ঢাকা, শনিবার, ১৮ মে ২০২৪,
সরকার অনুমোদিত নিবন্ধন নম্বর ১৯১
Reg:C-125478/2015

ডাক্তার ভোগার পর পাল্টাল রংপুর মেডিক্যালের চিত্র

ডেস্ক রিপোর্ট


প্রকাশ: ২ অক্টোবর, ২০২২ ১৪:৩৬ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৩৩২ বার


ডাক্তার ভোগার পর পাল্টাল রংপুর মেডিক্যালের চিত্র

এক চিকিৎকসের মাকে ভর্তি করাতে যাওয়ার পর পদে পদে টাকা আর কর্মীদের হুমকি-ধমকি দেয়ার পর চিকিৎসকরা সোচ্চার হন। তাদের হুঁশিয়ারির মুখে কর্তৃপক্ষও হয় তৎপর। এরপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও নেয় ব্যবস্থা। বদলি করা হয় ১৭ কর্মচারীকে। চুক্তিভিত্তিক দুই জনকে করা হয় বরখাস্ত। এখন রোগী ভর্তি করতে এলে কাউকে বাড়তি টাকা দিতে হয় না। হাসপাতালের পরিবেশও পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম।

২১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। গাইবান্ধা সদর উপজেলার বড় দুর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দা ইশরাত জাহান ইতি কিডনি রোগে আক্রান্ত মাকে ভর্তি করান রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগে। সেদিন জরুরি বিভাগে ভর্তি বাবদ ২০০ টাকা, ট্রলি বাবদ ২৫০ আর বেড পরিষ্কারের জন্য দিতে হয়েছে ৫০ টাকা। কিছুটা সুস্থ হয়ে মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান তিনি।

ঠিক ১০ দিন পর ১ অক্টোবর দুপুরে মাকে নিয়ে ফের হাসপাতালে আসেন ইতি। কিন্তু জরুরি বিভাগে এবার ট্রলির জন্য টাকা চায়নি কেউ, ভর্তি বাবদ ২০০ টাকার বদলে লেগেছে ২৫ টাকা। শয্যা পরিষ্কারের জন্যও কেউ টাকা চেয়ে বিরক্ত করেনি।

হাসপাতালে এমন পরিবর্তন দেখে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ইতি। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মার দুই কিডনিতেই পাথর ছিল। এর আগে একটার চিকিৎসা করা হয়েছে। এবার অন্যটির চিকিৎসার জন্য ভর্তি করলাম। কিন্তু কেউ আমার কাছে টাকা চায়নি। ভর্তি বাবদ ২৫ টাকা নিয়েছে, রিসিটও দিয়েছে। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি প্রশাসন এখন এত শক্ত।’

ইতির কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় বন্ধ হয়েছে এই হাসপাতালেরই এক চিকিৎসক তার মাকে ভর্তি করে এসে ভুক্তভোগী হওয়ার পর। সেই চিকিৎসকের কাছ থেকেও পদে পদে আদায় করা হয়েছে বাড়তি টাকা। পরিস্থিতি এমন ছিল যে, নিজের কর্মস্থল থেকে মাকে তিনি নিয়ে গেছেন এই ভয়ে যে, এখানে থাকলে তার মায়ের চিকিৎসা হবে না।

সেই চিকিৎসক হাসপাতাল পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ করলে তোলপাড় হয়ে যায়। এতদিন সব দেখেও না দেখার ভান করা কর্তৃপক্ষ আর বসে থাকেনি। চিকিৎসক ভোগার পর তারা ব্যবস্থা নেয়ায় আমূল পাল্টে গেছে হাসপাতালের চিত্র। এখন দালালের অত্যাচার নেই, রোগী ভর্তির সঙ্গে সঙ্গে ট্রলি ধরার প্রতিযোগিতা নেই, স্বজনের কাছে বকশিশ চাওয়ার অত্যাচার নেই, নির্ধারিত ভর্তি ফির বাইরে কোনো টাকা দিতে হচ্ছে না।

নোংরা পরিবেশের যে সমস্যায় এতকাল মানুষ ভুগেছে, সেটিও আর নেই। হাসপাতালের ওয়ার্ড, মেঝেতে নেই ময়লা-আবর্জনা। পুরো হাসপাতাল এখন ঝকঝকে চকচকে।

