ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৪:১৯ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৮৫৪ বার
ইসলাম ডেস্ক: আমাদের সমাজে পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ ও শত্রুতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। ক্ষেত্রবিশেষে এ শত্রুতার আগুন বংশপরিক্রমায় কয়েক সিঁড়ি গড়াতে থাকে। এসব ঝগড়া-বিবাদের কারণ খতিয়ে দেখলে অর্থকড়ি ও জায়গাজমিই মূল কারণ হিসেবে প্রকাশ পাবে। এ জাতীয় বিবাদ রক্তের সম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকেও মুহূর্তেই শেষ করে দেয়। এ অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার অনেক কারণ থাকলেও একটি প্রধান কারণ হলো পারস্পরিক মালিকানায় অস্বচ্ছতা ও লেনদেন পরিষ্কার না রাখা। ইসলামের সোনালি শিক্ষা হলো, ‘ভ্রাতৃত্বের আবহে বসবাস করো। আর অপরিচিতের মতো লেনদেন করো।’
অর্থাৎ প্রাত্যহিক জীবনে পরস্পরে এমন আচরণ করো, যেমন এক ভাইয়ের অন্য ভাইয়ের সঙ্গে করা উচিত। আর উদারতা, সহনশীলতা ও হৃদ্যতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাও। কিন্তু পারস্পরিক সুসম্পর্ক থাকলেও টাকা-পয়সার লেনদেন, জায়গাজমির আদান-প্রদান ও অংশীদারিত্বের কারবার এমনভাবে সম্পাদন করো, যেমন দুজন অপরিচিত ব্যক্তি সম্পাদন করে থাকে। অর্থাৎ লেনদেন ও কায়কারবারের প্রতিটি বিষয়ে কোনো অস্পষ্টতা না রেখে স্পষ্ট হওয়া উচিত। পারস্পরিক সুসম্পর্ক থাকাকালে যদি ইসলামের এ মূল্যবান শিক্ষার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয় তাহলে পরে উদ্ভূত অনেক ঝগড়া-ফাসাদের পথ শুরুতেই বন্ধ হয়ে যায়।
পারস্পরিক যৌথ ব্যবসায় দায়িত্বে ও প্রাপ্যে স্বচ্ছতা অপরিহার্য
কখনো এমন হয় যে ভাই-বেরাদার ও পিতা-পুত্র মিলে যৌথভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে। আর সাধারণত হিসাব-নিকাশবিহীন প্রত্যেকে নিজ প্রয়োজন অনুপাতে সেখান থেকে ব্যয় করতে থাকে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কার কী অবস্থান, তা স্পষ্ট করা হয় না। অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে, নাকি বেতন ভিত্তিতে, নাকি সহযোগী হিসেবে—বিষয়টি স্পষ্ট নয়। বেতন ভিত্তিতে হলে বেতন কত আর অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে হলে তা কী পরিমাণ—এসব বিষয় স্পষ্ট করা জরুরি। এসব বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে প্রতিষ্ঠানে এক ধরনের অস্বচ্ছতা তৈরি হয়। এমন যৌথ ব্যবসার ফলে অন্তরে অসন্তোষ ও ক্ষোভ ধূমায়িত হতে থাকে।
বিশেষত অংশীদারদের যখন বিয়ে-শাদি হয়ে যায় তখন প্রত্যেকেই মনে করে যে অন্য অংশীদাররা ব্যবসা থেকে বেশি সুবিধা লাভ করছে। আমার সঙ্গে অবিচার করা হচ্ছে। তখন বাহ্যত পারস্পরিক সমপ্রীতি দৃষ্টিগোচর হলেও ভেতরে ভেতরে অসন্তোষ ও ক্ষোভের লাভা উত্তপ্ত হতে থাকে। অবশেষে এ ক্ষোভ ও অবিশ্বাসের ফলে ঝগড়া-বিবাদ থেকে শুরু করে মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। আর দীর্ঘকাল চলমান এ যৌথ কারবারের কোনো মূলনীতি নির্ধারিত না থাকায় সুষ্ঠু হিসাব-নিকাশও ছিল না। তাই দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলে প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বার্থের দৃষ্টিতে ঘটনা বিশ্লেষণ করার কারণে পারস্পরিক সমঝোতার বিষয়টিও অত্যন্ত জটিল হয়ে যায়।
বলাবাহুল্য, এসব ফেতনা-ফাসাদের কারণ শুধু এটিই যে ব্যবসার সূচনায় এ বিষয়ে কোনো মূলনীতি চূড়ান্ত করা হয়নি। যদি শুরুতেই কার কী অবস্থান, কী দায়িত্ব-কর্তব্য এবং কার প্রাপ্য কী হবে—এ বিষয়গুলো চূড়ান্ত করা হতো এবং তা লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা হতো তাহলে পরবর্তী সময়ে সৃষ্ট অনেক ফেতনা-ফাসাদের দ্বার শুরুতেই বন্ধ হয়ে যেত।
