ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১০:০৩ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ১৬ বার
মানুষের জীবনযাত্রায় দোয়া এক অনন্য অবলম্বন, বিশেষ করে মাতা-পিতার দোয়া সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। বিশ্বের সম্পর্কগুলোর মধ্যে মাতা-পিতা ও সন্তানের সম্পর্ক সবচেয়ে নির্মল, স্বার্থহীন ও হৃদয়াবদ্ধ। তাই মাতা-পিতার হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চারিত দোয়ায় থাকে আন্তরিকতা, মমতা ও শুভকামনার মিশ্রণ। মাতা-পিতার দোয়া আল্লাহ তাআলার দরবারে অনিবার্যভাবে কবুল হয়।
ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনে সর্বোত্তমভাবে ফুটে উঠেছে দোয়ার মহত্ত্ব ও প্রজন্ম নির্মাণে তার ভূমিকা। তিনি নির্জন মরু প্রান্তরে স্ত্রী হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে রেখে আল্লাহর নির্দেশ মান্যকালে বহু হৃদয়গ্রাহী দোয়া করেন। সেই দোয়ায়ই লুকিয়ে ছিল ভবিষ্যৎ মক্কানগরীর নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি এবং শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের সুসংবাদ। কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা এই দোয়াগুলো উল্লেখ করে মানবজাতিকে শিক্ষা দিয়েছেন—প্রজন্মের কল্যাণ, ঈমান, নেক আমল ও নেতৃত্বের জন্য দোয়া করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
সন্তানের জন্য মাতা-পিতার দোয়া : সন্তানের মঙ্গলের জন্য মাতা-পিতার দোয়া আল্লাহর কাছে সব সময়ই গৃহীত হয়। কারণ মাতা-পিতা সন্তানের জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে প্রাণ খুলে উদার চিত্তে স্নেহ ও দয়া নিয়ে দোয়া করে থাকেন। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, তিন ব্যক্তির দোয়া নিঃসন্দেহে কবুল হয়। (এক) মাতা-পিতার দোয়া, (দুই) মুসাফিরের দোয়া, (তিন) মজলুমের দোয়া।
(আবু দাউদ, অধ্যায় : নামাজ, অনুচ্ছেদ : কারো অনুপস্থিতিতে তার জন্য দোয়া,
হাদিস : ১৫৩৬; তিরমিজি, হাদিস : ১৯০৫, ইবনু মাজাহ, হাদিস : ৩৮৬২)
প্রজন্মের জন্য ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া : ইবরাহিম (আ.) স্ত্রী হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাঈল (আ.)—কে আল্লাহর নির্দেশে এক জনমানবহীন প্রান্তরে রেখে যান। সেখানেই মহান আল্লাহ তাঁর ঘর বাইতুল্লাহ নির্মাণ ও মক্কানগরী প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। ইবরাহিম (আ.) তাদের রেখে সিরিয়ার দিকে রওনা হওয়ার সময় বেশ কিছু দোয়া করেছিলেন। তিনি এই জনমানবহীন প্রান্তরকে শান্তিপূর্ণ শহর বানিয়ে দেওয়া, জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সহজলভ্য করা এবং এ শহরের অধিবাসীদের উপজীবিকা হিসেবে ফলমূল দান করার দোয়াসহ আরো দোয়া করেন। মহান আল্লাহ ইবরাহিম (আ.)-এর এসব দোয়া কবুল করেন।
এই শহরকে নিরাপত্তার কেন্দ্র এবং অনাবাদি ভূমি হওয়া সত্ত্বেও সারা পৃথিবীর ফলমূল এবং সব রকমের শস্য এমন পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়, যা দেখে মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন, “স্মরণ করো, যখন ইবরাহিম বলেছিল, ‘হে আমার প্রতিপালক! এ (মক্কা)-কে নিরাপদ শহর করো, আর এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করবে, তাদের রিজিক হিসেবে ফলমূল দান করো।’” তিনি বললেন, ‘যে কেউ অবিশ্বাস করবে, তাকেও আমি কিছুকালের জন্য জীবনোপভোগ করতে দেব, অতঃপর তাকে দোজখের শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য করব। আর তা কত নিকৃষ্ট পরিণাম (বাসস্থান)।’
(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১২৬)
ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়ার ফসল রাসুলুল্লাহ (সা.) : ইবরাহিম (আ.) তাঁর প্রজন্মে এক মহামানবের আগমনের জন্য দোয়া করেছিলেন। তাঁর দোয়ার ফসল হলেন শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি আমার সূচনা বলে দিচ্ছি, আমার পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া, ঈসা (আ.)-এর সুসংবাদ এবং আমার মা স্বপ্নে দেখেছিলেন যে তার থেকে একটি আলো বের হলো, যে আলোতে সিরিয়ার প্রাসাদ আলোকিত হয়েছে।’
(মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৬২)
হাদিসে উল্লেখিত ঈসা (আ.)-এর সুসংবাদের অর্থ হলো—তাঁর এ উক্তি—‘আমি এমন এক নবীর সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আসবেন। তাঁর নাম আহমাদ।’
(সুরা : আস-সাফ, আয়াত : ৬)
নবী (সা.)-এর জননী গর্ভাবস্থায় স্বপ্নে দেখেন যে তাঁর পেট থেকে একটি নূর বের হয়ে সিরিয়ার প্রাসাদগুলো আলোকোজ্জ্বল করে তুলেছে। আর ইবরাহিম (আ.)-এর অন্যতম একটি দোয়া, যা কোরআনের সুরা বাকারার ১২৯ নম্বর আয়াতে, সুরা আলে-ইমরানের ১৬৪ নম্বর আয়াতে এবং সুরা জুমুয়ার ২ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। ইবরাহিম (আ.) যে নবীর জন্য দোয়া করেছিলেন, তিনি হলেন শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)। যেমন—সুরা বাকারায় বলা হয়েছে : ‘হে আমাদের রব! আর আপনি তাদের মধ্য থেকে তাদের কাছে এক রাসুল পাঠান, যিনি আপনার আয়াতসমূহ তাদের কাছে তিলাওয়াত করবেন; তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন। আপনি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’
(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১২৯)
আল্লাহর শিখিয়ে দেওয়া দুটি দোয়া : সব ভাষাই মহান আল্লাহর দান। আল্লাহ তাআলা সব ভাষা বোঝেন এবং যেকোনো ভাষায় মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা যায়। কিন্তু আরবি ইসলামের দাপ্তরিক ভাষা। এ ভাষায় মহান আল্লাহ কোরআন অবতীর্ণ করেছেন এবং কোরআনুল কারিমে অনেক দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন। সেগুলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও অর্থবহ। এর মধ্যে দুটি দোয়া হলো—(১) রব্বিজ আলনি মুকিমাস সালাতি ওয়ামিন জুররিয়্যাতি, রব্বানা ওয়া তাকাব্বাল দুয়া।
(সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ৪০)
অর্থ : হে আমার রব! আমাকে সালাত প্রতিষ্ঠাকারী বানাও এবং আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও, হে আমাদের রব! আপনি আমার দোয়া কবুল করুন।
(২) রব্বানা হাবলানা মিন আজওয়াজিনা ওয়া জুররিয়্যাতিনা কুররাতা আ‘ইয়ুন ওয়াজআলনা লিল মুত্তাকিনা ইমামা।
(সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৭৪)
অর্থ : হে আমাদের রব! আমাদের স্ত্রী (জোড়া) ও সন্তানদের মধ্য থেকে আমাদের জন্য চোখের শীতলতা দান করো এবং আমাদের নেককারদের নেতা বানাও।
এটি শুধু একটি দোয়া নয়, বরং পরিবারের কল্যাণ, সন্তানের নেক আমল এবং নিজের নেতৃত্বের জন্য আল্লাহর কাছে এক হৃদয়গ্রাহী প্রার্থনা।
পরিশেষে বলা যায়, মাতা-পিতার দোয়া সন্তানের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশাল নিয়ামত। এ দোয়ায় যেমন থাকে আন্তরিকতার সুধা, তেমনি থাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কল্যাণ নিশ্চিত করার শক্তি। কোরআনে আল্লাহর শিক্ষা দেওয়া দোয়াগুলো আমাদের জন্য চিরন্তন দিকনির্দেশনা। সন্তানকে সালাতপরায়ণ, সৎ, ঈমানদার, চরিত্রবান বানানোর জন্য নিয়মিত দোয়া করা একজন মুসলিম মাতা-পিতার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। দোয়া শুধু মুহূর্তিক আবেদন নয়, এটি প্রজন্ম গড়ার এক শক্তিশালী উপকরণ, যা আল্লাহর রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয় এবং দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জীবনে কল্যাণ বয়ে আনে।
লেখক : অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়