ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২২ মার্চ, ২০২২ ১৭:০৫ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৮৫ বার
আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতকে নিয়ে গঠিত ‘কোয়াড' স্ট্র্যাটেজিক জোটে ভারত ক্রমশ একঘরে হয়ে পড়ছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এর পেছনে আছে ইউক্রেন সঙ্কটে ভারতের অবস্থান।
কোয়াডের বাকি তিন দেশ রাশিয়ার সামরিক অভিযানের কঠোর নিন্দা জানিয়েছে, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াতে ইউক্রেনকে অস্ত্র পর্যন্ত জোগাচ্ছে। কিন্তু ভারত এখনো একবারের জন্যও প্রেসিডেন্ট পুতিনের কোনো সমালোচনা করেনি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সোমবার ইউক্রেন প্রশ্নে ভারতের এই অবস্থানকে দুর্বল (‘শেকি') বলেও বর্ণনা করেছেন।
ওয়াশিংটনে একটি সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন কোনো রাখঢাক না-করেই বলেন, ‘পুতিনের আগ্রাসন মোকাবেলায় কোয়াড কিন্তু খুব কঠোর অবস্থান নিয়েছে। যেমন জাপান, তেমনি অস্ট্রেলিয়াও। তবে এখানে একমাত্র ব্যতিক্রম হলো ভারত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাকে দুর্বলই বলতে হবে।’
এর আগে মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে ভারতের আলাদা আলাদা দুটি দ্বিপাক্ষিক সামিটেও কোয়াড জোটের ভেতরে এই মতপার্থক্য সামনেও চলে এসেছে। তবে পর্যবেক্ষকরা অনেকেই বলছেন, এরপরেও কোয়াড হয়তো টিঁকে যাবে, কারণ ভূরাজনীতিতে এই জোটটির মূল উদ্দেশ্য ভিন্ন।
বস্তুত ২০০৪ সালের সুনামির পর ইন্দো-প্যাসিফিক, অর্থাৎ ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা মিলে যে সুসমন্বিত ত্রাণ ও উদ্ধার অভিযান চালিয়েছিল-কোয়াড জোটটির ভাবনা তখন থেকেই শুরু।
জোটটি যখন আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয়, তখন অবশ্য তার অঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনকে প্রতিহত করা।
প্রকাশ্যে কোয়াডের নেতারা অবশ্য এটিকে প্রধানত একটি অর্থনৈতিক জোট হিসেবেই বর্ণনা করে এসেছেন, ‘যদিও শরিক দেশগুলো এখন ‘মালাবার এক্সারসাইজ' নামে নিয়মিত যৌথ সামরিক মহড়াতেও অংশ নিচ্ছে।
তিন শরিক সোচ্চার, ভারতের ভিন্ন সুর
২০২১-র সেপ্টেম্বরে কোয়াড নেতারা প্রথমবারের মতো সশরীরে কোনো সামিটে মিলিতও হয়েছেন, তবে গত দেড়-দু’মাসে ইউক্রেন সঙ্কটকে ঘিরে কোয়াডের সেই তাল যেন কিছুটা কেটে গেছে।
সোমবার অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সামিটের পর ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলাও কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন, ইউক্রেন ইস্যুতে দুই দেশের মতপার্থক্য আছেই-এবং ইন্দো-প্যাসিফিকে তার প্রভাব পড়তে না-দেয়াটাই কোয়াডের অভিপ্রায়।
শ্রিংলা আরো বলেন, ‘ভারতকে যে নিজস্ব পরিস্থিতির বিবেচনাতেই ইউক্রেন ইস্যুতে অবস্থান নিতে হয়েছে, মরিসন সেটা বুঝেছেন।’
এর আগে গতি শনিবার সন্ধ্যায় দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদীর পাশে দাঁড়িয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা-ও বলে গেছেন, ‘রাশিয়ার অভিযান আন্তর্জাতিক বিশ্বে সম্পর্ক-শৃঙ্খলা-রীতিনীতির ভিতটাই নড়িয়ে দিয়েছে-আরো কঠোর ভঙ্গিতে এর নিন্দা করা প্রয়োজন।’
