ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

আদর্শ মানুষ গড়তে ইসলামী শিক্ষা

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারী, ২০২২ ২০:১৮ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫৬৯ বার


আদর্শ মানুষ গড়তে ইসলামী শিক্ষা

বর্তমানে যেকোনোভাবে হোক শুধু ডিগ্রি অর্জন করে চাকরি করাই শিক্ষার উদ্দেশ্য বলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মনে হয়। ফলে এ ধরনের শিক্ষায় উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন আলোকিত আদর্শ মানুষ তৈরি হতে পারে না; বরং বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষ শিক্ষিত হয়েও অনেক ক্ষেত্রেই অমানবিক আচরণ করছে। আমাদের কাছে মনে হয়, দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষা ক্ষীণভাবে চালু থাকাই অনেকাংশে দায়ী। এর পরও যদি বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম থেকে ধর্মীয় শিক্ষা বাদ দেয়া হয়; তা হলে দেশে সৎ ও যোগ্য মানুষদের অভাব হবে বৈকি। 

শিক্ষা মানে জ্ঞানার্জন করা। সত্যের ওপর ভিত্তি করে জীবন গড়া। আর কার না জানা সেই জ্ঞান দেয়া সম্ভব কেবল ইসলামী শিক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু ইংরেজদের প্রবর্তীত শিক্ষার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে বর্তমান সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা ইসলামী মূল্যবোধ শেখার কোনো সুযোগ পায় না। মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায়ও বর্তমানে ইসলামকে একটা পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা রূপে শিক্ষা দেয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। ফলে ইসলামী অর্থনীতি, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসনিক নীতি, রাজনৈতিক পরিভাষাগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে অপরিচিত। এমন শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার নামে সমাজ ও জাতীর পরিচালনা ও নেতৃত্বের আসন থেকে নামিয়ে মানবজীবনের এক সীমিত ময়দানে জড়ো করেছে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা করার পরও নৈতিকতা ও মানবিকতা থেকে শিক্ষার্থীদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। ফলে শিক্ষার্থীরা ইসলামের বিশ্বজনীন ব্যাপক আদর্শিক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গ ইসলামকে শিক্ষার্থীদের কাছে পেশ না করার অপচেষ্টা চলছে। ফলে আদর্শ, সৎ ও চরিত্রবান নাগরিক বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছে না। প্রচলিত ধারণায় শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত ও আমাদের সভ্যতার প্রতি ঘৃণাভরে পোষণ করা জেনারেশন সম্পর্কে আল্লামা ইকবাল সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, “তুমি অন্যের জ্ঞান অর্জন করেছ। অন্যের কাছ থেকে ধার করা ‘রুজ’ দিয়ে নিজের চেহারা রঙিন, আমি জানি না তুমি কি? ‘তুমি’ না অন্য কেউ? তোমার বৃদ্ধিমত্তা অপরের চিন্তার শিকলে বন্দী।” কবি ইকবাল আরো বলেছেন, ‘ধার করা শিক্ষায় আদর্শ মানুষ তৈরি হতে পারে না। আদর্শ ও নৈতিক চরিত্রবান মানুষ তৈরি হতে হলে অবশ্যই ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে।’

ইসলামের শিক্ষার অভাবেই মুসলিম জাতি আজ সমগ্র বিশ্বে পদে পদে বিপর্যস্ত ও পদদলিত। তাই হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে হলে প্রয়োজন নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখা এবং চালু করা। জন মিল্টন বলেছেন, ‘আমি ওই শিক্ষাকেই পূর্ণাঙ্গ ও উদার শিক্ষা বলি যা একজন মানুষকে  তৈরি করে ব্যক্তিগত বা সরকারি দায়িত্ব পালনে ও যুদ্ধকালীন ন্যায়সঙ্গতভাবে দক্ষতাসহকারে এবং উদারভাবে প্রতিপালন করতে।’

দেশের ৯০ শতাংশ নাগরিক মুসলমান। ইসলাম শিক্ষা বিষয়টি নার্সারি থেকে সব স্তরে আবশ্যিক করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ ওহির জ্ঞান শিক্ষা করা ছাড়া কোনো মানুষের পক্ষে নিজের প্রকৃত পরিচয় লাভ করা সক্ষম নয়। শুধু বিবেকবুদ্ধি প্রয়োগ করে মানুষ নিজেকে আদর্শ ও আলোকিত মানুষ তৈরি করতে অক্ষম বলেই আল্লাহ নবী-রাসূলদের মাধ্যমে যুগে যুগে মানুষকে সত্য জ্ঞান দান করেছেন। 
কাজেই প্রকৃত পরিচয়ের জন্য কুরআনের কাছে সব মানুষকে ধরনা দিতে হবে। প্রথম ওহি হিসেবে এটুকু জানানো হয়েছে, ইলম বা জ্ঞানের উৎস হলো আল্লাহ, যিনি সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি জগতে কী দরকার, কোনটা কার জন্য ভালো এবং কিভাবে চললে পৃথিবীর মানুষের শান্তি হবে এসব একমাত্র আল্লাহই জানেন। তাই তাঁর নাম নিয়েই ইলম হাসিল তথা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বিদ্যা শিক্ষা শুরু করতে হবে। এটিই স্বাভাবিক হওয়া উচিত।

