ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৯ ডিসেম্বর, ২০২১ ০৮:১৩ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫২১ বার
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ৫০টি থানায় প্রায় ৩১ হাজার গ্রেফতারি পরোয়ানা (ওয়ারেন্ট) ঝুলে আছে। এর মধ্যে জিআর (জেনারেল রেজিস্ট্রার) মামলার পরোয়ানা ১৯ হাজার ৫৪৭টি এবং সিআর (কোর্ট রেজিস্ট্রার) মামলার পরোয়ানা ১১ হাজার ৪৫১টি।
বিভিন্ন সময়ে আদালত এসব পরোয়ানা জারি করে তা তামিলের জন্য সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের নির্দেশ দেন।
ডিএমপি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী- চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে আদালত থেকে থানাগুলোয় চার হাজার ২৪৬টি (জিআর এক হাজার ৭১৭টি এবং সিআর দুই হাজার ৫২৯টি) গ্রেফতারি পরোয়ানা এসেছে। এ সময় এক হাজার ২২টি পরোয়ানা (জিআর ৬১১টি ও সিআর ৪১১টি) তামিল করা হয়েছে। এক হাজার ২১৮ জন জামিন নিয়েছেন।
অন্যভাবে ৯৮৬টি পরোয়ানা নিষ্পত্তি হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে জারি হওয়া গ্রেফতারি পরোয়ানাগুলোর মধ্যে এক হাজার ১০টি তামিল হয়নি। আর তামিল না হওয়া পুরোনো (জানুয়ারির আগে থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত) গ্রেফতারি পরোয়ানার সংখ্যা ২৮ হাজার ৮৮টি। সব মিলিয়ে মুলতবি (ঝুলে থাকা) গ্রেফতারি পরোয়ানার সংখ্যা ৩০ হাজার ৯৯৮টি।
গ্রেফতারি পরোয়ানা ঝুলে থাকার পেছনে পুলিশের আন্তরিকতার অভাবকেই দায়ি করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে পুলিশ জানায়, প্রতি মাসে যে পরিমাণ গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিল করা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি নতুন পরোয়ানা আসে। এ কারণে বিপুলসংখ্যক পরোয়ানা ঝুলে থাকছে। বিচারপ্রার্থীদের অভিযোগ, পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরোয়ানাপ্রাপ্ত আসামিরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
অথচ পুলিশ তাদের খুঁজে পাচ্ছে না। তাদের আরও অভিযোগ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরোয়ানা জারির পর কালক্ষেপণের মাধ্যমে আসামিকে জামিনে সহযোগিতা করছে পুলিশ। গ্রেফতারি পরোয়ানাভুক্ত আসামির সঙ্গে ছবিও তুলছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। ওইসব ছবি দেওয়া হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) আব্দুল্লাহ আবু বলেন, পরোয়ানাপ্রাপ্ত আসামিদের গ্রেফতার এড়িয়ে চলছে পুলিশ। এ কারণে আসামিরা আদালতে হাজির হচ্ছে না। তাই বিচার বিলম্বিত হচ্ছে। প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তিও দেওয়া যাচ্ছে না। যেসব পরোয়ানা তামিল করা যাচ্ছে না- সেসব বিষয়ে পুলিশের উচিত আদালতে প্রতিবেদন দেওয়া। সংশ্লিষ্ট আসামিদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে প্রতিবেদন দেওয়া উচিত।
এ ক্ষেত্রে আদালত আসামির অনুপস্থিতিতে বিকল্প পদ্ধতিতে বিচারকাজ শুরু করতে পারেন। প্রতিবেদন না দেওয়ায় আদালত বুঝতে পারছেন না, পরোয়ানাপ্রাপ্ত আসামির অবস্থান কী? আসামির কাছে পরোয়ানা পৌঁছল কিনা তাও আদালত জানতে পারছেন না। থানায় বছরের পর বছর পরোয়ানা পড়ে থাকতে পারে না বলেও রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান পিপি অভিমত প্রকাশ করেন।
সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মো. মঈদুল ইসলাম বলেন, পরোয়ানা তামিলের বিষয়টি পুলিশ প্রশাসনে একটি অবহেলার জায়গা হিসাবে বিবেচিত। পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিষয়টি যথাযথভাবে মনিটরিং করেন না। নিম্ন পর্যায়ের সদস্যদের কাছে পরোয়ানার আদেশগুলো পড়ে থাকে। সাধারণত ওয়ারেন্ট তামিলের জন্য এসআই, এএসআই ও কনস্টেবলদের নামে হাওলা করা (দায়িত্ব দেওয়া) হয়।
এরপর সেগুলো আর ফেরত আসছে না। এ বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, আসামিদের সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যের সমঝোতা হয়। এ কারণে পরোয়ানা তামিল হচ্ছে না। এতে বিচারকাজে দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায়, মামলার প্রাথমিক পর্যায়েও অনেকের নামে পরোয়ানা জারি করা হয়। পরোয়ানা তামিল না হলে প্রাথমিক পর্যায়েই মামলা আটকে যায়। চার্জশিটের পর পরোয়ানা তামিল না হলে সে পর্যায়েই মামলা আটকে থাকে। এ ক্ষেত্রে বিচারকাজ শুরু করাই সম্ভব হয় না।
তিনি আরও বলেন, আমি যখন বিচারক ছিলাম তখন পরোয়ানা তামিলের জন্য পুলিশকে বারবার তাগিদ দিয়েছি। এর পরও ফলাফল আসত না। বিষয়টি নিয়ে আইজিপির কাছেও লিখেছি। এতেও কাজ হয়নি। সংশ্লিষ্ট পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ করায় কিছুটা কাজ হয়েছে। তিনি বলেন, দেশে মামলা কেবল বাড়ছেই। কিন্তু পরোয়ানা তামিল না হওয়ায় মামলার নিষ্পত্তি আটকে থাকছে। তাই এ জায়গায় দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে নিযুক্ত করতে হবে।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, পুলিশের মিরপুর বিভাগে (ছয় হাজার ৪৮৫টি) সবচেয়ে বেশি জিআর মামলার পরোয়ানা ঝুলে আছে। আর উত্তরা বিভাগে (৭২টি) সবচেয়ে কম জিআর পরোয়ানা রয়েছে। মিরপুর বিভাগেও (৩৩৫টি) সবচেয়ে বেশি সিআর পরোয়ানা রয়েছে। অন্য দিকে তেজগাঁও বিভাগে (১৪২টি) সবচেয়ে কম সিআর পরোয়ানা রয়েছে। মোট হিসাবে (জিআর ও সিআর) তেজগাঁও বিভাগে সবচেয়ে বেশি পরোয়ানা ঝুলে আছে। এখানে মোট মুলতবি পরোয়ানার সংখ্যা নয় হাজার ২৮০টি। আর সবচেয়ে কম মুলতবি পরোয়ানার সংখ্যা উত্তরা বিভাগে (৮৯২ টি)।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারের উপকমিশনার ফারুক হোসেন বলেন, গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিল করা একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রতিদিন যে পরিমাণ পরোয়ানা তামিল করা হয়, তার চেয়ে তিনগুণ নতুন পরোয়ানা আসে। এ কারণে ডিএমপির ৫০টি থানায় বিপুল পরিমাণ পরোয়ানা ঝুলে আছে। এসব পরোয়ানা কীভাবে দ্রুত তামিল করা যায়, সে বিষয়ে পরবর্তী ক্রাইম কনফারেন্সে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের তাগিদ দেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরোয়ানাপ্রাপ্ত কোনো আসামির সঙ্গে পুলিশ সদস্যদের যোগসাজশের প্রমাণ পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ডিএমপির উপকমিশনার (ওয়ারী বিভাগ) শাহ ইফতেখার আহমেদ বলেন, আদালত থেকে যে পরোয়ানা জারি করা হয়, আমরা সেসব তামিলের চেষ্টা করি এবং সব সময়ই সে প্রচেষ্টা থাকে। আসামিকে গ্রেফতারের পর আমরা আদালতে সোপর্দ করি। এ কারণে আমরা সাধারণত আসামি গ্রেফতারের আগে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করি না। তবে কোনো ক্ষেত্রে আসামি খুঁজে না পেলে আদালতকে অবগত করা হয়।
জানা গেছে, রাজধানীর উত্তরখান থানার ভাতুরিয়া কাঁচকুড়া এলাকার কামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে ২ জানুয়ারি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন এনামুল হক খান সহিদ। এ মামলায় ৬ সেপ্টেম্বর কামালের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন। কিন্তু পুলিশ এখনো তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
এ বিষয়ে মামলার বাদী এনামুল হক খান সহিদ বলেন, কামাল উদ্দিন আমার বিরুদ্ধে মানহানিকর বক্তব্য ফেসবুক ও ইউটিউবে আপলোড করেন। ফরেনসিক পরীক্ষায় বিষয়টি প্রমাণিত হয়। আদালত প্রায় তিন মাস আগে কামালের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। কিন্তু পুলিশ তাকে গ্রেফতার করছে না।
অথচ সভা-সমাবেশে পুলিশের সঙ্গে তাকে দেখা যায়। ২৮ নভেম্বর উত্তরখান কাঁচপুরা কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে কামাল উদ্দিন প্রকাশ্যে বক্তব্য দেন। এ সময় পুলিশের উত্তরা বিভাগের ডিসি এবং ওসিসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। অথচ তাকে গ্রেফতারের কথা বলা হলে, সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্য বলেন- ‘তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
এ বিষয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানাপ্রাপ্ত আসামি কামাল উদ্দিন বলেন, আমার বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করা হয়েছে। বিধিবহির্ভূতভাবে মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। আমি দেশের বাইরে ছিলাম। এ সুযোগে আমার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। বিষয়টি ঠিক হয়ে যাবে।
পুলিশের উত্তরা বিভাগের ডিসি মোরশেদ আলম বলেন, পরোয়ানাভুক্ত আসামিকে গ্রেফতারের কোনো বিকল্প নেই। কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে যে পরোয়ানা আছে তা আমার জানা ছিল না। এ কারণে হয়তো আমার সামনে তিনি (কামাল) বক্তব্য দিয়েছেন। তাকে দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে।
সূত্র : যুগান্তর