ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

আমদানিতেও ধুন্ধুমার চোরাচালান

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর, ২০২১ ০৯:৫৮ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫১০ বার


আমদানিতেও ধুন্ধুমার চোরাচালান

স্বর্ণ আমদানি রেকর্ড ভাঙছে। চোরাচালান হয়ে আসাও রয়ে গেছে আগের মতো। বৈধ, অবৈধ পথে যত স্বর্ণ দেশে ঢুকছে এত চাহিদা স্থানীয়ভাবে নেই। এর বড় অংশই দেশ থেকে বাইরের দেশে পাচার হচ্ছে। আর পুরো অপতৎপরতায় জড়িয়ে আছে অনেক সিন্ডিকেট আর প্রভাবশালীদের নাম।

বৈধ আমদানির অনুমোদনের পরও দেশে স্বর্ণের ব্যবসা চোরাচালাননির্ভরই রয়ে গেছে। এক সময়ের ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চোরাই স্বর্ণের প্রধান রুট হলেও দিনেদিনে ট্রানজিট হয়ে উঠছে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর। এর পাশাপাশি সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়েও ঢুকছে চোরাই স্বর্ণ। বৈধ পথে যাত্রীরা স্বর্ণ আমদানি করলেও অবৈধ পথে এখনও সক্রিয় আছে বড় সিন্ডিকেট।
 
এ সিন্ডিকেটে রয়েছে চট্টগ্রামের রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়ির চক্রসহ আরও কয়েকটি গ্রুপ। চক্রে নেতৃত্ব দেওয়া আবু আহম্মদ নামের এক ব্যক্তিসহ ১২ জন জেলে থাকলেও তাদের লোকজন এ কারবার দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে তার ২৪ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্ব্বর্ণ চোরাচালানের সাড়ে চারশ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে সিআইডি। কসমেটিকস ও ইলেকট্রনিকস সামগ্রীর আড়ালে এ লেনদেন হয় বলে নিশ্চিত হয়েছে সিআইডি। ইতোমধ্যে আবুসহ ১২ চোরাকারবারিকে গ্রেপ্তারও করে তারা। আটকদের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যদের নামও।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা   বলেন, এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে 'ম্যানেজ' করেই দীর্ঘ দিন শাহজালাল বিমানবন্দর ঘিরে চোরাই স্বর্ণের ব্যবসা রমরমা ছিল। বিমানবন্দরে দায়িত্বরত সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের এই বার্তা দেওয়া হয়- চোরাই স্বর্ণ বিমানবন্দর হয়ে ঢুকলে এর পুরো দায়ভার তাদের নিতে হবে। এমনকি চোরাই স্বর্ণ ধরা পড়লেও এর নেপথ্যে কারা রয়েছেন তাও বলতে হবে। এমন কঠোর বার্তার পর শাহজালাল বাদ দিয়ে চট্টগ্রাম ও সিলেটকে রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

চট্টগ্রামের কাস্টমস কমিশনার ফখরুল আলম বলেন, 'বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানি বেড়েছে। কিন্তু অবৈধ পথেও স্বর্ণ আসছে। আগের তুলনায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ অনেক বেশি সতর্ক। তাই একের পর এক চালান ধরাও পড়ছে চোরাকারবারিদের।' শুল্ক গোয়েন্দা চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপপরিচালক একেএম সুলতান মাহমুদ বলেন, 'স্বর্ণ পাচারের ঘটনায় মূলত বাহকদেরই ধরা হচ্ছে। গডফাদাররা আড়ালে থাকছেন। তবে আগের তুলনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেক সজাগ আছে এখন। এ জন্য নিত্যনতুন কৌশল নিতে হচ্ছে চোরাকারবারিদের।'

সিআইডির পুলিশ সুপার শাহ নেওয়াজ খালেদ বলেন, স্বর্ণ উদ্ধারের পর মামলা হয় সংশ্নিষ্ট থানায়। এজাহারের সূত্র ধরে তদন্ত হয়। কেন মূল হোতারা আসামি হন না এটা সংশ্নিষ্ট থানা বলতে পারবে। আবু আহমেদসহ কয়েকজন হোতাকে চিহ্নিত করে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। তবে কোনো মামলার রায় হয়নি।

