ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২০ অক্টোবর, ২০২৪ ১৫:৫২ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪২ বার
কলকাতা: আরজি কর-কাণ্ডে ভারতজুড়ে এখনও জারি রয়েছে আন্দোলন। ন্যায়বিচার ও ১০ দফা দাবিতে কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলায় আমরণ অনশনে বসেছেন জুনিয়র চিকিৎসকরা।
তাদের এই আমরণ অনশনকে সমর্থন দিয়েছে ভারতের চিকিৎসক সংগঠনগুলো। ১৫ দিনের অনশনে ৬ জন চিকিৎসক হাসপাতালের ক্রিটিকাল ইউনিটে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকাকালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক এই স্থানেই অনশনে বসেছিলেন। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রীর দাবি ছিল, পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর চাষের জমি। সেখানে টাটাগোষ্ঠীদের গাড়ির কারখানা হতে দেওয়া যাবে না। সেই দাবিতে টানা ২৬ দিন অনশন করেছিলেন তিনি। কিন্তু মমতা টানা ২৬ দিন অনশন কীভাবে করলেন—প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্যবাসী।
অপরদিকে, চিকিৎসকদের তরফে স্পষ্ট জানানো হয়েছে, রাজ্য সরকার তাদের সব দাবি মেনে না নিলে, রাজ্যের সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা আগামী মঙ্গলবার হরতালের ঘোষণা দেবেন। তাতেও সমর্থন পেয়েছেন ভারতের ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সের (এইমস)’। ফলে চিকিৎসকদের এই হরতাল শুধু বাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ছড়িয়ে পড়বে গোটা ভারতের স্বাস্থ্যসেবা খাতে। আর এতে ভেঙে পড়বে দেশটির স্বাস্থ্য পরিষেবা।
চিকিৎসকদের এই হুঙ্কারের পর নড়েচড়ে বসেছে ভারত। এরপরই সোমবার বৈঠক বসতে রাজি হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি স্বাস্থ্য সচিবের মাধ্যমে অনশনকারীদের জানিয়েছেন, সোমবার বিকেল ৫টা নাগাদ ৪৫ মিনিটের বৈঠক করতে পারেন। এবং সেই বৈঠকে তিনটি শর্ত দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রথম, অনশনকারীদের অনশন ভঙ্গ করে বৈঠকে বসতে হবে। দ্বিতীয়ত, গত বৈঠকগুলোর মতো ৩০-৩৫ জন উপস্থিত থাকতে পারবে না। বৈঠকে থাকতে পারবেন সর্বোচ্চ ১০ জন। মুখ্যমন্ত্রীর আরেকটি দাবি, স্বাস্থ্য সচিবের অপসারণ মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আর এই শেষ দাবিতেই বেঁকে বসেছেন অনশনকারীরা। তারা এসব শর্ত নিয়ে রোববার (২০ অক্টোবর) সিনিয়রদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন।
এতকিছুর পরও আন্দোলন ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। রোববার চিকিৎসকদের অনশনে যোগ দিয়েছেন ১০ জন অভিনেত্রী। সেখানে দেবলীনা, বিদিপ্তার মতো বিনোদন জগতের কলাকুশলীরাও অনশনে যোগ দিয়েছেন। অনশনকারী অভিনেত্রী দেবলীনা দত্ত বলেছেন, এর আগেও অনত্র চিকিৎসকদের ধরনা অবস্থানে মুখ্যমন্ত্রী এসেছিলেন। এখান থেকে তার বাসভবন মাত্র ১০ মিনিটের দূরত্ব। তিনি না এসে ফোন মারফত বার্তা পাঠিয়েছেন, এটাই তো অবাক করা বিষয়। এর পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী যে শর্ত দিয়েছেন, তা মেনে নেওয়া কোনো মতেই সম্ভব নয়। আমি মনে করি, অনশন থাকাকালীন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হোক তারপরেই সিদ্ধান্ত নিক সবাই।
মুখ্যমন্ত্রীর ২৬ দিনের অনশন নিয়ে শ্রীলেখা মিত্র বলেছেন, আমি কারো স্পাইগিরি করি না। তবে আমি জানি উনি নামীদামি চকোলেট খান। জুনিয়র ছেলেমেয়েরা ৭-৮ দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। উনি কী করে ২৬ দিন করেছিলেন, এটা রাজ্যবাসী বুঝতে পারছে। শুধু জল খেয়ে ২৬ দিন এভাবে থাকা যায় না। জুনিয়র চিকিৎসকদের অনশন তার প্রমাণ দিচ্ছে। আর যে সিঙ্গুরকে হাতিয়ার করে মুখ্যমন্ত্রী অনশন করেছিলেন, সেই সিঙ্গুরে তো এখন ঘাস ছাড়া কিছুই জন্মায় না। অথচ রতন টাটা তাদের গাড়ির কারখানা গড়ে তুললে পশ্চিমবঙ্গের বেকার সংখ্যা অনেক নেমে যেত। বঙ্গবাসীকে ভিন রাজ্যমুখী হতে হতো না। কারণ সেই ন্যানো গাড়ি কারখানার সঙ্গে আরো ১০০ অনুসারী শিল্প আসবে বলে রতন টাটা কথা দিয়েছিলেন। আজ ওসব গুজরাটে। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর সেই মিথ্যা অনশন রাজ্যবাসীর চোখ খুলে দিয়েছে।
অনশনকারীদের তরফে বলা হয়েছে, আমরণ অনশন কর্মসূচির ১৫ দিন কেটেছে। আর তাতেই ৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু বাকি যারা অনশনে রয়েছেন, তাদের শারীরিক অবস্থা কতটা খারাপ তা বোঝার জন্য কাউকে ডাক্তার হতে হবে না। ১৫ দিন কিছু না খেয়ে শুধু পানি পান করে আমরণ অনশন করতে হলে তার শরীরে কী কী হয়, কারো কাছে তা অজানা নয়। আমরা মানবিক মুখ হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীকে মনে করি। এখনো মনে করি তিনি আমাদের অভিভাবক। কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারছি, তিনি আমাদের গ্রাহ্যই করছেন না।
আরজি কর-কাণ্ডে প্রথমদিকে বাম, কংগ্রেস, বিজেপি চিকিৎসকদের আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে মমতা সরকারের ওপর চাপ তৈরি করেছিল। এতে আন্দোলনে রাজনৈতিক হাওয়া লেগে যাচ্ছে বুঝতে পেরে চিকিৎসক এবং সাধারণরা সমস্ত রাজনৈতিক দল থেকে দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছেন। বর্তমানে মমতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলের চাপ না থাকলেও সাধারণদের চাপ কিন্তু যথেষ্ট রয়েছে রাজ্যের শাসক দলের ওপর।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সংসদীয় রাষ্ট্রে বাংলায় এভাবে সরকার পদত্যাগ করতে পারে না বা পড়ে যেতে পারে না। কিন্তু, ২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোট। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতি যদি এরকমই থাকে তাহলে বাংলার পরিবর্তন হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল ক্ষমতায় আসে। কিন্তু বামেদের সেই ভিত নড়ে গিয়েছিল ২০০৮ সালের শেষের দিক থেকে। সেই সময় একের পর এক পরিস্থিতি বামেদের বিরুদ্ধে গিয়েছিল। ঠিক একইভাবে গত কয়েক বছরে কামদুনি, পার্কস্ট্রিট, হাঁসখালি, জয়নগর, কৃষ্ণনগরে একের পর এক নারী নির্যাতনের ঘটনা সামনে এসেছে। শুধু থেমে নেই আরজি কর কাণ্ডে। এর সঙ্গে দুর্নীতির দায়ে বর্তমান রাজ্য সরকারের একাধিক নেতামন্ত্রী জেলে রয়েছেন। ফলে সেই দিক থেকে বিচার করলে ২০২৬ সাল মোটেও সুখকর হবে না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য।
কিন্তু, তৃণমূলের জন্য বর্তমানে সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক হলো এই মুহূর্তে বিরোধীদের মধ্যে এখনো মমতার বিকল্প মুখ তৈরি হয়নি। অর্থাৎ সিপিআইএমের জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভটচার্য় বা তৃণমূলের মমতা, এ ধরনের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রাজ্যের কোনোর দলের কাছেই নেই। সেটা হতে পারে সিপিআইএম বা কংগ্রেস। ফলে সেই দিক থেকে পশ্চিমবাংলার সরকার চালানোর মতো বিকল্প এখনও কেউ নেই!
তবে রাজনীতির হাওয়া কখন কোন দিকে মোড় নেবে তা এখনই বলার সময় আসেনি। বিজেপি ২০২৬ সালেও বাংলা দখল করতে পারবে না, তা একপ্রকার নিশ্চিত। প্রথমত, পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি এবং ভৌগলিক অবস্থান ত্রিপুরা বা আসামের মতো নয়। দ্বিতীয়ত, বাংলার রাজনৈতিক অবস্থান একেবারে ভিন্ন। তারা যাকে একবার গ্রহণ করে তাকে সহজে ফেলতে চায় না। আর যাকে ফেলে দেয়, সহজে সেইমুখো আর হয় না। যেমন ৭০ দশকের পর থেকে কংগ্রেস এবং ২০১১ সালের পর বাম আর বাংলায় আসতে পারেনি। তবে এটি নিশ্চিত আরজিকর কাণ্ডের পরপরই জয়নগর, কৃষ্ণনগরে ধর্ষণ-হত্যা এবং নারী নির্যাতন যথেষ্ট চাপে রেখেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।