পরিস্থিতির এই চিত্র দেখে বিশ্বাস হচ্ছে না রোগী ও তার স্বজনদের। এদের একজন কুড়িগ্রামের উলিপুরের চাচিনা বেগম। গত চার দিন থেকে হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ছোট ভাইয়ের অসুস্থ স্ত্রীর সঙ্গে আছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘এর আগেও হাসপাতালে ছিলাম আমি। কিন্তু এত ভালো ব্যবহার কেউ করেনি। ডাক্তার, নার্স ও আয়া সবাই যেন বাড়ির লোক। কেউ কখনও খারাপ ব্যবহার করেনি। ভর্তির সময় কেউ কোনো টাকা-পয়সা চায় নাই। শুনছি এদিক-সেদিক টাকা নেয়। কিন্তু কেউ চায় নাই।’

পরিবর্তনের নেপথ্যে
গত ১৭ সেপ্টেম্বর মায়ের চিকিৎসা করাতে অর্থোসার্জারি বিভাগের চিকিৎসক এ বি এম রাশেদুল আমীরের মাকে ভর্তি করানো হয়।

হাসপাতালে ভর্তি ফি ২৫ টাকা হলেও ১০ গুণ ২৫০ টাকা চাওয়া হয়। স্বজনরা চিকিৎসকের পরিচয় জানালে তো নেমে আসে ৫০ টাকায়, তবু তা ছিল নির্ধারিত ফির দ্বিগুণ।

ভর্তির পর রোগীকে করোনারি কেয়ার ইউনিট বা সিসিইউতে পাঠানো হলে সেখানেও দিতে হয় ২০০ টাকা। সেখানে স্বজনরা চিকিৎসকের পরিচয় দেয়ার পর তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়।

এর মধ্যে সেই চিকিৎসক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ভিডিও করেন। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার মাকে ভর্তি করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্টেপে টাকার জন্য চাপ দেয়া হয়েছে। ওই কর্মচারী নিজে মাসুদ নামে পরিচয় দেয়। আমি বিষয়টি একসময় ভিডিও করি। সেটি আমার ফেসবুকে পোস্ট করি।’

পরে সেই ভিডিও ফেসবুক থেকে ডিলিট করে দেন চিকিৎসক রাশেদুল আর লিখিত অভিযোগ দেন হাসপাতাল পরিচালকের কাছে।

এসব ঘটনায় যে হাসপাতালে নিজে চাকরি করেন, সেখানে মায়ের চিকিৎসা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে রিলিজ নিয়ে নেন তিনি। রোগী নিয়ে আসার সময় আবার চাওয়া হয়েছে টাকা, এবার আরও বেশি।

নিউজবাংলাকে রাশেদুল বলেন, ‘হয়তো আমার অভিযোগ অনেকে নানাভাবে নিতে পারে। সর্বশেষ গতকাল সোমবার যখন আমার মাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে চলে আসি তখনও ময়লা পরিষ্কার বাবদ আমার কাছে ৩ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছে। এটা দুঃখজনক।’

হাসপাতালের এই চিত্র নতুন কোনো কিছু নয়। কিন্তু চিকিৎসকরা ছিলেন নির্বিকার। নিজেদের পেশার একজন ভোগার পর অবশেষে তারা সোচ্চার হন। অব্যবস্থাপনা বন্ধের দাবিতে ২৬ সেপ্টেম্বর আন্দোলনে নামেন ‘সম্মিলিত চিকিৎসক সমাজ’।

এরপর কঠোর হয় মন্ত্রণালয়। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রংপুর মেডিক্যালের ১৬ কর্মচারীকে দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে বদলি করা হয়। এরপর কর্মচারীদের আচরণে আসে পরিবর্তন।

এর পাশাপাশি চিকিৎসক রাশেদুল আমীরের স্বজনদের অশোভন আচরণ ও টাকা নেয়ার দায়ে চুক্তিভিত্তিক দুই কর্মচারী মাসুদ ও ঝর্ণাকে চাকরি থেকে বরখাস্তও করা হয়। এতে চুক্তিভিত্তিক অন্য কর্মচারীদের মধ্যেও ভয় ঢুকেছে।

‘চিকিৎসকরা আগে উদ্যোগী হলে আমাদের ভুগতে হতো না’

হাসপাতালের চিত্র পাল্টানোয় খুশি মাকে ভর্তি করতে এসে হয়রানির শিকার হওয়া চিকিৎসক এ বি এম রাশেদুল আমীর। তিনি জোর দিয়েছেন এই পরিবর্তন ধরে রাখার ওপর।

নিউজবাংলাকে রাশেদুল আমীর বলেন, ‘অ্যাজ এ ম্যান অফ রংপুর, আমি সব সময় চাই রংপুরের মানুষ এখান থেকে সবচেয়ে ভালো সেবা পাক। আমরা রংপুরবাসী যদি সবাই এক হই তাহলে এটা ধরে রাখা যাবে। এই যে বদলে গেছে এটাকে ধরে রাখতে হবে।’

স্বস্তিতে স্বজনরা
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা চান মিয়া বলেন, ‘আমি এক মাস আগেও এখানে ভর্তি ছিলাম। তখন ট্রলিতে টাকা নিয়েছে, ভর্তিতে নিয়েছে। ওয়ার্ডে টাকা নিয়েছে। কিন্তু আইজ আমার ছোট ভাইকে নিয়ে হাসপাতালে আছি। কেউ টাকা চায় নাই।’

গাইবান্ধার নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কী বলব আপনাদের? দেখেন হাসপাতাল কত পরিষ্কার। কোথাও কোনো কাগজটাগজ নাই। ময়লা নাই, বাদামের খোল্ডা (খোসা) নাই। বিচনে (বেড) রুম সব পরিষ্কার। নিচতলা থেকে ওপরতলা কেউ টাকাটোকা চাইছে না। এমন পরিবেশ থাকলে তো ভালো হয়।’

কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছের বাসিন্দা বেলায়েত হোসেন লিটু সরকার বলেন, ‘আমার ভাই হৃদরোগে আক্রান্ত ছিল। ছিল সিসিইউতে। এখনকার পরিবেশ অনেক ভালো। এবার সেবা অনেক ভালো পাইছি।’

রাশেদুল মনির নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘আগেই এই হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা নিয়ে বহু অভিযোগ ছিল। তখন কোনো চিকিৎসকই এভাবে প্রতিবাদ করে এগিয়ে আসেনি। যদি এভাবে চিকিৎসকরা এগিয়ে আসত, তাহলে এই হাসপাতাল বহু আগেই দালালমুক্ত হতো। মানুষ এত হয়রানি হতো না।’

কর্তৃপক্ষ যা বলছে
রংপুর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ বিমল চন্দ্র রায় জানান, ‘আমাদের আন্দোলনের কারণে এমনটা হয়েছে কি না, জানি না। আমরা চাই এই হাসপাতালে এসে কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন। যে স্টেপটা নেয়া হয়েছে তাতে যেন হাসপাতালটা ভালো চলে- এই কারণে এই উদ্যোগ। এখন সবাই হেল্প করতেছে- এটা যেন অব্যাহত থাকে। তাহলে মানুষের আস্থার জায়গা থাকবে।'

ডাক্তার ভোগার পর পাল্টাল রংপুর মেডিক্যালের চিত্র
হাসপাতালের পরিচালক শরীফুল হাসান বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে পরিকল্পনা নিচ্ছি। উন্নয়নের চাবিকাঠি হলো পরিকল্পনা। এটা আমার অবদান তা কিন্তু নয়। আমি চেষ্টা করছি মাত্র।’

তিনি বলেন, ‘আমরা একটি সিস্টেম ডেভেলপ করতে চেয়েছি, সেটি করছি। আমরা দেখছি জরুরি বিভাগে সমস্যা আছে, সেখানে ব্যবস্থা নিয়েছি। নিয়মতান্ত্রিকভাবে এখন সব চলবে।’

তবু অভিযোগ অস্বীকার কর্মচারীদের
হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মো. বাদল জানান, ‘আমরা সরকারি কর্মচারীরা কখনও টাকা নেই নাই। আমাদের কর্তব্য আমরা করতেছি, ট্রলি ঠেলতেছি। এখন দালালটালাল নেই। কাউকে টাকা দেয়া লাগে না।’

আপনারা থাকতে টাকা কীভাবে নিয়েছে জানতে চাইলে বাদল বলেন, ‘ওরা আউটসোর্সিংয়ের কর্মী ছিল। যে যার মতো করে নিত। আমাদের উপস্থিতিতে নিত না।’

নাম প্রকাশ না করে একজন নার্স বলেন, ‘আপনি নিজেই দেখেন সিট কত আর ভর্তি কত। একবার রাউন্ডে গেলে কতজন রোগীর কাছে যেতে কত সময় লাগে। কিন্তু অনেক রোগী চায় ডাকা মাত্রই তাদের কাছে যেতে হবে। কিন্তু যার কাছে আছি বা যে রোগীর কাছে আছি তিনি কী অপরাধ করলেন? মূলত ভুল বোঝার কারণে তারা অভিযোগগুলো করে।’


   আরও সংবাদ