আজ প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার কুফল দেখলে আতঙ্কিত হতে হয়। আজ দেশে নীতিনৈতিকতার বড় অভাব। ফলে জনগণ ভয়ভীতি ও অসহায় অবস্থায় এমনভাবে সম্মুখীন হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ঘুষ, দুর্নীতি, ছিনতাই, ধর্ষণ, কালোবাজারির মতো গুরুত্বর সব অপরাধ এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে গেছে। অফিসের বড় কর্তা থেকে শুরু করে বয়-বেয়ারা পর্যন্ত প্রায় সর্বস্তরের কর্মচারী দুর্নীতিগ্রস্ত। স্বামীর সামনেই স্ত্রীকে ধর্ষণ, বাবার লাশের জন্য বসে থাকা মেয়েকে ধর্ষণ, প্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণ, হত্যার মতো নৃশংস ও মর্মান্তিক খবর প্রতিনিয়তই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। নৈতিকতার এ বিপর্যয় জাতীয়ভাবে আমাদের অসহায়ভাবে সবাইকে অবলোকন করতে হচ্ছে।

এ বিপর্যয় থেকে উদ্ধারের উপায় সম্পর্কে একটু নিরপেক্ষ মন নিয়ে ভেবে দেখলে সবাই এ কথা স্বীকার করবেন যে, ধর্মীয় শিক্ষা মানুষকে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়। আর নৈতিকতা মানুষকে অপরাধ থেকে দূরে রাখে। ইসলামের মূলনীত শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা মৃত্যুযন্ত্রণা, হাশরের ময়দান, পার্থিব জীবনে কৃতকর্মের হিসাব দান, পাপ-পুণ্যের বিচার, বেহেশতের শান্তি ও দোজখের শাস্তি সম্পর্কে অধ্যয়ন করে খোদাভীরু, উন্নত চরিত্রের অধিকারী সৎ ও নিষ্ঠাবান নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। 

মালয়েশিয়া ও ইরানসহ অনেক দেশে উচ্চ মাধ্যমিক স্নাতক স্তর পর্যন্ত সব মুসলিম শিক্ষার্থীর জন্য ইসলাম শিক্ষা বিষয়টি বাধ্যতামূলক চালু আছে। আমাদের দেশেও বর্তমানে ইসলাম শিক্ষা বিষয়টি নার্সারি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করার দাবি উঠেছে। বিশ্ব মানবতার শান্তি প্রতিষ্ঠায় নৈতিক গুণাবলিসমৃদ্ধ জাতি গড়ে তোলার একমাত্র পথ হলো সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার নির্দেশিত পথে চলা। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘নিশ্চয়ই ইসলাম আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র জীবনাদর্শ।’

আইন অনুশাসন যে সমাজকে পরিচালনা করে আদর্শ সে সমাজকে দীপ্তিময় করে তোলে। আদর্শ আইনের প্রতি গভীর অনুরাগ থাকলেই কেবল আদর্শ মানুষ হওয়া যায়। আদর্শ শিক্ষা দেয়ার সর্বোত্তম সময় হলো স্কুল-কলেজের শিক্ষাজীবন। কেননা আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের নীতিনির্ধারক। কাজেই পূর্ণাঙ্গ আদর্শ মানুষ হওয়ার প্রধান ও একমাত্র শর্ত হলো নৈতিক ও মূল্যবোধের জ্ঞানার্জন এবং জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়ার লক্ষ্যে সর্বদা জ্ঞানান্বেষণ করা। সে অনুযায়ী নিজেকে পেশ করা এবং সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় উপনীত হওয়া। 

কিন্তু বর্তমান শিক্ষাক্রম অনুসারে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ইসলাম শিক্ষা বিষয়টি থাকলেও সে বিষয়ে পাবলিক পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে না। ফলে ছাত্রছাত্রীরা ইসলামী শিক্ষা অধ্যয়নে মনোযোগী হচ্ছে না। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম শিক্ষা বিষয়টি পড়লেও প্রকৃত ইসলামী জ্ঞানার্জনে তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। তা ছাড়া বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থীরা ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। 

বাংলাদেশে সরকারি উদ্যোগে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ মাদরাসা বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সরকার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে এ দেশে ইসলাম শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা করেছে। আমাদের দেশে উচ্চ মাধ্যমিকসহ সব স্তরে যদি ইসলামিক শিক্ষা কারিকুলাম চালু করা হয়; তা হলে সৎ-চরিত্রবান ও নিষ্ঠাবান নাগরিক গড়ে তুলে সমাজের সর্বস্তরে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশে কাক্সিক্ষত শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।  

সরকার যদি ইসলাম শিক্ষা বিষয়টি সব স্তরে বাধ্যতামূলক করে; তা হলে  দেশে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষার ফল সব ধর্মের মানুষ ভোগ করতে পারবেন। শিক্ষার্থীরা নৈতিক চরিত্রের অধিকারী ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন আদর্শ আলোকিত মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে বলে আমরা মনে করি। তাই সরকারকে নার্সারি থেকে স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত ইসলাম শিক্ষাসহ সব ধর্মের মানুষের জন্য নৈতিকতার শিক্ষা আরো ভালোভাবে চালু করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

সূত্র : নয়া দিগন্ত


   আরও সংবাদ