স্বর্ণ চোরাচালানের ট্রানজিট পয়েন্ট চট্টগ্রাম: স্বর্ণ চোরাচালানের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে চট্টগ্রাম। বিদেশ থেকে আসা স্বর্ণ চট্টগ্রাম হয়ে যাচ্ছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এভাবে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহারের সময় বেশ কিছু স্বর্ণের চালান আটকও করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ব্যাগেজ রুলের আওতায় একজন যাত্রী বৈধভাবে শুল্ক দিয়ে সর্বোচ্চ ২০ ভরি বা দুটি সোনার বার আনতে পারেন। এজন্য প্রতি ভরিতে (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) শুল্ক দিতে হয় ২ হাজার টাকা। স্বর্ণের বারের বাইরে ১০০ গ্রাম ওজনের (প্রায় সাড়ে আট ভরি) স্বর্ণালঙ্কার আনতে পারবেন বিনা শুল্কে। এটিরও সুযোগ নিচ্ছে অপরাধী চক্র। বিদেশ থেকে আসা যাত্রীর কাছেও স্বর্ণ দিচ্ছেন তারা। দেশে আসার পর কাস্টমস পার হওয়ার পরই ওই স্বর্ণ সিন্ডিকেটের হাতে চলে যাচ্ছে। এ কারণে বৈধ ও অবৈধ উভয় পথে আসছে স্বর্ণ। বিদেশ থেকে চট্টগ্রামে এসে এসব স্বর্ণ আবার পাচার হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। চলতি বছর প্রায় আট টন স্বর্ণ বৈধ পথে আমদানি হয়েছে। এটি অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। বৈধ পথে আসা এসব স্বর্ণও চট্টগ্রাম হয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশে।

বারবার চোরাচালানের ঘটনা ঘটছে বাংলাদেশ বিমানে: দুবাই থেকে চট্টগ্রামে আসা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটের দুটি আসনের নিচ থেকে সাত কোটি টাকার ১০ কেজি ওজনের স্বর্ণবার উদ্ধার করেছেন কাস্টমস গোয়েন্দারা। গতকাল শনিবার সকালে গোপন খবরের ভিত্তিতে তল্লাশি অভিযান চালিয়ে স্বর্ণগুলো উদ্ধার করা হয় বলে জানান শুল্ক গোয়েন্দা চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপপরিচালক একেএম সুলতান মাহমুদ। তিনি জানান, যাত্রীরা নেমে যাওয়ার পর ফ্লাইটটিতে তল্লাশি করা হয়। এ সময় দুটি সিটের নিচে স্বর্ণের বারগুলো পাওয়া যায়। উদ্ধার করা স্বর্ণের দাম প্রায় ৭ কোটি টাকা বলে জানান ওই কর্মকর্তা। এর আগেও ঘটেছে একই ঘটনা। চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে ১০ কোটি টাকা দামের দেড়শ পিস স্বর্ণের বার বিশেষ কায়দায় বিমানের সিটের নিচে লুকানো অবস্থায় উদ্ধার করেছে কাস্টমস, শুল্ক গোয়েন্দা ও এনএসআই। এর আগে গত ১৫ অক্টোব চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুবাই থেকে আসা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিজি১৪৮ ফ্লাইটের আসনের নিচ থেকে ১৬০টি স্বর্ণের বারের চালান জব্দ করা হয়েছে।

এক বছরে জব্দ সাড়ে ৫ মণ: ২০২১ সালে এখন পর্যন্ত মোট কী পরিমাণ স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে, তা গতকাল তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেনি কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। তবে ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে ২২০ কেজি অর্থাৎ সাড়ে ৫ মণ স্বর্ণ জব্দ করা হয়। এ সময় যাত্রীসহ সাতটি স্বর্ণের চালান আটক করা হয়। এসব ঘটনায় পতেঙ্গা থানায় একাধিক মামলাও হয়েছে। কিন্তু কোনো মামলাতেই চিহ্নিত করা হয়নি স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত গডফাদারকে। শুধু বহনকারীকেই আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দিচ্ছে পুলিশ। ২০২০ সালেও স্বর্ণের বেশ কয়েকটি চালান শাহ আমানত বিমানবন্দরে ধরা পড়েছে। ১৯ জানুয়ারি এয়ারক্রাফট গেটের কাছে বোর্ডিং ব্রিজ থেকে ৬ কেজি ৮৪ গ্রাম ওজনের ৫২টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে আবুধাবি থেকে আসা যাত্রী মোহাম্মদ সরওয়ার উদ্দিনের জুতায় লুকানো ৪টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই টিম। ১৩ জানুয়ারি শারজাহ থেকে আসা যাত্রী মোহাম্মদ মোরশেদের পেট থেকে এক কেজি ওজনের আটটি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়।

চোরাই স্বর্ণের গুদাম রেয়াজউদ্দিন বাজারে: নগরীর রেয়াজউদ্দিন বাজার, তামাকমুণ্ডি লেন এলাকায় বিভিন্ন মার্কেটের ওপর কক্ষ ভাড়া নিয়ে অবৈধ স্বর্ণের গুদাম বানিয়েছে চোরাচালানিরা। বিমানবন্দর দিয়ে আসা চোরাচালানের স্বর্ণ প্রথমে এসব গুদামে জমা হয়। এরপর সেখান থেকে দেশের বাজারে যায় এবং বিদেশে পাচার হয়। রেয়াজউদ্দিন বাজারকেন্দ্রিক দুটি চোরাচালান সিন্ডিকেট এই অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তারাই মূলত রেয়াজউদ্দিন বাজারে গুদাম ভাড়া নিয়ে গড়ে তুলেছে অবৈধ স্বর্ণের ভান্ডার। এর মধ্যে একটিতে নেতৃত্ব দেন ব্যবসায়ী আবু আহম্মেদ। আরেকটিতে নেতৃত্ব দেন হাকিম ও সাত্তার নামে দু'জন।

মামলায় আসামি হয় না গডফাদাররা: দুবাই থেকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে আসা একটি ফ্লাইটের সিটের নিচ থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ১০ কোটি টাকার ১৫০টি স্বর্ণবার উদ্ধার করে কাস্টমস। বিপুল পরিমাণ স্বর্ণবার উদ্ধারের পরও কোনো ফৌজদারি মামলা দায়েরের রাস্তায় যায়নি কাস্টমস। একটি সাধারণ ডায়েরি করেই দায় সেরেছে তারা। অথচ চট্টগ্রাম মহানগর পিপি অ্যাডভোকেট ফখরুদ্দিন চৌধুরী বলছেন, বিমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় সিটের নিচে স্বর্ণ বার পাওয়ার অর্থই হলো বিমানে থাকা কেউ না কেউ এ স্বর্ণ বারগুলো বিদেশ থেকে এনেছেন। এ ঘটনায় নিয়মিত ফৌজদারি মামলা হওয়া উচিত ছিল। মামলা হলে পুলিশ কিংবা সিআইডি তদন্ত করে ঘটনা খতিয়ে দেখতে পারত।

চোরাচালান চক্রে আরও আছে যারা: স্বর্ণ চোরাচালানের জন্য চট্টগ্রামকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছে লোহাগাড়ার আমিরাবাদের মোহাম্মদ আলি, হাবিবুর রহমানের ছেলে ফরিদুল আলম, ফটিকছড়ির জাফতনগরের মৃত নুর মোহাম্মদের ছেলে আবু রাশেদ, চন্দনাইশের হাসিমপুরের আবদুল ছালাম চৌধুরীর ছেলে ইমরানুল হক মো. কফিল চৌধুরী, দক্ষিণ রসাংগিরি মো. হানিফের ছেলে ওবায়দুল আকবর, জাহানাপুরের মো. জমিলের ছেলে জিয়া উদ্দিন বাবলু, আনোয়ারার রূপায়ন মহাজনের ছেলে সাগর মহাজন ঢাকার ওয়ারীর ইসহাক হোসেনের ছেলে এমতিয়াজ হোসেন, শামশুল ইসলামের ছেলে মোহাম্মদ এরশাদল আলম, লোহাগাড়ার চুনতির গুরা মিয়ার ছেলে মো. হাসান, কোতোয়ালির হাজারী লেনের অমূল্য রঞ্জন ধরের ছেলে টিটু ধর ও নগরীর কোতোয়ালি রনজিত চক্রবর্তীর ছেলে রুবেল চক্রবর্তী।

সূত্র : সমকাল


   আরও সংবাদ