ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৪ জুলাই, ২০২৫ ১৫:৫১ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৮৬৯ বার
“Where law ends, does justice begin?” — এই প্রশ্নটি যেন প্রতিটি বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে আজ এক বেদনার ধ্বনি হয়ে বেজে ওঠে। আইন এবং ন্যায়— দুটি শব্দ, দুটি দর্শন, দুটি যাত্রাপথ। একটির পা বাঁধা কাগজে, অন্যটির ডানা মেলে হৃদয়ের গগনে।
আইন শিখিয়ে দেয় কী করব, কিন্তু ন্যায় শেখায় কেন করব না।
আইন বিচার করে ‘ঘটনা’ দেখে, ন্যায় বিচার করে ‘মানুষ’ দেখে। আইন বলে—ধারা ৩০২। ন্যায় বলে—“একটি জীবন হারিয়ে গেল, কারণ সমাজ ব্যর্থ হয়েছিল।” আইন বলে—“অপরাধ প্রমাণ হয়নি, মুক্ত।” ন্যায় বলে—“কিন্তু ভুক্তভোগী কি মুক্ত হলো?”
আইন: কাঠামোর বিজ্ঞান, কিন্তু কি হৃদয়ের নীরবতা?
আইন এক অনিন্দ্য প্রক্রিয়া। এটি নিয়ম মেনে চলে, তর্কে দাঁড়িয়ে থাকে, যুক্তি খোঁজে—এবং এক কাঠামোগত সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। এ কারণেই আইনশাস্ত্র বিজ্ঞানের শাখা, যেখানে প্রমাণ, সাক্ষ্য, পর্যবেক্ষণ—এই তিনেই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বিজ্ঞানও তো জানে—সবকিছু মাপা যায় না!
একজন মা যখন ধর্ষিতা মেয়েকে কোলে নিয়ে রাস্তায় বসে—তখন আইন তাকে কেবল ধারার পাঠ দেয়, ন্যায় তাকে গলায় জড়িয়ে কাঁদে। বিখ্যাত আইন দার্শনিক লোর্ড ডেনিং বলেছিলেন,
“Justice is not just a legal term; it is a cry from the human soul.”
দর্শনের দৃষ্টিতে: ন্যায় কি সত্যের স্নেহময় ছায়া?
গ্রিক দর্শন বলত—ন্যায় মানেই 'সবার প্রাপ্য তার হাতে তুলে দেওয়া'। প্লেটো, এরিস্টটল কিংবা কান্ত—সকলেই ন্যায়ের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “ন্যায় হলো সাম্য আর মর্যাদার ভারসাম্য।” কিন্তু বর্তমান সমাজে আমরা কী দেখছি?
আইনের দৃষ্টিতে হয়তো এক বড়লোক ও দরিদ্র সমান, কিন্তু আদালতের পথ তো সমান নয়। এক পক্ষ পায় ব্যারিস্টার, আরেক পক্ষ হয়তো খুঁজে ফেরে নিঃশুল্ক আইনি সহায়তা।
ন্যায় তখন সঙ্কুচিত হয়ে দাঁড়ায় একটি প্রশ্নে—এই বিচারে সত্য আসলেই জীবিত ছিল তো?
ধর্মের আয়নায়: আইন আর ন্যায়ের ফারাক
ইসলাম বলে—“আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ৯৯টি নামে পরিচিত, তার মধ্যে একটি হলো ‘আদল’—অর্থাৎ ন্যায়।” খ্রিস্ট ধর্মে বলা হয়—“Blessed are those who hunger and thirst for righteousness.”
হিন্দু ধর্মে ধর্ম (Dharma) মানেই হলো—ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা।
বুদ্ধ ধর্মে আটগুণিক পথের অন্যতম স্তম্ভ হলো ‘সম্যক দৃষ্টি’—যা ন্যায়বিচারের অনুরণন।
এগুলো সবই বলে—কেবল আইন নয়, ন্যায়ই মানব সভ্যতার মেরুদণ্ড।
কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো—ধর্ম হয় উপাসনালয়ে বন্দি, আর ন্যায় আটকে পড়ে কোর্টের পেছনের গলিতে।
বাস্তবতার বেদনায়: যখন আইন দেখে, কিন্তু ন্যায় বোঝে না
একজন মায়ের সন্তান হত্যা হয়, মামলা চলে ১০ বছর। রায় আসে—“সাক্ষ্য নেই, খালাস।”
কিন্তু সেই মা কাকে বলবে—“আইন হয়তো সত্য বলেছে, কিন্তু আমার বুক ফাঁকা হয়ে গেছে!”
একজন গার্মেন্টস শ্রমিক যার বেতন আটকে আছে, মামলা করতে গিয়ে ঘুষ দিয়ে ফাইল চালাতে হয়।
আইন থাকে—কিন্তু ন্যায় থাকে না। কারণ, আইন দেখছে বকেয়া, ন্যায় দেখছে অবহেলিত মানুষের আর্তনাদ।
রাষ্ট্রের দায়: আইন প্রতিষ্ঠা নয়, ন্যায়ের পরিব্যাপ্তি
রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব কি কেবল আইন কার্যকর করা? না—রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব হলো: ন্যায় ও মানবিকতা নিশ্চিত করা। যেখানে মানুষ আইনের আশ্রয়ে ভয় পায় না, সান্ত্বনা পায়—সেখানেই রাষ্ট্র সফল।
জাতিসংঘ মানবাধিকার ঘোষণা (UDHR) ১০ নং অনুচ্ছেদে বলেছে: “Everyone is entitled in full equality to a fair and public hearing by an independent and impartial tribunal.” কিন্তু প্রশ্ন হলো—আমরা কি সত্যিই সমান?
আমাদের দায়: কাগজের বাইরে হৃদয়ের ন্যায় প্রতিষ্ঠা
আইনজীবী, বিচারক, আমলা, শিক্ষক, সাংবাদিক—সবার একটাই চ্যালেঞ্জ: “আমি কি কেবল প্রক্রিয়া মানি, নাকি মানবতাও বুঝি?” আমরা যদি আইনের প্রতিটি রায় লিখি অথচ ন্যায়বোধ হারিয়ে ফেলি—তাহলে আইন বই হয়ে উঠবে মিছিলের ব্যানার, যেখানে কোনো শব্দ নেই—শুধু শূন্যতা।
ন্যায়—আইনের আত্মা, মানবতার পূর্ণতা
আইন যেমন প্রয়োজন, তেমনি ন্যায়ের প্রয়োজন আরও গভীর। আইন শেখায় কীভাবে বাঁচতে হবে—আর ন্যায় শেখায় কেন বাঁচা দরকার। একটি সমাজ তখনই সত্যিকারের সভ্য হয়—যখন ন্যায় শুধু আদালতের রায়ে থাকে না, থাকে মানুষের চোখে, আচরণে, রাষ্ট্রের নীতিতে, এবং দুর্বল মানুষের কান্নায় আশ্রয়ের রূপে।
শেষ লাইন: "যেখানে আইন শেষ হয়, সেখানেই যদি ন্যায় না শুরু হয়—তবে আইন শুধু বই হয়, সমাজ হয় না।"
এম.এ.এ. বাদশাহ্ আলমগীর
Advocate
The Subordinate Courts of Bangladesh
Associated with Practice at the High Court
Legal Advisor, Apradhchokh24.com