ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

গ্রিসে ‘অনিয়মিত’ বাংলাদেশীরা গ্রেফতার আতঙ্কে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক


প্রকাশ: ২৪ মার্চ, ২০২২ ০৯:৩২ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৮৫ বার


গ্রিসে ‘অনিয়মিত’ বাংলাদেশীরা গ্রেফতার আতঙ্কে

গ্রিসে ‘অনিয়মিত বাংলাদেশীদের’ গণহারে গ্রেফতার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন সেখানে বসবাসরত প্রবাসীরা৷ গ্রিক কর্তৃপক্ষ জোর করে দেশে ফেরত পাঠাতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের৷

এথেন্সে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে গ্রিক পুলিশ৷ এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন অনেক বাংলাদেশী৷ সেখানে বাংলাদেশী অভিবাসনপ্রত্যাশীদের গণহারে গ্রেফতার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের৷ এমন অবস্থায় অনেকে ভয়ে ঘরে বন্দি জীবনযাপন করছেন৷ অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ তাদের থাকার জায়গাগুলোতেও হানা দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন৷ তবে বাংলাদেশের দূতাবাসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ‘নথিভুক্ত’ হননি, এমন অভিবাসনপ্রত্যাশীদের গ্রেফতারে অভিযান পরিচালনার কোনো তথ্য তারা পাননি৷

‘ফেরত গেলে মৃত্যু ছাড়া উপায় থাকবে না’
গ্রেফতারের ভয়ে এথেন্সে আরো কয়েকজন বাংলাদেশীর সাথে এক সপ্তাহ ধরে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি রয়েছেন সম্রাট৷ 

ইনফোমাইগ্রেন্টসকে তিনি বলেন, ‘আমার আদালতের অনুমতিপত্র আছে৷ মেয়াদ চার মাস থাকলেও আমি ভয়ে বের হচ্ছি না৷ শুনেছি, তারা সবাইকে ধরছে৷ আমার কাগজ এমনিতেই দুর্বল৷ তাই ছয়-সাত দিন ঘরবন্দি হয়ে আছি৷ কাজেও যেতে পারছি না৷ আমাদের মতো যারা আছে, তারা সবাই গৃহবন্দি৷ পুলিশ এমনকি মেসে, রুমেও রেইড দিচ্ছে৷’

২০১৯-এর শেষ দিকে ইরাক থেকে তুরস্ক হয়ে ‘অনিয়মিত’ পথে গ্রিসে আসেন তিনি৷ প্রথমদিকে এথেন্সের বাইরে একটি জেলায় কৃষি খামারে কাজ করতেন৷ সেখানে বাংলাদেশী মুদ্রায় ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা বেতন পেতেন বলে জানান৷ এর মধ্যে আশ্রয় আবেদনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে পরে আদালত থেকে এক বছরের অনুমতিপত্র সংগ্রহ করেন৷ এথেন্সে এসে কাজ নেন রেস্তোরাঁয়৷ সেখানকার বেতন থেকে মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা দেশে পাঠাতেন৷ কিন্তু ধরপাকড়ের খবরে সামনের সময় অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে তার জন্যে৷ 

সম্রাট বলেন, ‘দেশে ১৪ থেকে ১৫ লাখ টাকা ঋণ হয়ে গেছে৷ এখন ঋণ শোধ না করে বাড়ি যেতে হলে কী জবাব দেবো৷ আমার মৃত্যু ছাড়া উপায় থাকবে না৷ বাড়িতে জমিজমাও নেই যে, বিক্রি করে ঋণ শোধ করবো৷ যতদিন অভিযান বন্ধ না হয় ততদিন এভাবেই থাকতে হবে৷’

শুধু সম্রাট নন এথেন্সে অনিবন্ধিত বাংলাদেশীদের অনেকেই গ্রেফতার আতঙ্কে রয়েছেন৷ 
বাংলাদেশী মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, ‘এই মাসের ১৩ তারিখ থেকে অভিযান শুরু হয়েছে৷ আমরা শুনেছি, পুলিশ অভিবাসনপ্রত্যাশীদের গণহারে গ্রেফতার করে ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিচ্ছে৷ কারো রেসিডেন্স পারমিট (বসবাসের অনুমতি) থাকলে তা পরীক্ষা করে পরবর্তীতে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে৷ বাকিদের রেখে দেয়া হচ্ছে৷ ‘এথেন্স একটি সংবাদ পোর্টালের এই সাংবাদিক দাবি করেন, ‘এথেন্স থেকে তিন শতাধিক ব্যক্তিকে এখন পর্যন্ত আটক করা হয়েছে৷ গতকাল (সোমবার) বিকালে একটি মেস থেকেও প্রায় ৩০ জন বাংলাদেশীকে আটক করার খবর শুনেছি আমরা৷’

বাংলাদেশীদের উদ্বেগ যে কারণে
গত ডিসেম্বরে একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে ১৯ বাংলাদেশীকে ঢাকায় ফেরত পাঠায় এথেন্স৷ সেই সময় গ্রিসের অভিবাসী ও শরণার্থী বিষয়ক মন্ত্রী নোতিস মিতারাচি জানান, বাংলাদেশের সরকারের সহযোগিতায় পাঁচ বছর পর অনিয়মিত বাংলাদেশীদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে দেশটি৷ 

গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সুরক্ষার আওতায় যারা নেই, তাদেরকে ফেরত পাঠাচ্ছে গ্রিস৷’ 

অনিয়মিত অভিবাসী ফেরত নিতে ঢাকা সহযোগিতা করায় বৈধপথে বাংলাদেশ থেকে গ্রিসে মৌসুমি কর্মী আনার সুযোগ তৈরি হবে বলেও জানান তিনি৷

পরবর্তীতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নোতিস মিতারাচির ঢাকা সফরে দুই দেশের সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়৷ গ্রিসের অভিবাসী ও শরণার্থী মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, এর মধ্য দিয়ে বছরে চার হাজার বাংলাদেশীকে মৌসুমি কাজের ভিসা দেবে গ্রিস৷

বর্তমানে দেশটিতে বসবাস করছেন এমন ১৫ হাজার বাংলাদেশীকেও দেয়া হবে সাময়িক কাজের অনুমতি৷ পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে লড়াই ও অবৈধভাবে যারা বসবাস করছে, তাদের জোরপূর্বক ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করবে৷’

এই চুক্তির কারণে বাংলাদেশীরা উদ্বেগে রয়েছেন বলে জানান মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম৷ গ্রিসের প্রবাসীদের ধারণা, ফেরত পাঠানোর জন্যই এখন এমন ধরপাকড় শুরু করেছে দেশটির আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী৷ এ নিয়ে তারা গত শনিবার এথেন্সে একটি বিক্ষোভেরও আয়োজন করেন৷ 

বাংলাদেশ প্রবাসী অধিকার পরিষদ গ্রিসের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রিস সরকারের নিশ্চয়ই একটা টার্গেট আছে, সেটা কী আমরা বুঝতে পারছি না৷’

কেন অভিযান চালাচ্ছে গ্রিস
‘সংগঠিত অপরাধের’ বিরুদ্ধে এথেন্সে পুলিশ বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে বলে খবর প্রকাশ করেছে দেশটির গণমাধ্যমগুলো৷ সংবাদমাধ্যম টিওসি গত রোববার প্রকাশিত তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, চলমান অভিযানে ৬০০ পুলিশ সদস্য নিয়োজিত রয়েছেন৷

অভিযানে প্রয়োজনীয় নথিবিহীন ৩৬১ জন অভিবাসী, বিদেশীকে আটক কেন্দ্রে’ পাঠানো হয়েছে৷ ১৪ জনকে মাদক, নয় জনকে মানবপাচার, দুই জনকে ভুয়া কাগজের জন্য গ্রেফতারের করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে পুলিশের বরাতে উল্লেখ করা হয়েছে৷

যোগাযোগ করা হলে এথেন্সের বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশী অভিবাসনপ্রত্যাশীদের গ্রেফতারের বিষয়ে তারা কোনো তথ্য পাননি৷ 

একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যতটুকু খবর পেয়েছি গ্রিক সরকারের পুলিশ এখানে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যক্রম চালাচ্ছে৷ এ ধরনের কার্যক্রমে বাংলাদেশীদের সংশ্লেষ নেই, কাজেই তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই৷ তবে যেহেতু বাংলাদেশী অনেক অনিয়মিত অভিবাসী গ্রিসে থাকেন, তাদের কেউ হয়ত এই ধরপাকড়ের মধ্যে পড়েও যেতে পারেন৷’

দূতাবাস সূত্র জানিয়েছে, গ্রিসে মোট ৩০ থেকে ৩৫ হাজার বাংলাদেশী রয়েছেন৷ এর মধ্যে বৈধভাবে অনুমতি নিয়ে বসবাস করছেন এমন সংখ্যা সাড়ে বারো হাজার৷ 

দূতাবাসের এই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রায় ২৩ হাজার অনিয়মিত বাংলাদেশীর মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৯ জনকে গ্রিস ফেরত পাঠিয়েছে৷ এটা প্রতীকী৷ ওরাও চায় না বাংলাদেশের অবৈধদের ফেরত পাঠাতে৷ কারণ, এখানে অনানুষ্ঠানিক খাতে বিদেশী শ্রমিকের একটা চাহিদা রয়েছে৷ ওদের বছরে ১৫ হাজার শ্রমিক লাগে৷ তার মধ্যে চার হাজার বাংলাদেশ থেকে নেবে এমন চুক্তি হয়েছে৷ এপ্রিলে সংসদে অনুমোদিত হলে এর প্রক্রিয়া শুরু হবে৷ বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকেও যেসব বাংলাদেশী অবৈধ হয়েছেন, তাদেরকে পর্যায়ক্রমে নিয়মিত করার অনুরোধ জানানো হয়েছে৷ ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে বলে গ্রিসের মন্ত্রীও আশ্বাস দিয়েছেন৷ এই বিষয়ে দূতাবাস নিবিড়ভাবে গ্রিস কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ রাখছে৷ কিন্তু সংখ্যাটা এখানে এত বেশি যে তার ব্যবস্থাপনাটা অনেক জটিল৷’

সূত্র : ডয়চে ভেলে


   আরও সংবাদ