরনো ব্যাংকগুলোও দখলে চলে গেছে—এর কারণ কী?

মুখলেসুর রহমান: আগের সরকারের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক যাদের ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছিল, তার পেছনে একটি পারিপার্শ্বিক চাপ, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছিল। আমাদের দেশে এতগুলো ব্যাংকের প্রয়োজন ছিল না। আপনি গণমানুষের কাছে ব্যাংকিং সুবিধা দিতে চাইলে ব্যাংকের শাখা বাড়ান, বিভিন্ন প্রডাক্ট বাড়ান। কিন্তু আওয়ামী লীগও নতুন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে, এর আগে বিএনপিও অনুমোদন দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ বেশি দিয়েছে। যাদের ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কী? উদ্যোক্তাদের ব্যাংকিং টার্মিনোলজি, রিস্ক প্যারামিটার, ফাইন্যান্স ও অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে ধারণা থাকা উচিত। কিন্তু তারা তা জানেন না। তারা ভিজিটিং কার্ডে ব্যাংকের উদ্যোক্তা দেখানোর জন্য, নিজেকে জাতে তোলার চেষ্টা করেন। পাশাপাশি ব্যাংক থেকে টাকা সরানোর পাঁয়তারা করেন।

একসময় বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ঋণখেলাপির সংস্কৃতি ছিল না। ২০১৩-১৪ সালের পর থেকে ব্যাংকগুলোতে ডাকাতি শুরু হয়। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে উদ্যোক্তা-পরিচালকরাই ব্যাংক থেকে লাখ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। মূলত ওই সময় প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের ঘাটতি বেশি নজরে পড়েছে। শুধু ব্যাংকের প্রতিষ্ঠানিক সুশাসনের ঘাটতি ছিল এমনটা নয়, বরং বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনেরও ঘাটতি ছিল।

প্রশ্ন: ন্যাশনাল ব্যাংকসহ বেশ কিছু ব্যাংক খেলাপি ঋণের কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আপনাকে ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। ডুবতে থাকা ব্যাংকটি উদ্ধারে আপনার কর্মপরিকল্পনা কী?

মুখলেসুর রহমান: অর্থনীতি যখন ঊর্ধ্বমুখী হয়, তখন দুর্নীতি, খেলাপি ঋণও বাড়তে থাকে। বিশ্বের অনেক দেশেই এমনটি হয়েছে। তুরস্কে মূল্যস্ফীতি ৭০ শতাংশ হয়েছিল। ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ায়ও মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল। এদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও খেলাপি ঋণ ৪০ শতাংশে পৌঁছেছিল। খেলাপি ঋণ কমাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে। আমাদের একটি আলোচনায় খেলাপি ঋণ কমাতে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কম্পানি গঠনের প্রস্তাব উঠে এসেছিল। এ কম্পানিটি সরকারি কিংবা বেসরকারি হতে পারে। যার কাজ হবে ডিসকাউন্ট ভ্যালুতে ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় গ্রহণ করবে। এতে করে দুর্বল ব্যাংকগুলোর ব্যালান্স শিট পরিষ্কার হয়ে যাবে। ঋণখেলাপি থাকলে ব্যাংকগুলোকে ক্যাপিটাল চার্জ হয়। পাশাপাশি ব্যাংকগুলো প্রভিশনিং করতে হয়। ব্যাসেল-২ ও ব্যাসেল-৩ পরিপালন সম্ভব হয় না।

আমিসহ চারজনকে ন্যাশনাল ব্যাংকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যা পরিস্থিতি দেখলাম, এতে বোঝা যাচ্ছে, ব্যাংকটির বড় অঙ্কের বিনিয়োগ খেলাপি হয়েছে। এই ঋণ কমাতে আমাদের দুটি পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে খেলাপি আদায়ে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি পুরো ব্যাংকটিকে রি-স্ট্রাকচারিং করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রসেস, প্রডাক্ট, পিপলস, টেকনোলজির রি-স্ট্রাকচারিং করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রি-স্ট্রাকচারিং হচ্ছে পিপলস। আমরা যোগ্য ব্যক্তিকে, যোগ্য স্থানে স্থানান্তর করব। এ ছাড়া বিভিন্ন সমস্যা আমরা খুঁজে বের করে সমাধানের চেষ্টা করছি।

প্রশ্ন: ব্যাংকটিতে কি এখন তারল্য সংকট রয়েছে? আপনারা কিভাবে এটা সমাধানের চেষ্টা করছেন?

মুখলেসুর রহমান: জি, দুর্বল ১০টি ব্যাংকেই তারল্য সংকট রয়েছে। এ জন্য আমরা বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে বৈঠক করেছি। গভর্নর বলেছেন, আগের সরকারের মতো টাকা ছাপিয়ে অর্থের জোগান দেওয়া হবে না। এ ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। বরং বন্ড ইস্যুর সুযোগ দেওয়া হবে। গ্যারান্টি দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। যার মাধ্যমে আমরা অর্থ সংগ্রহ করে ঘুরে দাঁড়াতে পারব।

প্রশ্ন: প্রায় ২৫ লাখ শিক্ষিত যুবক বেকার রয়েছে। এই তরুণদের কি চাকরিই খোঁজা উচিত, নাকি উদ্যোক্তা হওয়া উচিত? ব্যাংকার হিসেবে আপনি কী মনে করেন?

মুখলেসুর রহমান: চীন, ইন্দোনেশিয়া, হংকংয়ের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে ক্ষুুদ্র ও মাঝারি আকারের উদ্যোক্তাদের ভূমিকা অত্যন্ত বেশি। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য চাকরি না খুঁজে তরুণরা যেন উদ্যোক্তা হয়। কিন্তু এটা সত্য, উদ্যোক্তা হওয়া কঠিন। কারণ, ব্যাংকগুলো জামানত ও গ্যারান্টি ছাড়া ঋণ দেয় না। কিন্তু আমি যখন সীমান্ত ব্যাংকে ছিলাম, যশোরের গদখালীতে চারজন কর্মী দিয়ে একটি শাখা খুলেছিলাম। ওই মডেল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পরে সাব-ব্রাঞ্চের অনুমোদন দেয়। এই প্রক্রিয়াটি একই সঙ্গে ব্যয় কমিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিচ্ছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মূলধনের যোগান দিতে ও ব্যবসার পরিধি বাড়াতে আমি দুই লাখ টাকা পর্যন্ত বিনা জামানতে ঋণ প্রদানের প্রডাক্ট ‘নারী শক্তি’ চালু করি। এতে করে যেসব নারী গবাদি পশু লালন-পালন, মাছ চাষ, কৃষিকাজ, হস্তশিল্প, বুটিকস কিংবা সেলাইয়ের কাজে জড়িত তাদের এই ঋণ দেওয়া হতো। নতুন উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়ের পরিকল্পনা ভালো থাকলেও মূলধন সংকটে তা প্রকাশ পাচ্ছে না।

দেখুন, আমরা তেলা মাথায় তেল দিয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। কোনো ব্যাবসায়িক গ্রুপ ১০০ কোটি টাকা ঋণ চাইলে বিনা জামানতেই ঋণ দিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু এই ব্যবসায়ী লোকসান করলে সব শেষ। কিন্তু এই ১০০ কোটি টাকা যদি আমরা ৫০ জন উদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করি, তবে দেশ নতুন উদ্যোক্তা পাবে। পাশাপাশি অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। আমাদের ব্যাংকারদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। শহরকেন্দ্রিক ব্যাংকিং চিন্তা বাদ দিয়ে গণমানুষের উন্নয়নে এগিয়ে যেতে হবে।

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ


   আরও সংবাদ