ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৪:১৯ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫৪৩ বার
মোমিন বান্দার জন্য একতাই বল। একতাই শান্তি। পৃথিবীর ইতিহাসে এ জাতি তখনই পরাজিত ও লাঞ্ছিত হয়েছে, যখন তাদের পরস্পরের মাঝে বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা জায়গা করে নিয়েছে। আর তারা যখন নিজেদের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্য ও সংহতির প্রাচীর নির্মাণ করতে পেরেছে, হাতে হাত ও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে সক্ষম হয়েছে, তখন তাদের কোনো শক্তিই পরাজিত করতে পারেনি। পারেনি নিগৃহীত ও দেশান্তর করতে। এ কারণেই সর্বযুগে ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুদের প্রধান কাজ ছিল, মুহাম্মদ (স.)-এর উম্মতদের একতা বিনষ্ট করে তাদের স্বার্থসিদ্ধি করা। তারা চায়, এ জাতি যেন কিছুতেই এক কাতারে আসতে না পারে। তাদের মাঝে যেন ঐক্যের সুর না বাজে। তারা যেন শতদল উপদলে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন থাকে। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে শত্রুপক্ষ এমন কোনো উপায় নেই যা নেয়নি।
শত্রুরা আজও এ হাতিয়ার ব্যবহার করেই ঠুনকো ও তুচ্ছ বিষয়কে সামনে এনে আমাদের ধ্বংস ও চূড়ান্ত পরাজয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ইসলামের শুরু যুগ থেকেই মুসলমানদের সঙ্গে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সঙ্গে বৈরিতা চলে আসছে। বর্তমান বিশ্বে এই দুই সম্প্রদায় ছাড়াও অন্যান্য সম্প্রদায়ও যুক্ত হয়েছে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মিশনে। তারা সবাই এ ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন নীতিতে চলছে।
কাশ্মীর, পূর্ব-তৈমুর, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, আরাকান, ইরাক, কসোভো, নাইজেরিয়া, উইঘুর, আলজেরিয়া, সুদান ও ফিলিপাইনের দিকে তাকালে বিষয়টি সূর্যের আলোর মতো পরিস্কার বোঝা যায়। আমার প্রিয় মাতৃভূমিও দেশীয় ও বৈশ্বিক ষড়যন্ত্রের বাইরে নয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মুসলমানদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কারণেই বর্তমান বিশ্বের উদ্বাস্তুদের ৯২ ভাগই মুসলমান। কথা ছিল, মুসলমান জাতি বিশ্বের নেতৃত্ব দিবে। অন্ধকার সমাজকে কোরআন ও সুন্নাহ'র আলোয় আলোকিত করবে। সমাজ থেকে জুলুম ও পাপাচার দূর করে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবে।
আফসোস, মুসলমানরা নিজেরাই আজ অন্ধকারের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত। নিজেরাই ন্যায় ও ইনসাফের জন্য হাহাকার করছে। শত্রুপক্ষের কাছে নিজেদের স্বকীয়তা ও সম্ভ্রম বিকিয়ে দিয়ে এ জাতি আজ পথের ফকির। লাঞ্ছিত ও অপদস্ত। নিজেদের পরিচয়, পরিচিতি, ঐতিহ্য ও সোনালী ইতিহাস সব ভুলে গেছে মুসলমানরা। মুসলমান জাতি আজ কোরআন থেকে এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব নবীজি সা. -এর জীবন থেকে শিক্ষা নেয় না। শিক্ষা নেয় মানব রচিত আদর্শ থেকে। প্রিয় ভাই আমার, আমাদের সবার আল্লাহ এক, কোরআন এক, নবী এক, আদর্শ এক, সবাই একই পথের পথিক; তাহলে এতগুলো মতপথ কেন? কেন এত বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতা?
মুসলমানদের অনৈক্য শুধু নিজেদের বা একটি সমাজ কিংবা একটি দেশের ক্ষতি বয়ে আনে না। বরং গোটা বিশ্বকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়। বিদায় হজের ভাষণে ঐক্যের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রিয় নবী (সা.) কত চমৎকার বলেছেন, আমার ভাইয়েরা, আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। জেনে রেখো, সব মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। সবাই একই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। দুনিয়ার সব মুসলমান একই অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃসমাজ।
মনে রেখো- বাসভূমি ও বর্ণবৈচিত্র্য নির্বিশেষে সব মুসলমান সমান। আজ থেকে বংশের গৌরব বিলুপ্ত হলো। পরস্পরের প্রাধান্যের একমাত্র মাপকাঠি হলো খোদাভীতি বা সৎকর্ম। সে ব্যক্তিই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো, যে নিজ আমলের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। প্রিয় ভাই আমার, ইসলামের আগমন এমন এক সময় হয়েছিল, যখন পৃথিবীতে জালেম ও জুলুমের জয়জয়কার ছিল। তখন মানুষের রক্ত ও জীবনের কোনো মূল্য ছিল না। তুচ্ছ কারণে মানুষ হত্যা বড় কোনো অপরাধ ভাবা হতো না। মানুষ সবখানে ন্যায় ও ইনসাফের সন্ধান করতো। কিন্তু, কেউ তাদেরকে নিরাপত্তা দিতে পারতো না। বরং তাদেরকে শিক্ষা দেয়া হতো বর্বরতা ও হিংস্রতা। তাইতো সে যুগকে বলা হয় অন্ধকার ও বর্বরতার যুগ।
ঠিক এমন সময় শান্তির পয়গাম নিয়ে দুনিয়ায় আগমন হয় ইসলামের। কোরআন ও সুন্নাহর আলোয় আলোকিত হয় অন্ধকার সমাজ। মিটে যায় সব জুলুম ও অত্যাচার। প্রিয় পাঠক, আজ সেই একই কোরআন ও একই হাদিস বিদ্যমান। একটি আয়াত ও একটি হাদিসেরও পরিবর্তন হয়নি। সে সময় যিনি কর্তৃত্ব চালাতেন, সেই মহান সত্তা আল্লাহতায়ালাই আজ আমাদের প্রভু। অথচ সেযুগ ও এ যুগের মধ্যে কতো তফাত।
ওই যুগের মানুষ ছিল ইনসাফকারী। আজ আমরা নিজেরাই মাজলুম জাতি। নিজেরাই ন্যায় ও ইনসাফের অন্বেষণকারী। তারা ছিল শাসক। আর আমরা শাসিত। ইতিহাসের পাতা উল্টালে বোঝা যায়, প্রত্যেক যুগে মুসলমানদের অধঃপতন ও পরাজয়ের মূল কারণ ছিল বিচ্ছিন্নতা। অথচ মুসলমানদের পরস্পরের মাঝে একতা রক্ষা করা ইসলামের ফরজ (আবশ্যকীয়) বিধানের অন্তর্ভুক্ত। এই বিধান না মানার কারণেই যত লাঞ্চনা ও অপদস্ততা। ইসলামের শুরু যুগে মুসলমানদের ঈমানের পরে প্রধান শক্তি ছিল একতা। তাদের সবার মত-পথ ও মিশনকে যখন তারা এক বানিয়েছিল, তখন কোনো অপ্রতিরোধ্য শত্রুশক্তি তাদের পরাজিত করতে পারেনি।
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে একতা রক্ষার বিষয়ে অনেক নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, তোমরা সবাই আল্লাহর রুজ্জুকে শক্তভাবে ধারণ কর। আর তোমরা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১০৩) নবীজি (সা.) বলেছেন, মেষপালের নেকড়ে বাঘের মতো শয়তান মানুষের জন্য নেকড়ে বাঘস্বরূপ। যে মেষপালের মধ্য থেকে একটি মেষ দল থেকে আলাদা থাকে কিংবা খাদ্যের সন্ধানে একাকি দূরে চলে যায় অথবা যে মেষ অলসতাবশত দল ছেড়ে এক প্রান্তে পড়ে থাকে, সেটিকে নেকড়ে বাঘ ওঠিয়ে নিয়ে যায়।
সাবধান, তোমরা কখনও জামায়াত ছেড়ে একাকি দুর্গম পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ পথে চলবে না। সুতরাং সব সময় জামাআত তথা মুসলিম জনসাধারণের সঙ্গে থাকবে। (মুসনাদে আহমদ, মিশকাত) মুসলমানরা যে জনপদে থাকবে, সেখানে সংখ্যায় যদি তারা অল্পই হয়, তা হলে একজনকে আমির (নেতা) বানিয়ে বাকিরা তার দিকনির্দেশনায় চলবে। এ বিষয়ে নবীজি সা. বলেন, তিন জন মানুষও যখন জনমানবহীন মরুভূমিতে থাকবে তখন তাদের একজনকে নেতা নিযুক্ত করে তার অনুসরণ না করে বিচ্ছিন্ন থাকা বৈধ নয়। (মুসনাদে আহমদ)
প্রিয় পাঠক, তাই আসুন আমরা নিজেদের শতধাবিভক্তি ভুলে গিয়ে দলমত নির্বিশেষে সবাই এক হই। হাতে হাত ও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুসলমানদের দুর্দিন ও সংকট নিরসনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করি। আল্লাহতায়ালা আমাদের সহায় হোন। আমিন।