ঢাকা, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

ভাঙা আয়নার দেশে ন্যায়: সংবিধানের পাতা বনাম জীবনের প্রতিচ্ছবি : এম.এ.এ. বাদশাহ্ আলমগীর

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ১৮ জুলাই, ২০২৫ ১৬:১৩ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৮৩৭ বার


ভাঙা আয়নার দেশে ন্যায়: সংবিধানের পাতা বনাম জীবনের প্রতিচ্ছবি : এম.এ.এ. বাদশাহ্ আলমগীর

আয়নার সামনে দাঁড়ালে রাষ্ট্র কী দেখে?

প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা দেখি মুখের রেখা, চোখের ক্লান্তি, হয়তো বিবেকের দাগ। কিন্তু যদি রাষ্ট্র আয়নার সামনে দাঁড়ায়? সে কী দেখে—সংবিধানের অলংকৃত অক্ষর, না জনগণের চোখের অশ্রু? এই প্রশ্নটি শুধু দার্শনিক নয়, এটি আমাদের সময়ের সবচেয়ে বাস্তব, প্রাসঙ্গিক এবং জরুরি প্রশ্ন।প্রতিটি সমাজের একটি আয়না থাকা উচিত—যেখানে রাষ্ট্র দেখে তার কাজের প্রতিফলন, আর মানুষ দেখে তার প্রাপ্য সম্মান ও ন্যায়ের প্রতিচ্ছবি। এই নিবন্ধ সেই ভাঙা আয়নার দিকে তাকিয়ে লেখা—যেখানে কাগজে লেখা প্রতিশ্রুতি একদিকে, আর জীবনের ক্ষতচিহ্ন অন্যদিকে।

দর্শনের পথ থেকে আদালতের চৌকাঠে: ন্যায়ের হাজার বছরের যাত্রা: 

প্লেটো বলেছিলেন, “ন্যায় তখনই প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন প্রত্যেকে নিজের কাজ সৎভাবে করে।” অ্যারিস্টটল দেখালেন, ন্যায় মানে কখনো সমান বণ্টন, কখনো অন্যায়ের সংশোধন। সিসেরো বললেন, “আইন প্রকৃতির কণ্ঠস্বর।” ইসলাম বলল—ন্যায় শুধু বিচারালয়ের বিষয় নয়, এটি ঈমানের অংশ।জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র (UDHR Art. 10) ঘোষণা করল—"Everyone is entitled to a fair and public hearing..." তবুও আজও প্রশ্ন রয়ে যায়: এই দর্শনগুলো কি মানুষের জীবনে আলো ফেলেছে, না শুধু দেয়ালে টাঙানো শ্লোগান হয়ে আছে?

সংবিধানের প্রতিশ্রুতি: ন্যায়ের সোনার হরিণ, না শূন্য প্রতিধ্বনি?

অনুচ্ছেদ ২৭: আইনের চোখে সমতা। অনুচ্ছেদ ৩১: জীবনের নিরাপত্তা ও আইনি সুরক্ষা। অনুচ্ছেদ ৩২: ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু সালমা যখন ধর্ষণের বিচার চেয়ে থানায় যায়, পুলিশ বলে—“আসামি প্রভাবশালী।”

করিমা যখন জমির কাগজ ফেরত পান ৪০ বছর পর, তখন যৌবন হারিয়ে গেছে। এইসব ঘটনা সংবিধানের শব্দকে কাঁপিয়ে তোলে। এ যেন এক আয়নার ফাঁক—যেখানে সংবিধানের কাচ চকচক করে, কিন্তু জীবনের প্রতিচ্ছবি অস্পষ্ট।

জীবনের আয়নায় ন্যায়: সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা

ন্যায় মানে শুধু রায় নয়—এটি শান্তি, সাহস, স্বীকৃতি। কৃষকের কাছে ন্যায় মানে: জমিতে প্রভাবশালীর লাঠিয়াল না আসা। নারীর কাছে ন্যায় মানে: সম্মানের সঙ্গে মাথা তুলে চলা।গরিবের কাছে ন্যায় মানে: কোর্টে গিয়ে হারিয়ে না যাওয়া। এক গবেষণায় উঠে এসেছে:৬২% মানুষ মনে করেন, আদালতে ন্যায় পাওয়া কঠিন।৭১% জানেন না, মামলা কীভাবে করতে হয়।গড় মামলা নিষ্পত্তিতে লাগে ৬ বছর। মামলা খরচ মাসিক আয়ের ৩–৫ গুণ। এই পরিসংখ্যান নয়—এগুলো ক্ষতবিক্ষত জীবনের আর্তনাদ।