মোদী অবশ্য এরপরও রাশিয়ার সমালোচনা করে একটি শব্দও বলেননি বরং তার সরকার ইতোমধ্যে রাশিয়া থেকে বেশ সস্তায় অন্তত ৫০ লাখ ব্যারেল তেল কেনার সমঝোতা করে ফেলেছে।
‘মতের অমিল থাকলেও কোয়াড টিঁকবে'
তবে দিল্লিতে সিনিয়র কূটনৈতিক বিশ্লেষক সুহাসিনী হায়দার মনে করেন, কোয়াডের শরিকদের মধ্যে অনেক মতপার্থক্য থাকলেও এই জোটের ভবিষ্যৎ আছে।
হায়দারের স্ত্রীর কথায়, ‘মনে রাখতে হবে এই জোটের দুটি দেশ-জাপান ও অস্ট্রেলিয়া হলো আমেরিকার অনেক পুরনো সঙ্গী, অ্যালাই। ইউক্রেন প্রশ্নে তারা যে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, আমেরিকার নতুন মিত্র ভারতের ততটা নেয়ার কোনো দায় নেই। আপনি সাউথ চায়না সি-তে শান্তি বজায় রাখতে কোয়াডের বিবৃতিগুলো দেখুন, তাতে একবারও সরাসরি চীনের নাম করা হয়নি। কিন্তু জাপান বা অস্ট্রেলিয়ার সাথে আমেরিকা যে দ্বিপাক্ষিক বিবৃতিগুলো দিয়েছে, তাতে কিন্তু সব সময় চীনের নাম করেই হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। অথবা ধরা যাক, মিয়ানমারে সামরিক জুনটা-র ওপর স্যাংশন আরোপের ক্ষেত্রেও ভারত বাকি তিন কোয়াড শরিকের সাথে একমত নয়।’
‘উত্তর কোরিয়া এই জানুয়ারিতেই সাতটা মিসাইল টেস্ট করেছে, তারপরও ভারতই একমাত্র দেশ যারা তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রেখে চলে। আমি বলতে চাইছি, কোয়াড পার্টনারদের ওয়ার্ল্ডভিউ একই রকম নয়, কিন্তু ইন্দো-প্যাসিফিকে তাদের অঙ্গীকার অটুট থাকলেই যথেষ্ঠ’ বলছেন সুহাসিনী হায়দার।
‘চীন ফ্যাক্টর' কতটা প্রভাব ফেলছে?
অনেক পর্যবেক্ষক আবার মনে করেন, ইউক্রেন সঙ্কটে ভারত রাশিয়ার প্রকাশ্য বিরোধিতা করলে রাশিয়া-চীন-পাকিস্তান একটি নতুন অক্ষ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়, যা ভারতের জন্য বিরাট ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠতে পারেন।
নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের সিনিয়র ফেলো মঞ্জরী মিলারও বলছিলেন, চীনের সাথে জটিল সম্পর্কই ভারতকে কোয়াডে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছিল, আবার সেই একই ফ্যাক্টর ইউক্রেন সঙ্কটের সময়ও ভারতের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে।
তার কথায়, ‘আজকের বিশ্বে একটা আমেরিকা বনাম চীন বাইপোলার প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি হচ্ছে-ভারত সেভাবেই বিষয়টাকে দেখে এবং চায় একটা বহু মেরুর বিশ্ব। কারণ এই দুই দেশই ভারতের বৃহত্তম দুই বাণিজ্যিক পার্টনার, দুজনকেই তাদের দরকার। চীন আবার ভারতের জন্য বৃহত্তম বৈদেশিক হুমকিও বটে। কোয়াড দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ভারতেরই চীনের সঙ্গে সীমান্ত আছে, সেখানে ঘন ঘন সংঘাতও হচ্ছে।’
‘চীনের সাথে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা, দুটো ফ্রন্টে একসাথে যুদ্ধ বাঁধলে কী হবে সেই দুশ্চিন্তা, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এগুলোও ভারতের মাথাব্যথা। ফলে কোয়াডের মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসিফিকের ‘ইন্দো' অংশটিতে নিজেদের প্রভাব বলয় অক্ষুণ্ণ রাখাটাই ভারতের প্রধান উদ্দেশ্য’ বলছেন মিলার।
ইউক্রেন সঙ্কট মিটলে ভূরাজনীতির ডায়নামিক্স কোয়াডকে কোন খাতে নিয়ে যাবে তা এখনই বলা মুশকিল। কিন্তু আপাতত জোট শরিকদের যাবতীয় সমালোচনা ও কটাক্ষ কিন্তু ভারত নীরবেই উপেক্ষা করে যাচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি