ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৬ নভেম্বর, ২০২৪ ১০:১৩ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ১৭ বার
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের বড় ব্র্যান্ডিং এখন নারী ফুটবলারদের সাফল্য। ব্যাক টু ব্যাক দুটি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা ঘরে তুলে নিজেদের অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন সাবিনা-কৃষ্ণারা।
বয়সভিত্তিক দলের সাফল্যও এসেছে দুহাত ভরে।
বয়সভিত্তিক থেকে শুরু করে জাতীয় দল সব জায়গায় এখন নারী ফুটবলের জয়জয়কার। তবে এত এত প্রাপ্তির মাঝেও কোথায় যেন এক বেদনার সুর। হিসেবটা ঠিক মিলতে চায় না। মেডেল দিয়ে নারী ফুটবলারদের ঝুলি পরিপূর্ণ হলেও নিজেদের চাওয়া-পাওয়ায় রয়েছে অপ্রাপ্তি। বেতন ভাতা থেকে শুরু করে আবাসন, খাদ্যাভাস সব কিছুতেই অবহেলা, সীমাবদ্ধতার ছাপ। তবে মাঠে নিজেদের নিংড়ে দিয়ে দেশকে সাফল্য এনে দিচ্ছেন তারা।
গত সপ্তাহে নারী সাফের দ্বিতীয় শিরোপা জেতার পর সাবিনা খাতুনরা কেমন বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন তা নিয়ে আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে ফুটবল পাড়ায়। সবচেয়ে বেশি আলোচনায় নারী-ফুটবলারদের সঙ্গে পুরুষ ফুটবলারদের পারিশ্রমিকের বৈষম্য। তবে নারী-পুরুষ বৈষম্য বিশ্বব্যাপী। সেই বৈষম্য বিশ্বব্যাপিই সকলে আড়াল করেই চলছেন।
এদিকে নিজেদের ঠিক রাখতে সম্প্রতি নারী বাফুফে কার্য নির্বাহি কমিটির সদস্য মাহফুজা আক্তার কিরণ বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর কোথাও ফেডারেশন ফুটবলারদের বেতন দেয় না, ফুটবলাররা ক্লাব থেকে আয় করে। শুধু বাংলাদেশ দেয়। কারণ আমাদের প্রেক্ষাপট আলাদা। ’
যদিও কিরণের বক্তব্য পুরোটা মানার মতো নয়। কারণ নেপাল, ভারত এমনকি ভুটানেও নারী ফুটবলারদের বেতন দেয় ফেডারেশন থেকে। বরং আমাদের চেয়ে ভালো সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে দেশগুলো। তাদের ফুটবলারদের বেতন দিতে ফিফা ফান্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না।
এদিকে আবাসন সমস্যার দিকে তাকালে দেখা যায় নারীদের রাখা হয় বাফুফে ভবনের চার তলায়। সেখানেই তাদের আবাসিক ক্যাম্প হয়। সেই ক্যাম্প নিয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। চতুর্থ তলায় ১১টি কক্ষ বরাদ্দ ৬০ থেকে ৭০ জন নারী ফুটবলারের জন্য। একেকটি কক্ষে ছয় থেকে আটজনকে থাকতে হয় গাদাগাদি করে। এভাবেই হাজারো প্রতিকূলতা সয়ে মেয়েরা দেশকে এনে দেন একের পর এক সাফল্য।
একটি বাথরুম ব্যবহার করতে হয় ছয় থেকে আটজনকে। তাতে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। সেই কক্ষ এবং বাথরুম আবার নিয়ম করে নিজেদেরই পরিষ্কার করতে হয়। দুজন বল বয় আছেন, যারা সামনের করিডোর ও বারান্দা পরিষ্কার করেন নিয়মিত। কক্ষ পরিষ্কার করার জন্য নেই কোনো ক্লিনার। এমনকি ফুটবলারদের ব্যবহৃত কাপড়-চোপড় নিজেদেরই পরিষ্কার করতে হয়। নেই কোনো লন্ড্রি সার্ভিস।
এছাড়া লিফটবিহীন ভবনে মেয়েদের ক্যাম্প আর বাফুফে সচিবালয়ের জন্য একটি মাত্র সিঁড়ি হওয়ায় ভোগান্তি দুপক্ষেরই। চলাচলের সময় মেয়েদের যেমন আড়ষ্ট হয়ে থাকতে হয়, নারীদের আবাসিক ক্যাম্প হওয়ায় বাফুফের কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে নানা কাজে আসা লোকজনেরও থাকতে হয় অস্বস্তিতে।
ছেলেদের ফুটবল যখন একদিকে পিছিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনেই মেয়েদের ফুটবল এগিয়ে যাচ্ছিল সমান তালে। ২০২২ সালে যখন নেপাল থেকে প্রথমবার সাফ জিতে দেশে ফেরে মেয়েরা, তখন অনেকেই অনেক কিছুর আশ্বাস দিয়েছিলেন। তার কতটুকুই বা পুরণ হয়েছে তা নিয়ে আছে বিস্তর আলোচনা।
একটা উদাহরণই সামনে আনা যাক। এবারের সাফ জয়ের নায়ক ঋতুপর্ণা চাকমা ছিলেন প্রথম সাফজয়ী দলেও। সেবার তাকে নিজ এলাকায় রাঙ্গামাটিতে জমি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটি আজ পর্যন্ত বুঝে পাননি তিনি। সাফ জয়ের পর সেই আক্ষেপের কথা জানান ঋতু। অথচ ২০০৩ সালে সাফ জয়ের পর পুরুষ ফুটবলারদের পুড়তে হয়নি এমন হতাশায়। ২০২৪ সালের সাফ জয়ের পর অবশ্য মেয়েদের দাবিগুলো গুরুত্বসহকারে শুনেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেই সঙ্গে আশ্বাসও দিয়েছেন নারী ফুটবলারদের।
আমাদের দেশে নারীদের জন্য এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়নি ক্লাব ফুটবল কালচার। বসুন্ধরা কিংস তাদের জন্য সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে দল গড়েছিল। টানা তিন আসরে চ্যাম্পিয়নও হয়েছিল। তবে এগিয়ে আসেনি দেশের অন্য বড় ক্লাবগুলো। গত মৌসুমে সরে দাঁড়িয়েছে কিংস। নারী লিগে আবারও আসবে হয়তো তারা। তবে এখন বছরে নামমাত্র একটা লিগ হয় বটে; তবে সেটি চলে মাত্র এক মাস বা তারও কম সময়।
প্রায় পুরোটা বছর যেখানে ছেলেদের লিগ থাকে মাঠে; এরপর ফেডারেশন কাপ, স্বাধীনতা কাপের মতো টুর্নামেন্ট তো আছেই; সেখানে মেয়েদের নামকাওয়াস্তে লিগের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয় স্রেফ মাসের মধ্যে। সেখানে দুই একটি ক্লাব বাদে মেয়েদের পারিশ্রমিক থাকে খুবই নগন্য।
এরপর আসে লিগে অংশ নেওয়া এবং ক্লাবের সুযোগ সুবিধার বিষয়টি। সর্বশেষ মেয়েদের লিগ অনুষ্ঠিত হয়েছে রাজধানীর কমলাপুরের মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামের টার্ফে। লিগে অংশ নেওয়া ঢাকার বাইরের দলগুলোকে ঢাকায় এসে হোটেলে থাকতেই হিমশিম খেতে হয়। জামালপুর কাচারিপাড়া একাদশের কথাই মনে করে যাক, লিগে অংশ নিতে তারা ভাড়া করে মগবাজারের একটি হোটেলকে।
সেই হোটেলে ক্লাবটির ফুটবলারদের থাকা-খাওয়া এবং সেখানকার পরিবেশ ছিল খুবই নাজেহাল। মগবাজার থেকে কমলাপুরে দলটির খেলোয়াড়দের আনা নেওয়া করা হতো লেগুনাতে করে। ক্লাবটির কোচের একার অর্থে এর চেয়ে যে বেশি কিছু করা যায়নি। স্পন্সরের অভাবের বিষয়টি উঠে আসে এখান থেকেই।
সেসময় লিগ শুরুর আগে নারী উইংয়ের প্রধান মাহফুজা আক্তার কিরনকে প্রশ্ন শুনতে হয় এ নিয়ে। নাম উল্লেখ না করে একটি ক্লাব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন একজন সাংবাদিক। আলু ভর্তা আর ডাল ভাত খেয়ে একটা ক্লাবের ফুটবলাররা কিভাবে খেলবে, জানতে চাইলে অসহায় ভঙ্গিতে তিনি জানান, ‘এখানে বাফুফের কী-ই বা করার আছে। কোন ক্লাব তাদের ফুটবলারদের কী খাওয়াবে সেটা তো আমরা ঠিক করে দিতে পারি না। ’
এবার বাফুফেতে এসেছে নতুন নেতৃত্ব। নতুন নেতৃত্বে দেশের ফুটবল নতুন ভাবে এগিয়ে যাবে এমনটাই প্রত্যাশা সকলের। দেশের ফুটবলের অসহায়ত্ব ঘুচিয়ে নতুন এক সাবলম্বী চেহারা সকলের প্রত্যাশা। যেখানে প্রতিশ্রুতি পূরণের দায়বদ্ধতা থাকবে, থাকবে হাসিমুখে লড়াইয়ের প্রত্যয়।