যেখানে ন্যায় দেরিতে আসে, সেখানে সমাজ ধসে পড়ে

সালমা, ধর্ষণের বিচার চেয়ে ৭ বছর ধরে ঘুরছেন।সুবর্ণা, সাংবাদিকতা করতে গিয়ে নিহত, রায় আসে ৫ বছর পর। করিমা, ৪০ বছর পর জমি ফেরত পান, ততদিনে হারিয়ে গেছে পরিবার, সময়, বিশ্বাস।এই গল্পগুলো বলে দেয়—ন্যায় দেরিতে এলে তা অনেক সময় ন্যায় থাকে না।

বিচার ব্যবস্থার কণ্ঠস্বর: নিরবতা, আত্মজিজ্ঞাসা ও প্রতিবাদ

বিচারপতি বলেন: “রায় দিই, কিন্তু ন্যায় দিতে পারি কি?” পুলিশ বলেন: “লোক নেই, সময় নেই, প্রশিক্ষণ নেই।”

আইনজীবী বলেন: “আমরা কাগজের পাহাড়ে চাপা পড়ি।” নারী ভিকটিম বলেন: “৯ বছরেও বিচার নেই—তাহলে কিসের আইন?” এইসব কণ্ঠ—চিৎকার নয়, এগুলো বিচারব্যবস্থার বিবেকের ধ্বনি।

সাহিত্যে ন্যায়: হৃদয়ের আদালতে এক অনুসন্ধান

ভিক্টর হুগো: “যখন আইন পাশে দাঁড়ায় না, অপরাধ সমাজে ঘর বাঁধে।” দস্তয়েভস্কি: ন্যায়ের প্রশ্নে আত্মসংঘাতের নাটকীয় রূপ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়: “পেট খালি থাকলে কি সত্য-মিথ্যার বিচার চলে?” সাহিত্য আমাদের শেখায়—ন্যায় কেবল ধারা বা রায় নয়, এটি সমাজের প্রাণ।

আয়নার ফাঁক জোড়া লাগানোর সাহসী পথ

বিচারের সময়সীমা নির্ধারণ: "Justice delayed is justice denied"—তা যেন আইনি বাস্তবতায় প্রতিফলিত হয়।

নৈতিক আইন শিক্ষা: “ন্যায়তত্ত্ব” বাধ্যতামূলক হোক স্কুল-কলেজে।

কমিউনিটি-ন্যায় পরিষদ: প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সহজ, স্থানীয় আইনি সহায়তা।

গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা: রিপোর্টের পরে রিপোর্ট নয়, শেষ রায় পর্যন্ত সঙ্গ থাকা।

বিচার ব্যবস্থার জনমূল্যায়ন: আদালত হোক জবাবদিহিমূলক।

উপসংহার: 

আয়নায় ন্যায়ের প্রতিফলন চাই । ন্যায় যদি শুধু কাগজে থাকে—তবে তা অলংকার।জীবনে না এলে—তা প্রতারণা। আর দেরিতে এলে—তা অনেক সময় অপরাধকেই বৈধতা দেয়। আমরা চাই—ন্যায় অভিজাতদের প্রাপ্তি নয়, প্রতিটি ঘরের অধিকার হোক।

ভাবনার জন্য কয়েকটি তীক্ষ্ণ প্রশ্ন

১. আপনি জানেন কিভাবে মামলা করতে হয়? যদি না জানেন—কার দোষ? রাষ্ট্রের, না শিক্ষার? 

২. ৮ বছর পর বিচার এলে, সেটাকে কি ন্যায় বলা যায়?

৩. ধর্ষণের শিকার হলে—আপনি জানেন কী করবেন?

৪. বিচার যখন ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ ও পক্ষপাতদুষ্ট—তখন মানুষ কোথায় যাবে?

৫. আপনি আইনপন্থী, না মানবপন্থী?

৬. আপনি কি কখনো ন্যায়ের জন্য রাস্তায় নেমেছেন?

৭. “এই দেশে ন্যায় নেই”—এই কথা কি আপনার মনের ভেতর কখনো এসেছে?

৮. আপনার সন্তান কি এমন সমাজে বড় হোক, যেখানে ন্যায়ের জন্য জীবন পণ দিতে হয়?

৯. আপনি বিচারপতি হলে—৯ বছর ঝুলে থাকা ধর্ষণ মামলায় কী করতেন?

১০. ন্যায়ের অভাব কি সমাজে অপরাধ ও সহিংসতা বাড়িয়ে দেয়? আপনি কী বলেন?

শেষ পঙক্তি: "যখন আইন কেবল কাগজে বসে থাকে, আর কষ্ট খালি পায়ে হেঁটে যায়—তখন ন্যায় হয়ে পড়ে বাতাসে হারিয়ে যাওয়া এক স্তব্ধ কান্না।" Let justice not be the privilege of the powerful, but the presence in every humble home.

 

এম.এ.এ. বাদশাহ্ আলমগীর

Advocate 

The Subordinate Courts of Bangladesh

Associated with Practice at the the High Court 

Email : badshah.alamgir08@gmail.com


   আরও সংবাদ