ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৯ জুলাই, ২০২৫ ১৩:০৪ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৯০৬ বার
যেখানে আইন থামে, সেখানেই মানুষ জাগে : সব দেশে সংবিধান থাকে, আইন থাকে, আদালত থাকে—কিন্তু সব দেশে আজিজুর রহমান দুলু থাকেন না। তিনি কেবল একজন খ্যাতিমান আইনজীবী নন, তিনি এক দৃষ্টি, এক দর্শন, এক অন্তর্দৃষ্টি—যার আলোয় শুধু আইনের পথ নয়, মানবতার গলি ঘরেও আলো পড়ে। তিনি মনে করিয়ে দেন, ন্যায় কেবল বিধানে নয়, তা প্রকাশ পায় সাহসে, সহানুভূতিতে ও বিবেকের সাহচর্যে। তার আইনচর্চা যেন এক মানবিক আন্দোলন, যেখানে প্রতিটি যুক্তি একটি তীর, আর প্রতিটি বাক্য এক বিবেকের শব্দ।
প্রথম সাক্ষাৎ: আকাশের নিচে অন্তর্দৃষ্টির আলাপ : ২০১৬ সালে এক বিলম্বিত বিমানে (BG-493)—সন্ধ্যার স্নিগ্ধ আলোয় আমার প্রথম পরিচয় তাঁর সঙ্গে। তিনি তখন বিচারক। বললেন— “আমি বিচারকত্ব ছেড়ে ট্রায়াল করব। এই দেশে প্রকৃত ট্রায়াল নেই, প্রকৃত আইনজীবী নেই।” এটি ছিল না কোনো দম্ভ বা অভিযোগ, বরং এক দায়মিশ্রিত দ্রোহের উচ্চারণ। মনে হয়েছিল, কোনো এক ঘুমন্ত জাগরণের মুখোমুখি হয়েছি।
জেরা যেখানে প্রশ্ন নয়, বিবেকের ঝড় : তার জেরা যেন সক্রেটিসের প্রশ্নের মতো, প্লেটোর যুক্তির মতো, আর চাণক্যের তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণের মতো। একবার এক ম্যাজিস্ট্রেটকে বললেন— “আপনি জানেন ……….নিতে হলে উচ্চ আদালতের অনুমতি লাগে?” ম্যাজিস্ট্রেট: “জানি না।” দুলু স্যার: “আইন না জানাও এক ধরনের অপরাধ।”
আদালত স্তব্ধ। কোনো রাগ নয়—এ ছিল বিবেকের নিঃশব্দ বিস্ফোরণ। জেরায় বুয়েট শিক্ষক মিজানকে বলেছিলেন: “আপনি ফেসবুকে পোস্ট না করে আহত ছাত্রকে ২০ মিনিট আগে হাসপাতালে নিতে পারতেন। হয়তো সে বাঁচত।” এই প্রশ্ন কেবল আইনগত নয়, তা ছিল মানবিক দায়বদ্ধতার এক ঝাঁকুনি।
তিনি কেবল আইনজীবী নন—সত্যের অনুবাদক : চিকিৎসক, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট—যারাই আসেন কাঠগড়ায়, মনে হয় তিনি তাদের ভাষা জানেন, মন পড়তে পারেন। হাইকোর্টে দাঁড়িয়ে একবার বলেছিলেন: “মাই লর্ড, আপনি যা বললেন, আমি আপনার জায়গায় থাকলে হয়তো তাই বলতাম। কিন্তু বাস্তবতা ও আইন মাঝে মাঝে ভিন্ন ভাষায় কথা বলে।” এটা নম্রতা নয়, বরং প্রজ্ঞার ঋদ্ধ প্রকাশ।
কুড়িগ্রামের দীপ্তিতে ঢাকার আলো ম্লান: তিনি রাজধানীর আড়ম্বর নয়, কুড়িগ্রামের সাদামাটা বাংলোতেই থাকেন। সেখানে খোলা দরজা—অতিথির জন্য, দরিদ্রের জন্য, এবং যারা বিচার পায় না তাদের কান্নার জন্য।তিনি ছুটে যান ঢাকার হাইকোর্টে, আবার ছুটে যান গাইবান্ধা, দিনাজপুর, রংপুর,লালমনিরহাট, নীলফামারী,মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, সিলেট,মাদারীপুর—যেখানে অন্যায়, সেখানেই তার যাত্রা।
বিচারক থেকে আইনজীবী—ন্যায়ের দুই পথ, এক হৃদয় : বিচারক থাকাকালে মিথ্যা মামলায় বাদীকে জেলে পাঠিয়েছেন, অন্যায়কারী পুলিশকে সাজা দিয়েছেন। আইনজীবী হিসেবেও তিনি ভয়হীন।
আমার এনআরবিসি ব্যাংকের এক মামলায় তার পরামর্শে প্রভাবশালী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস আইনি যুক্তির বলয়ে আটকে যান, এতটাই দৃঢ়তার সঙ্গে যে, শেষে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আদালতের বাইরে মামলার মিটমাট চাইতে বাধ্য হন। ঢাকার জজকোর্টের এক বিচারক বলেছিলেন—“আপনার বিপরীতে দুলু সাহেব আছেন? তাহলে প্রস্তুতি নিয়ে আসুন। নয়তো রক্ষা নেই।”এই সম্মান ভয় থেকে নয়—এটি আসে আস্থার ভেতর জন্ম নেওয়া শ্রদ্ধা থেকে।
কেবল নিজের পেশা নয়, সমাজকেও ঋণী করেছেন : তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সনের আইনজীবী ছিলেন, আবার আওয়ামী লীগের অনেক সাবেক মন্ত্রীর মামলাও পরিচালনা করেন। কিন্তু গর্ব করেন না।কারণ, তিনি আইনজীবী নন, তিনি ন্যায়জীবী।
যে মানুষটি শোনেনও, শেখেনও : তিনি যেকোনো ভুল মেনে নেন। তিনি বলতে ভয় পান না, “এ বিষয়ে আমার জ্ঞান নেই, আপনি বললে আমি শুনতে আগ্রহী।” এই বিনয় সত্যিকারের পণ্ডিতের লক্ষণ। ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করছেন এখন। ধর্ম ও ন্যায় একসূত্রে গাঁথা—তাঁর ভাবনায়। “ন্যায় শুধু আদালতে হয় না, ন্যায় হয় বিবেকেও”—এই মন্ত্র তাঁর প্রতিটি পর্যালোচনায় প্রতিফলিত।
কঠোর মুখোশে কোমল হৃদয় : তিনি রাগ করেন—কারণ তিনি ভালোবাসেন। তিনি কঠিন—কারণ ন্যায়কে নরম হতে দেন না। সাধারণ খাবারে সন্তুষ্ট, অতিথির আপ্যায়নে অগ্রগামী। একটি কমন অভিযোগ, সাধারণ মানুষ তার কাছে পৌঁছতে পারেন না, এটি আসলে তার ব্যস্ততার কারণে, আমার অনুরোধ থাকবে তার প্রতি, যাঁরা ফি দিতে পারেন না—তাঁদের জন্য তিনি বলবেন “আমি নিজের পকেট থেকেও খরচ করতে রাজি। “ এই মহানুভবতা তার কাছে মানুষ প্রত্যাশা করে।
চিন্তার দিশারী: এক আইনচর্চার সাধক তাঁর লেখা গ্রন্থসমূহ শুধু পাঠ্য নয়, তা মানবিক অনুরণনের এক চিরন্তন পাঠশালা—
১. Criminal Law of Bangladesh
২. The Independence and Dignity of Judges and Lawyers
৩. থানায় আপনার অধিকার
৪. প্রস্তাবিত পুলিশ অধ্যাদেশ ২০০৭: নাগরিক অধিকার ও বিচারবিভাগের মৃত্যুদণ্ড
এসব বইয়ে রয়েছে সাহসের শব্দ, প্রতিরোধের ধ্বনি এবং এক নিরবিচারে রাষ্ট্রের আত্মসমালোচনা।
ব্যক্তিগত বন্ধনে মানবিক আলোকরেখা : তিনি আমার ঘরে থেকেছেন—সাধারণ খাটে, সাধারণ খাবারে। অথচ চাইলে তারকা হোটেলেই থাকতে পারতেন। তিনি পিতা—প্রেমিকের মতো, স্বামী—বন্ধুর মতো। তার জীবনের সরলতা তাকে মহান করে তোলে।
পুলিশ ও প্রশাসনের শিক্ষক : রাজশাহী সারদায় নবীন বিসিএস পুলিশ ও এসআইদের প্রশিক্ষণ দেন। তাঁর ক্লাসে শুধু আইন শেখানো হয় না, শেখানো হয়—“বিবেক কিভাবে প্র্যাকটিসে আনা যায়।”
শেষ কথা: এক দীপ্ত অন্বয়ের নাম আজিজুর রহমান দুলু: তিনি কোনো পদের পরিচয় নন—তিনি একটি নৈতিক আদর্শের জীবন্ত মূর্তি। তিনি সেই ব্যক্তি—যিনি আইনকে আদালতের কাঠামোতে সীমাবদ্ধ রাখেন না, বরং মানুষের হৃদয়ে রোপণ করেন।
শেষ পঙক্তি (সম্মানজ্ঞাপন) : “তিনি জেরা করেন সত্যের তীর দিয়ে, তিনি লেখেন বিবেকের অক্ষরে। তিনি আইন জানেন না শুধু—আইনকে বাঁচিয়ে রাখেন। তিনি পেশা নন—তিনি ন্যায়বোধের প্রতীক। তার নাম—আজিজুর রহমান দুলু।