কোরআনে কারিমের সর্বাধিক দীর্ঘ আয়াতে পারস্পরিক লেনদেনকে লিখে রাখার গুরুত্বারোপ করে আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদের নির্দেশ করেছেন যে ‘যখন তোমরা বাকিতে লেনদেন করবে তখন তা লিখে রাখবে এবং সাক্ষী রাখবে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৮২)
যৌথ বস্তুতে মালিকানায় পরিচ্ছন্নতা
আমাদের সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্যও এককভাবে ঘর নির্মাণ কঠিন বিষয়। তাই ঘর নির্মাণ সাধারণত পরিবারে যৌথভাবেই হয়ে থাকে। বাবা বাড়ি নির্মাণ করলে ছেলেরাও সামর্থ্য অনুপাতে নিজেদের অর্থ দিয়ে থাকে। সাধারণত তা কোনো বিষয় চূড়ান্ত করা ছাড়াই হয়ে থাকে। তা কি ছেলের পক্ষ থেকে বাবার জন্য হাদিয়া বা সহযোগিতাস্বরূপ, নাকি ঋণ বা বাড়ির মালিকানায় অংশগ্রহণ—কিছুই স্বচ্ছ থাকে না। কেননা হাদিয়া বা দান হলে বাড়ির মালিকানায় সে অংশীদার হবে না এবং এ টাকাও ফেরত পাবে না।
ঋণ হলে বাড়ির একক মালিকানা পিতার হবে, আর ছেলের প্রদত্ত অর্থ পিতার দায়িত্বে ঋণস্বরূপ থাকবে। আর বাড়ির মালিকানায় অংশীদার হওয়ার জন্য টাকা দেওয়া হলে অর্থের পরিমাণে বাড়ির মালিকানা লাভ করবে। মোটকথা প্রত্যেক অবস্থার ফলাফল ভিন্ন। কিন্তু যেহেতু অর্থ দেওয়ার সময় কোনো বিষয় চূড়ান্ত হয় না, প্রদত্ত টাকার হিসাবও রাখা হয় না, তাই পরবর্তী সময়ে বিরোধ দেখা দিলে, বিশেষ করে এ অবস্থায় বাবার মৃত্যু হলে উত্তরাধিকার সম্পদ বণ্টনে অবর্ণনীয় জটিলতার সৃষ্টি হয়।
যদি ইসলামের সোনালি শিক্ষা অনুসরণ করে গৃহ নির্মাণের আগেই বিষয়টি চূড়ান্ত করা হতো এবং তা লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা হতো তাহলে এ দ্বন্দ্ব-কলহের সুযোগ সৃষ্টি হতো না।
উত্তরাধিকার সম্পত্তির দ্রুত বণ্টন
পরিবারের কোনো সদস্য ইন্তেকাল করলে শরিয়তের নির্দেশ হলো, অনতিবিলম্বে পরিত্যক্ত সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করে দেবে। কিন্তু আমাদের সমাজে শরিয়তের এ নির্দেশ পালনে চরম উদাসীনতা বিরাজমান। অবহেলাবশত সম্পত্তি বণ্টন করা হয় না। মৃত ব্যক্তির ব্যবসা-বাণিজ্য থাকলে জীবদ্দশায় যে সন্তান তার দেখাশোনা বা সহযোগিতা করত, সে-ই তা দেখাশোনা করতে থাকে। কিন্তু এ বিষয়টি পরিষ্কার করা হয় না যে এখন ব্যবসার মালিকানা কার, আর তা কী পরিমাণ! উত্তরাধিকারীদের অংশ কী হারে পরিশোধ করা হবে। ব্যবসায় যে ভাই শ্রম দিচ্ছে সে এর বিনিময়ে কী পাবে।
বিশেষত বাড়ি-ঘর ও জমা-জমিতে বোনদের অংশ দিতে অবহেলা দীর্ঘ হয়। এমনকি কেউ সম্পত্তি বণ্টনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তার প্রস্তাবকে সমাজে দোষণীয় মনে করা হয়। বলা হয়, বাবার কবরের মাটি না শুকাতেই সন্তানরা ভাগ-বাটোয়ারায় নেমে পড়েছে। অথচ এ অবহেলার ফলাফলই কিছুদিন পর প্রকাশ পেতে থাকে। সময় অতিবাহিত হলে নিজ নিজ প্রাপ্য ও অধিকারের কথা স্মরণ হয়। অসন্তোষ ও ক্ষোভ জন্মাতে থাকে। সময়ের ব্যবধানে পরিত্যক্ত সম্পত্তির মূল্য বৃদ্ধিতে বড় ধরনের তারতম্য ঘটে গেলে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহও বড় আকার ধারণ করে।
যদি শরিয়তের নির্দেশ অনুযায়ী যথাসময়ে সম্পদ বণ্টন হয়ে যেত, তাহলে সবার সন্তুষ্টিতে সব বিষয় মীমাংসা হয়ে যেত। সৌহার্দ্য ও সমপ্রীতি বজায় থাকত। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন আমানত তার হকদারের কাছে প্রত্যর্পণ করতে। তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকাজ পরিচালনা করবে তখন ইনসাফের সঙ্গে বিচার করবে...।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৫৮)
মহান আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন।