ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৮ জানুয়ারী, ২০২২ ০৮:৩৯ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫৭৩ বার
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে মাত্র এক ঘণ্টায় যাওয়ার জন্য বুলেট ট্রেনের যে ঘোষণা চার বছর আগে রেল কর্তৃপক্ষ দিয়েছিল সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা প্রণয়নের পর এখন সে প্রকল্প থেকে সরে এসেছে রেল মন্ত্রণালয়।
দু'হাজার সতের সালে প্রকল্পটির অনুমোদনের পর প্রায় শত কোটি টাকা ব্যয় করে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর রেল মন্ত্রণালয় এখন মনে করছে, এই মেগা প্রকল্পে হাত দেয়ার আগে বর্তমান সিঙ্গেল লাইনগুলোকে ডাবল লাইনে রূপান্তরসহ চলমান প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করতে হবে।
রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন অবশ্য দাবি করছেন যে বুলেট ট্রেন প্রকল্পটি একেবারে বাতিল হয়ে যায়নি। আমরা সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশার কাজ শেষ করেছি। প্রথমে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ও পরে তা কক্সবাজার পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে। কিন্তু এই প্রকল্পে হাত দেয়ার আগে আমাদের কিছু স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হবে।
রেল মন্ত্রণালয় এ মূহুর্তে কয়েকটি বিশেষ প্রকল্পের কাজ করছে যার মধ্যে আছে পদ্মা সেতু রেল লিংক প্রকল্প, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার-রামু হয়ে ঘুনধুম পর্যন্ত ব্রডগেজ রেললাইন, লাকসাম-আখাউড়া ব্রডগেজ লাইন, টঙ্গী আখাউড়া ব্রডগেজসহ বেশ কিছু সিঙ্গেল লাইন ডাবল লাইনে রূপান্তরের কাজ চলছে।
মন্ত্রী বলছেন, এসব প্রকল্প শেষ করে বুলেট ট্রেনের মতো মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু করতে যেন সমস্যা না হয় সেজন্যই বুলেট ট্রেন ও লাইনের সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশার কাজ করে রাখা হয়েছে।
যদিও গণপরিবহন বিশ্লেষক ও বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক শামসুল হক বলছেন, প্রজেক্টটাই ছিল একটা চাপানো প্রজেক্ট যা এসেছিল পেছনের দরজা দিয়ে। বুলেট ট্রেন তো ইলেক্ট্রিফিকেশনের দ্বিতীয় ধাপ। বাংলাদেশ তো প্রথম ধাপই এখনো শুরু করতে পারেনি। আর বুলেট ট্রেন করে দিনে ১০ থেকে ১২টি ট্রিপ না দিতে পারলে এটা কি ব্যয় সংকুলান করতে পারবে? আবার দিনে ১০ থেকে ১২টি ট্রিপ দেয়ার মতো যাত্রী বাংলাদেশে আছে এখন?
কী ছিল বুলেট ট্রেন পরিকল্পনায় এমন প্রশ্ন শামসুল হকের।
দু'হাজার ষোল সালে ৩০-বছর মেয়াদী যে মহাপরিকল্পনা রেল বিভাগ করেছিল তাতে বুলেট ট্রেন প্রকল্প না থাকলেও ২০১৭ সালের দিকে এটি আলোচনায় আসে।
এক পর্যায়ে সরকারের কাছ থেকে প্রাথমিক অনুমোদনের পর সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশার কাজ করা হয় প্রায় ১১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে।
এর মধ্যেই নকশার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলে আসে যেখানে দেখা যায় কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন স্টেশন নির্মাণও ছিল এ প্রকল্পের পরিকল্পনায়।
এরপর ২০১৮ সালে চীনা একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে সমঝোতাও হয় যা পরে আবার বাতিলও হয়ে যায়।
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মোট ৩৫০ কিলোমিটার উড়ালপথে পাথর বিহীন ট্র্যাক দিয়ে বুলেট ট্রেন চলার কথা।
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী ও চট্টগ্রামের পাহাড়তলিতে মোট পাঁচটি স্টেশন করার কথা যেগুলো আসলে মাল্টি মোডাল ট্রানজিট হাব হিসেবে ব্যবহৃত হবার কথা।
গত বছর জানুয়ারিতে মন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেছিলেন বিশদ ডিজাইন প্রণয়নের সাথে জড়িতরা। তখন বলা হয়েছিল যে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত যেতে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা পনের মিনিট সময় লাগবে।
আর প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের ব্যয় ঠিক হয়েছিল প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। যদিও চূড়ান্ত ব্যয় নির্ধারণ করার কথা ছিল নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পর।
তখন আরো বলা হয়েছিল যে, ইলেকট্রিক ট্র্যাকশনের মাধ্যমে হাইস্পিড এ রেল প্রকল্পের জন্য বেশ কিছু দেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
প্রসঙ্গত, এখন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের রেলপথে দূরত্ব ৩২৫ কিলোমিটার। রেল এখন ঢাকা থেকে গাজীপুর হয়ে ঘুরে ভৈরব, লাকসাম হয়ে চট্টগ্রাম থেকে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে।
বুলেট ট্রেনের জন্য ঠিক করা হয়েছিল
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-কুমিল্লা-ফেনী-চট্টগ্রাম রুটটি। এর ফলে রেলপথ অন্তত একশ কিলোমিটার কমে আসতো।
তাহলে কেন থমকে গেলো বুলেট ট্রেন প্রকল্প
রেলমন্ত্রী বলছেন, প্রকল্পটি বহাল আছে এবং পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে আরো কিছু প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হবে বলেই আপাতত একাজে তারা হাত দিতে পারছেন না।
যদিও কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে যে ধারণা পাওয়া গেছে তাহলো বাংলাদেশের রেল অবকাঠামোর বর্তমান বাস্তবতায় বুলেট ট্রেনের জন্য অর্থ দিতে কেউ রাজী হচ্ছে না।
একটি উন্নয়ন সংস্থা সরাসরি মন্ত্রণালয়কে বলেছে যে এই প্রকল্পের কোনো প্রয়োজন এ মূহুর্তে বাংলাদেশের নেই। এটি প্রায় পুরোটাই উড়াল রেলপথের এবং বিদ্যুৎ চালিত। অথচ বিদ্যুৎ চালিত ট্রেনের কোনো অভিজ্ঞতাই বাংলাদেশের নেই। ঢাকায় মেট্ররেল চলবে কিন্তু তাও কবে নাগাদ চলবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এ অবস্থায় প্রায় তিনশ কিলোমিটারের বুলেট ট্রেনের জন্য অর্থ পাওয়া অসম্ভব। এমন কথা বলছিলেন রেলেরই একজন কর্মকর্তা। তবে তিনি তার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন।
অধ্যাপক শামসুল হক বলছেন, বুলেট ট্রেনের প্লে গ্রাউন্ড এখনো বাংলাদেশ হতে পারেনি। এছাড়া বুলেট ট্রেন প্রকল্পটি শুরু থেকেই নানা প্রশ্ন তৈরি করেছে। অনেক সময় সুবিধা নিতে বা প্রজেক্ট বিক্রির জন্য পেছনের দরজা দিয়ে কিছু প্রজেক্ট আসে। হয়তো মন্ত্রণালয় এটা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল যে কাজ হোক আর না হোক সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশার কাজ করি। এটাতেও কিন্তু শত কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
রেল কর্মকর্তারা বলছেন, এখন তারা বরং ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে চট্টগ্রাম রুট তৈরি নিয়েই বেশি মনোযোগী হচ্ছেন।
এটি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম রেলে যাওয়ার বর্তমান দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার কমিয়ে আনবে এবং এর ফলে যাত্রার সময়ও অন্তত দু ঘণ্টা কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি