ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

বস্তার স্তূপে সুড়ঙ্গ করে রাখেন গ্রেপ্তার হওয়া খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ৮ অক্টোবর, ২০২৪ ১২:০৭ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৩৪ বার


বস্তার স্তূপে সুড়ঙ্গ করে রাখেন গ্রেপ্তার হওয়া খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা

লালমনিরহাট: চালের হিসেবে গোঁজামিল দিতে খাদ্যগুদামের খামালে (বস্তার কয়েকটি স্তূপ) সুড়ঙ্গ করে রাখেন সরকারি চাল তছরুপের দায়ে গ্রেপ্তার হওয়া লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা খাদ্য পরিদর্শক ফেরদৌস আলম।  

গণনা শুরুর দুইদিনে ১৭ খামালের তিনটিতে ১৪০ মেট্রিক টন চাল কম পেয়েছে তদন্ত টিম।

তছরুপকৃত চালের পরিমাণ তিনশ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।  

 

সরকারি চাল তছরুপ করার দায়ে গ্রেপ্তার খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা খাদ্য পরিদর্শক ফেরদৌস আলমকে রোববার আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে শুক্রবার কালীগঞ্জ থানায় দায়ের করা মামলাটি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আঞ্চলিক কার্যালয় কুড়িগ্রামে পাঠিয়েছে পুলিশ। কালীগঞ্জ উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এনামুল হক বাদী হয়ে দুদক আইনে মামলাটি দায়ের করলে শনিবার তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।  

সরকারি চাল তছরুপের ঘটনা তদন্তে ৫ কর্মদিবস সময় দিয়ে শুক্রবার চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন জেলা প্রশাসক। তদন্ত কমিটি ও স্থানীয় প্রশাসন অভিযান চালিয়ে প্রথম দিনই দুই দফায় সাড়ে ৫৪ মেট্রিক টন চাল উদ্ধার করে জব্দ করে। বিভিন্ন সূত্রের খবরে কয়েকটি অভিযান চালালেও সফল হয়নি প্রশাসনের অভিযান। এর আগে গত বৃহস্পতিবার ভোরে ২৫টি ট্রলিতে গুদাম থেকে ২৫০ মেট্রিক টন চাল সরিয়ে আত্মগোপনে যান গুদাম কর্মকর্তা। এমন খবরে তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে গুদাম সিলগালা করেন কালীগঞ্জ ইউএনও জহির ইমাম।  

তদন্ত কমিটি গুদামে তছরুপ হওয়া চালের সঠিক পরিমাপ নির্ধারণ করতে গুদামের প্রতিটি বস্তা পরিমাপ করে আলাদা করা হচ্ছে। এসময় প্রতিটি খামালে সুড়ঙ্গ খুঁজে পায় তদন্ত কমিটি। এই সুড়ঙ্গ থেকে চালের গোঁজামিল হিসেব দিতেন গুদাম কর্মকর্তা ফেরদৌস আলম। তদন্ত কমিটির পরিমাপ টিমটি গত দুই দিনে ১৭টি খামালের মাত্র তিনটি খামাল পরিমাপ করতে সক্ষম হয়েছেন। তিন খামাল থেকে প্রায় ১৪০ মেট্রিক টন চাল কম পেয়েছে তদন্ত টিম। খামালগুলোর মাঝে খালি বস্তার স্তূপ রেখে সুড়ঙ্গ রেখেছেন ফেরদৌস আলম।  

সুড়ঙ্গের বিষয়ে গুদাম শ্রমিকরা জানান, প্রতি এক/দুই মাস পর পর গুদাম পরিদর্শন করা হয়। সেই পরিদর্শনে গুদামের খামাল এবং প্রতি খামালে কতটি সারি ও প্রতি সারিতে কতটি বস্তা রয়েছে তা খাতার সঙ্গে মিল রয়েছে কি না। সেটা দেখেন মাত্র। এ কারণে খামালে সুড়ঙ্গ রাখেন ফেরদৌস। শ্রমিকরা বিষয়টি জানলেও তা প্রকাশ না করতে কড়াকড়ি আরোপ ছিল গুদামে।  

স্থানীয় চাল ব্যবসায়ী ও নিবন্ধিত চাল কল মালিকরা (মিলার) জানান, ভোটমারী খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা ফেরদৌস আলমের পছন্দের কয়েকজন মিলার রয়েছে। এসব মিলারকে আগাম ডিও (টাকা) প্রদান করে থাকেন। সেই টাকা নিয়ে মিলাররা চাল তৈরি করে বা কিনে গুদামে দেন। এর মধ্যে দু/একজন টাকা নিয়েও চাল না দেওয়ায় সংকটে পড়েন ফেরদৌস। এ ছাড়াও গত বোরো মৌসুমে ৩০ জন নিবন্ধিত ও চুক্তিপত্র করা মিলারের মধ্যে ২৪ জনের বরাদ্দের চাল ফেরদৌস নিজে গুদামে দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। গত মৌসুমে বাজারের চেয়ে গুদামে চালের বাজারদর ছিল কেজিতে ২/৩ টাকা বেশি। কেজি প্রতি মিলারদের এক টাকা দিয়ে নিজে আগাম টাকা তুলে কম দামে চাল কিনে মিলারদের নামে গুদামে ঢুকাতেন। চালের টাকা সরাসরি ব্যাংকে চলে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট মিলারের কাছ থেকে স্বাক্ষরিত চেক নিয়ে রাখতেন ফেরদৌস আলম।  

তার এসব কাজে সহায়তা করতেন মিলার শফিকুল ইসলাম, এরশাদ হোসেন, ইউনুস আশরাফি, কলেজ শিক্ষক ও মিলার শাহীন এবং আওয়ামী লীগ নেতা কাঞ্চন ও বদিয়ার। এর আগেও কাঞ্চন গুদামের চাল কিনে তা মিনিকেট লেখা প্যাকেট করে বাজারে বিক্রি করতে গিয়ে ধরা খায়, পরে গুদাম সিলগালা করেছিল প্রশাসন। কিন্তু তৎকালীন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহম্মদের খুব কাছের লোক হওয়ায় বেঁচে যান কাঞ্চন। গুদাম কর্মকর্তা ফেরদৌস আলমের বটগাছ ছিল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা কাঞ্চন। ফেরদৌস আলম গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে এসব মিলার ও সেল্টারদাতারা আত্মগোপনে রয়েছেন।  

খাদ্য বিভাগের একটি দায়িত্বশীল সূত্র দাবি করেছে, ফেরদৌস আলম বৃহস্পতিবার গুদাম থেকে মিলার এরশাদকে ৫০ মেট্রিক টন চাল দিয়েছেন। যা ওই বৃহস্পতিবার ভোরেই রংপুর চলে যায়। বিক্রি করে টাকা শফিকুলকে দেওয়ার কথা থাকলেও এরশাদ আত্মসাৎ করেছেন বলে সূত্রটি দাবি করেছে। তবে ফেরদৌসের প্রিয় মিলাররা আত্মগোপনে থাকায় এর সঠিকতা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।  

খাদ্য বিভাগের অপর একটি সূত্র বলছে, তছরুপ হওয়া আড়াই/তিনশ মেট্রিক টন চাল একদিনে গুদাম থেকে গোপনে সরানো অসম্ভব। ধারণা করা হচ্ছে, যে ২৪ জন মিলারের চাল ফেরদৌস নিজে গুদামে ক্রয় দেখিয়েছেন। তা হয়ত কাগজ কলমে ক্রয় দেখানো হয়েছে। আর এ সংকট গোঁজামিল দিতে খামালে সুড়ঙ্গ রেখেছেন। তিনি শুধু চাল নয়, সরকারি টাকাও তছরুপ করেছেন। এজন্য বোরো মৌসুমে গুদামে চাল দেওয়া মিলারদের জিজ্ঞাসাবাদ করার দাবি করেছে সূত্রটি। এমনটি হলে তদারকি কর্মকর্তা হিসেবে উপজেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক দায় এড়াতে পারেন না। কারণ ডিওতে স্বাক্ষর করলে সে চাল গুদামে পৌঁছানো হয়েছে কি না তা নিশ্চিত করাও তার দায়িত্বে পড়ে।  

অভিযানে প্রথম দফায় একরামুল হকের সুটার মিল থেকে ৩০ মেট্রিক টন চাল উদ্ধার করা হয়। সেই একরামুল হক বলেন, পুরো উপজেলার মিলার, সাধারণ চাল ব্যবসায়ী ও সরকারি গুদাম থেকেও চাল আসে আমার সুটার মিলে। কারণ এটিই একমাত্র সুটার মিল। ওই দিন তিনটি ট্রাকে ৩০ মেট্রিক টন চাল সুটার করতে পাঠান স্থানীয় মিলার শফিকুল। যা পরবর্তীতে প্রশাসন জব্দ করে। শফিকুলের সঙ্গে গুদাম কর্মকর্তা ফেরদৌস আলমের বেশ সখ্যতা রয়েছে। চাল জব্দ এবং ফেরদৌস গ্রেপ্তারের পর থেকে শফিকুল অনেকটা আত্মগোপনে।

তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক (ভার) স্বপন কুমার দে বলেন, গুদামে ১৭টি খামালের মাত্র তিনটি পরিমাপ করে রেজিস্টার অনুযায়ী ১৪০ মেট্রিক টন চাল কম পেয়েছি। প্রতিটিতে সুড়ঙ্গ ছিল। তদন্ত চলমান রয়েছে। ৫ কর্মদিবসে তদন্ত শেষ করা সম্ভব হবে না তাই সময় বাড়িয়ে নেওয়া  হবে।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, কি পরিমাণ চাল তছরুপ হয়ে তা আগে নির্ণয় করতে হবে। তাই প্রতিটি বস্তা পরিমাপ করছে তদন্ত কমিটি। অপরদিকে বিভিন্ন তথ্যে একাধিক অভিযান চালিয়েছি কিন্তু চাল পাওয়া যায়নি। আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গ্রেপ্তার গুদাম কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তারাও ঘটনা তদন্ত করবেন।


   আরও সংবাদ