ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

‘ক্যাশব্যাকের’ নামে ভয়াবহ প্রতারণা

আড়াইশ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ৫ জানুয়ারী, ২০২২ ১০:২২ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫২৮ বার


‘ক্যাশব্যাকের’ নামে ভয়াবহ প্রতারণা

সিলেটে ‘ক্যাশব্যাক’-এর নামে ভয়াবহ প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। ‘আঁখি সুপার শপ’ নামের একটি অনলাইন মার্কেটিং প্রতিষ্ঠান ‘একটি কিনলে একটি ফ্রি’ অর্থাৎ ‘শতভাগ ক্যাশব্যাক’ প্রলোভন দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেছে।

এরই মধ্যে গ্রাহকদের প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার শারমিন আঁখি ও জাহাঙ্গীর আলম পালিয়ে গেছেন। এ ঘটনা জানাজানি হলে গ্রাহকরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। টাকা উদ্ধারে তারা নানা জায়গায় ধর্ণা দিচ্ছেন। কেউ কেউ মামলাও করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে যুগান্তরের অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘আঁখি সুপার শপ’ নামে অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা শুরু করেন শারমিন আঁখি (২৬) ও জাহাঙ্গীর আলম (৩১)। আঁখি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান। তিনি রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার গণিপুর (হাসনিপুর) গ্রামের আশরাফ হোসেনের মেয়ে। আর জাহাঙ্গীর প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার পুন্ডুরিয়া গ্রামের সোলাইমান হোসেনের ছেলে। আঁখি ও জাহাঙ্গীর নিজেদের স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিলেও এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পেজ খুলে আঁখি সুপার শপ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা শুরু করে। এরপর ২০২১ সালের শুরুতে সিলেট মহানগরীর বটেশ্বর এলাকার গাইলাপাড়ার রাকিব ম্যানশনের নিচতলায় প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে নানা সময় ৪৫, ৩০, ৯০ দিনের একাধিক প্যাকেজ অফার হয়েছে। এসব প্যাকেজে একটি পণ্য কিনলে আরেকটি পণ্য ফ্রি দেওয়া হতো। এসব অফারে অংশ নিয়ে অনেক গ্রাহক একটি পণ্য কিনে আরেকটি একই পণ্য বিনামূল্যে পেয়েছেন। এ অফারের মধ্যে মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোনসেটসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস ও মুদি পণ্য থাকত।

একাধিক গ্রাহক জানান, আঁখি সুপার শপ গত বছরের ১৩ নভেম্বর থেকে এ ধরনের একটি অফার দিয়ে ফেসবুকে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। এতে প্রলুব্ধ হয়ে পাঁচ শতাধিক গ্রাহক মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন পণ্য কিনতে টাকা জমা দেন। বিশ্বাস অর্জনের জন্য অধিকাংশ গ্রাহকের টাকা প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে গ্রহণ করত। এভাবে দুই-আড়াইশ কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানটি জমা নিয়েছে বলে জানিয়েছেন গ্রাহকরা। সবকিছু ভালোই চলছিল। ২৭ ডিসেম্বর আঁখি সুপার শপ বন্ধ করে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা পালিয়ে যান। খবর পেয়ে গ্রাহকরা সেখানে বিক্ষোভ করেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির দুটি কার্যালয় বন্ধ রয়েছে। কর্ণধারদেরও কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এদিকে, ২৯ ডিসেম্বর ‘আঁখি সুপার শপ’র ফেসবুক পেজে এক পোস্টে জানানো হয়-‘পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণে সাময়িকভাবে আঁখি সুপার শপ বন্ধ রাখা হয়েছে। আপনারা কেউ বিভ্রান্ত হবেন না। একটু ধৈর্য রাখুন...। আমরা আছি... প্লিজ আমাদের কেউ ভুল বুঝবেন না...।’ সোমবার সকালে আরেকটি পোস্টে জানানো হয়-‘আমরা চাইলেও নিরাপত্তাহীনতায় সিলেটে আসতে পারছি না। আমরা চাই-একটা সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি হোক। আর আপনারাই পারেন সেই পরিবেশ তৈরি করতে। সেদিন সিলেট থেকে ঠিক সময়ে বের হয়ে আসতে না পারলে পরদিন আমাদের লাশ বের হতো। আমাদের কাছে দুই কোটি টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। টাকা না দিলে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। অথচ মাসের শুরুতে ১ কোটি টাকা দিয়েছিলাম....। নিজের প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মাসে মাসে এভাবে আমাকে কোটি টাকা দিতে বাধ্য করা হয়েছে। এভাবে গত এক বছরে ১০ কোটি টাকা আমার কাছ থেকে বিভিন্ন উপায়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে...। এক বছর আমরা কী নিখুঁতভাবে কাজ করে আসছি, আপনারা তার সাক্ষী ছিলেন...। ডেলিভারি সব সময় দু-চার দিন কখনো এক সপ্তাহ আগেও পেয়েছেন। টাইম কখনো পার হয়নি...। আজকে আমরা বিপদে পড়েছি, কে বা কারা আমাদের বিপদে ফেলল-আপনারা একবারও বুঝতে চাইলেন না...। উলটা প্রতারক বলছেন! এতো সার্ভিস নিয়েছেন কখনো কেউ বলতে পারবেন-আমাদের সার্ভিসে আপনারা অসন্তুষ্ট ছিলেন। নিজের মনকে একবার প্রশ্ন করুন! আমরা একটা সমঝোতা চেয়েছিলাম। এ কারণে এসপি-ডিসিদের কাছেও গিয়েছিলাম। আমরা একটু সময় চাই...। আর এ সময়টা আপনারা চাইলেই দিতে পারেন...। আমাদের উদ্দেশ্য কখনোই অসৎ ছিল না...। আপনারা চাইলেই আঁখি সুপার শপ আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারে। আমরা চাই আপনাদের প্রাপ্য আপনাদের সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতে। বাকিটা আপনাদের ইচ্ছা...।’ তবে পোস্টে হুমকিদাতা বা কারা চাঁদা নিয়েছে বা চাইছে কারো নাম-পরিচয় কিছুই বলা হয়নি।

পোস্টের সত্যতা নিশ্চিতের জন্য সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) সোহেল রেজা - বলেন, বেশ কিছু দিন আগে আঁখিসহ দুজন লোক এসেছিলেন। তাদের কিছু পণ্য ডেলিভারি দিতে সময় লাগছে, গ্রাহকদের বুঝাতে পারছেন না। গ্রাহকদের থানায় ডেকে নিয়ে সময় দেওয়ার জন্য তারা বলেন।

সোহেল রেজা জানান, এটি পুলিশের কাজ নয় বলে তাদের জানানো হয়েছে। কেন পণ্য ডেলিভারি দিতে পারছেন না জানতে চাইলে তারা বলেন-তাদের কিছু টাকা কয়েকজন টাউট-বাটপারের কাছে আটকে আছে। যারা টাকা আটকে রেখেছে তাদের নামে অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপর থানায় আর তারা আসেননি।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে আঁখি সুপার শপের তিনটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলো হলো-ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের জিন্দাবাজার শাখা, এনআরবিসি ব্যাংকের বটেশ্বর শাখা এবং ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের জিন্দাবাজার শাখা। বর্তমানে এসব অ্যাকাউন্টে লাখ টাকাও নেই। সিলেট ত্যাগ করার আগের দিন আঁখি ও জাহাঙ্গীর সব টাকা তুলে নিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে শহরতলির বটেশ্বর এলাকার একটি হাউজিংয়ে দুটি প্লট ও সিলেট-০০০৭/ও নাম্বারের একটি নতুন সাদা রঙের কার কেনারও খবর পাওয়া গেছে। কারটি রাজশাহীর একটি হোটেলের আন্ডারগ্রাউন্ডে রয়েছে।

এ ঘটনায় রোববার সিলেট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম আদালতে দুই গ্রাহক প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করেছেন। তারা হলেন-শহরতলির শাহপরাণ উপশহর এলাকার বাসিন্দা জিয়াউর রহমান ও আশরাফ হোসেন। বাদীপক্ষের আইনজীবী ফয়সাল আহমেদ জানান, আশরাফ নয় লাখ ৬১ হাজার ৭২০ টাকা এবং জিয়াউর তিন লাখ সাত হাজার ২০০ টাকা প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, এরকম শতাধিক গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। মামলাটির তদন্তের জন্য আদালত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছেন। দুটি মামলাতেই আঁখি ও জাহাঙ্গীরকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও চার থেকে পাঁচজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।

মঙ্গলবার ব্যারিস্টার আবুল ফজল চৌধুরী  জানান, ৮০ লাখ ৮৩ হাজার টাকার প্রতারণার শিকার হয়ে ১০ জন গ্রাহক একই আদালতে মামলা করেছেন। এর মধ্যে বাবলু মিয়া ৩২ লাখ ১২ হাজার ৭০০ টাকা ও হারুনুর রশিদ ভূঁইয়া ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ৩১১ টাকার প্রতারণার মামলা করেছেন। বিষয়টি আদালতের কাছে তুলে ধরলে মামলা গ্রহণ করে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এ দুটি মামলায় আঁখি ও জাহাঙ্গীর ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন-তাদের ঘনিষ্ঠজন বটেশ্বর এলাকার সালাম কবিরাজ, ব্যবসায়ী সহযোগী পীরেরবাজারের ইভা স্টোরের মালিক ফয়জুল হক, আঁখি সুপার শপের কর্মচারী পান্না বেগম ও ড্রাইভার হালিম মিয়া।

আঁখি ও জাহাঙ্গীরের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। সোমবার প্রতিষ্ঠানটির পেজে ম্যাসেজ দিলে ফিরতি ম্যাসেজে বলা হয়-‘আমাদের সঙ্গে যোগাযোগে জন্য ধন্যবাদ, আমরা আপনার বার্তা পেয়েছি এবং আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে।’ তবে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ যোগাযোগ করেননি।


   আরও সংবাদ