ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১০ অগাস্ট, ২০২৫ ১৪:১৩ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৭৯২ বার
"যদি আইন সবার জন্য সমান না হয়, তবে অপরাধ করার সাহস রাষ্ট্রই দেয়।" — হান ফেই, চীনা দার্শনিক।
বিচারের ইতিহাসে এমন এক মুহূর্ত বারবার ফিরে আসে—যখন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকে না শুধু একজন অভিযুক্ত, বরং রাষ্ট্র নিজেই।কারণ ন্যায়বিচারের পাল্লা, যা মানুষের আশার প্রতীক হওয়ার কথা, তা একদিন নীরবে ঝুঁকে পড়ে একদিকের দিকে-ক্ষমতার দিকে। আইন তখন কেবল কাগজের অক্ষরে লেখা একটি শীতল শব্দ, আর ন্যায় তখন হারিয়ে যায় কণ্ঠহীন মানুষের দীর্ঘশ্বাসে। দস্তয়েভস্কি লিখেছিলেন-“যেখানে ন্যায় নেই, সেখানে আইন কেবল তামাশা।”
বাংলাদেশসহ অনেক দেশে এই পক্ষপাত দৃশ্যমান, যদিও তার ভাষা নীরব, চেহারা অস্পষ্ট।
পুলিশি তদন্ত যখন নিরপেক্ষতার বদলে ক্ষমতার দিক দেখে চলে, প্রমাণ যখন রহস্যময়ভাবে হারিয়ে যায়, মামলার রায় যখন বছরের পর বছর ধূসর ফাইলে ধূলি জমে পড়ে থাকে-তখন বোঝা যায়, রাষ্ট্রের চোখ বাঁধা নয়, বরং সে দেখছে; শুধু সবার দিকে সমানভাবে নয়। Transparency International Bangladesh সতর্ক করে বলেছে— ন্যায়বিচারের বিলম্ব কেবল ভুক্তভোগী নয়, পুরো রাষ্ট্রের নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। আইন তখন অস্ত্র নয়, ঢাল নয়—বরং নির্বাচিত মানুষের হাতে থাকা এক ক্ষমতার হাতিয়ার।
প্লেটো তাঁর Republic-এ বলেছিলেন—ন্যায়বিচার মানে প্রত্যেককে তার প্রাপ্য দেওয়া। কিন্তু যদি রাষ্ট্র নিজের প্রাপ্যের সংজ্ঞা বদলে ফেলে? তাহলে ন্যায়বিচারের কালি মুছে গিয়ে ক্ষমতার কালো ছাপ বসে যায়। অ্যারিস্টটল সতর্ক করেছিলেন—“যেখানে আবেগ যুক্তি দখল করে নেয়, আইনও পথ হারায়।” এ যেন আমাদের সময়ের প্রতিচ্ছবি— যেখানে রাষ্ট্রের অনুভূতি থাকে রাজনৈতিক দিকে, আর মানুষের যন্ত্রণা পড়ে থাকে নথির ভেতরে।
কাফকার The Trial আমাদের শিখিয়েছে—রাষ্ট্র যখন অপরাধের সংজ্ঞা বদলে দেয়, তখন একজন নির্দোষও নিজেকে অপরাধী মনে করতে শুরু করে। দস্তয়েভস্কির Crime and Punishment মনে করিয়ে দেয়—মানুষ অপরাধের চেয়ে বেশি কষ্ট পায় অনৈতিক বিচারের শীতে। রবীন্দ্রনাথ সাধারণ মঙ্গল-এ লিখেছিলেন—রাষ্ট্রের কাজ প্রতিশোধ নয়, ন্যায় প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ইতিহাস বলে—রাষ্ট্র প্রায়ই এই কথা ভুলে যায়।
কুরআন ঘোষণা করে (সূরা নিসা ৪:১৩৫)—“তোমরা ন্যায় প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় থাকো, যদিও তা তোমাদের নিজের, পিতা-মাতা বা আত্মীয়ের বিরুদ্ধে হয়।” যিশু সতর্ক করেছিলেন—“Judge not, lest ye be judged.”
সব ধর্মই বলে—ন্যায় মানে সমান মাপ। কিন্তু যখন রাষ্ট্র ধর্মকেও ক্ষমতার মঞ্চে বসায়, তখন ন্যায়ের পাল্লা আর ঈশ্বরের হাতে থাকে না, চলে যায় রাজনীতিবিদের হাতে।
স্নায়ুবিজ্ঞান জানায়—মানুষের রায় দেওয়ার ক্ষমতা bias দ্বারা প্রভাবিত হয়। বিচারক, তদন্তকারী—সবার মনেই পূর্বধারণার ছায়া থাকে। রাষ্ট্র যখন নীতি দিয়ে সেই ধারণা তৈরি করে, তখন ন্যায় হয় বন্দি।
এমিল দুর্খেইম বলেছিলেন—আইন সামাজিক সংহতির বাঁধন। কিন্তু রাষ্ট্র যখন একদলকে আঁকড়ে ধরে, আরেকদলকে ফেলে দেয়, তখন সেই বাঁধন ছিঁড়ে যায়—সমাজ ভেঙে পড়ে।
ফুকো দেখিয়েছেন—রাষ্ট্র ক্ষমতার যন্ত্র দিয়ে শুধু অপরাধ দমন করে না, বরং অপরাধের সংজ্ঞাও বানায়, পরিবর্তন করে, প্রয়োজনে মুছে দেয়।
ঐতিহাসিক শিক্ষা
নুরেমবার্গ ট্রায়াল — বিজয়ীরা বিচারক, পরাজিতরা আসামি; কিন্তু বিজয়ীর অপরাধের বিচার হয়নি।
দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাপার্টহেইড — আইনের চোখে শ্বেতাঙ্গদের অপরাধ ছিল “অদৃশ্য”।
ভারতের দিল্লি দাঙ্গা — পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা ও রাজনৈতিক ছায়া দেখিয়েছে, কিভাবে রাষ্ট্রের পক্ষপাত জনআস্থা ধ্বংস করে।
প্রশ্ন: ন্যায়বিচারের পাল্লা কার হাতে? তত্ত্বে—পাল্লা আইনের হাতে। কিন্তু বাস্তবে—রাষ্ট্রের হাতে, কারণ রাষ্ট্র আইন লেখে, প্রয়োগ করে, এবং প্রয়োজনে আইন বদলে ফেলে।
শেষ কথা: ন্যায়বিচার এক সূক্ষ্ম পাল্লা—যেখানে সামান্য পক্ষপাতও ভারসাম্য ভেঙে দেয়। রাষ্ট্র যদি নিরপেক্ষ হয়, আইন হয় আলো। রাষ্ট্র যদি পক্ষ নেয়, আইন হয় ছুরি—যা কেবল দুর্বলদের কেটে দেয়।
অ্যারিস্টটল ঠিকই বলেছিলেন— “It is not enough to pass just laws; we must ensure they are justly applied.”
আর আমি বলি— রাষ্ট্র যদি পাল্লা একদিকে ঝুলিয়ে রাখে, তবে অপরাধী কেবল আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ায় না—সে দাঁড়ায় ক্ষমতার প্রাসাদের ভেতরে, বিচারকের চেয়ারে, রাষ্ট্রের পোশাক পরে।