ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ২ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৫:৪০ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ৫০৪ বার
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। সত্য ও ন্যায়ের জীবনযাপনের পাশাপাশি বিনোদন ও সংস্কৃতিচর্চায় ইসলাম কখনো নিরুত্সাহিত করে না। বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম খেলাধুলা। সুস্থ শরীর ও সুন্দর মন পরস্পর একে অন্যের পরিপূরক। তবে খেলাধুলা ও বিনোদনমূলক বিষয়াবলিকে ইসলামে খুব সতর্কতার সঙ্গে মূল্যায়ন করা হয়েছে। খেলা যখন শুধু খেলায় এবং বিনোদন যখন কেবল বিনোদনে সীমাবদ্ধ থাকে, তখন ইসলাম এমন খেলা ও বিনোদনে বাধা দেয় না। কিন্তু যখন এটাকে ব্যাবসায়িক রূপ দেওয়া হয়, এর মাধ্যমে অশ্লীলতা ছড়ানো হয় এবং মানুষ এতে আসক্ত হয়ে তাদের অর্থ ও মূল্যবান সময় নষ্ট করে, তখন তাতে নিষেধাজ্ঞা চলে আসে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও রণনৈপুণ্যের প্রয়োজনে তির নিক্ষেপ, বর্শা চালনা, দৌড় প্রতিযোগিতা ইত্যাদিকে ইসলাম সমর্থন করে। নবি করিম (স.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের জন্য তির নিক্ষেপ শিক্ষা করা কর্তব্য। কেননা, এটা তোমাদের জন্য একটি উত্তম খেলা।’ (ফিকহুস সুন্নাহ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬০) হজরত ইবনে উমার (রা.) বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ (স.) হাফইয়া থেকে সানিয়াতুল বিদা পর্যন্ত সীমানার মধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘোড়সমূহের দৌড় প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান করেছেন। স্থান দুটির দূরত্ব ছিল ছয় মাইল।’ (বুখারি, হাদিস নং-৩৬৫৭) অপর এক বর্ণনায় এসেছে, হজরত আলি (রা.)-এর দৌড়ের গতি ছিল খুব বেশি। তিনি দেহ-মনের আনন্দের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে বলেন, ‘অন্তরকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে অবকাশ ও শান্তি দাও। কেননা, অন্তরের অস্বস্তি অন্তরকে অন্ধ করে ফেলে।’
অহেতুক খেলাধুলা, জুয়াবাজি এবং অনর্থক কাজের ভয়াবহ পরিণাম উল্লেখ করে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার দেবী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো, তাহলেই তোমরা সফলকাম হবে। শয়তান তো মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে চায় এবং তোমাদের আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ আদায়ে বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত হবে না?’ (সুরা মায়েদা, আয়াত-৯০-৯১) মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘মানুষের মধ্যে এমন শ্রেণির লোক আছে, যারা খেলাধুলা-কৌতুকাবহ কথা ক্রয় করে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে ভ্রষ্ট করার জন্য। আর এটা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।’ (সূরা লোকমান, আয়াত-৬)
বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত আলেম মুফতি মুহাম্মদ শফী (রহ.) তার রচিত ‘আহকামুল কুরআন’ গ্রন্থে এই আয়াতের নির্দেশনা প্রসঙ্গে বলেন, মহান আল্লাহ এই আয়াতে ঐ সব কথা, কাজ, বস্তু ও বিষয়কে হারাম করেছেন, যা মানুষকে আল্লাহ তাআলার ইবাদত ও স্মরণ থেকে গাফেল রাখে। তা গান-বাজনা হোক বা খেলাধুলা কিংবা ক্রিড়া-কৌতুক—সবই এর অন্তর্ভুক্ত।
ইসলাম নির্দিষ্ট কোনো খেলাধুলাকে জায়েজ বা না জায়েজ বলেনি। বরং তিনটি শর্তের ভিত্তিতে তা জায়েজ-না জায়েজ নির্ধারিত হয়েছে। শর্তগুলো হচ্ছে—(১) শারীরিক উপকার সাধন, (২) ইসলামি শরিয়তের কোনো বিধান লঙ্ঘন না হওয়া এবং (৩) আর্থিক ক্ষতিসাধন না হওয়া। এই তিন শর্ত যে খেলার মধ্যে পাওয়া যাবে তা জায়েজ, আর না পাওয়া গেলে তা বৈধ নয়। ইসলামি স্কলারগণ ইসলামের এই মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে খেলাধুলা সম্পর্কে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। যে কোনো খেলাধুলা বৈধ হওয়ার জন্য তাতে নিম্নোক্ত শর্তগুলো উপস্থিত থাকতে হবে—(১) ধর্মীয় কর্তব্য পালন থেকে উদাসীন না করা: কোনো খেলা বৈধ হতে হলে তার মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে যে, তার নেশার ঘোর যেন মহান আল্লাহর কোনো ফরজ বিধান পালনের কথা ভুলিয়ে না দেয়। খেলার ছলে যেন ফরজ ছুটে না যায়। যেমন কোনো ফরজ নামাজের সময় খেলাধুলা করা। (২) শরিয়তের মহত্ লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত না হওয়া: পৃথিবীতে মহান আল্লাহ মানুষকে পাঠিয়েছেন মহত্ উদ্দেশ্য করে। আর সেই উদ্দেশ্য হচ্ছে তার ইবাদত করা। সুরা আয্যারিয়াতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আমার ইবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছি।’ (আয়াত-৫৬) অতএব, খেলার লক্ষ্য যেন উদ্দেশ্যহীন খেলায় সীমাবদ্ধ না থাকে। খেলাটি যেন হয় শরীরচর্চা, কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি বা ইসলাম রক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ। (৩) সতর আবৃত থাকা :অন্য সময়ের মতো খেলাধুলার সময়েও সতর ঢাকা ওয়াজিব। অথচ অনেক খেলায় সতর খোলা থাকে। হজরত আলি (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘তুমি নিজের উরুকে উন্মুক্ত কোরো না এবং কোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তির উরুর দিকে দৃষ্টি দিও না।’ (আবু দাউদ, হাদিস নং-৪০১৭) (৪) জীবনের জন্য ঝুঁকি না হওয়া :খেলাটি এমন হতে হবে, যাতে জীবননাশের আশঙ্কা না থাকে। সুরা আল বাকারায় মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘নিজের জীবনকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিও না।’ (আয়াত-১৯৫) (৫) খেলা হারাম উপার্জনমুক্ত হওয়া :খেলা বৈধ হওয়ার আরেকটি মৌলিক শর্ত হচ্ছে, সেটি যেকোনো ধরনের জুয়া ও বাজিমুক্ত হওয়া। খেলাধুলার মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক বাজির অর্থ বৈধ উপার্জন নয়। বিষয়টি আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। (৬) খেলায় প্রতিযোগিতার জয়-পরাজয়ে শত্রুতা-মিত্রতা সৃষ্টির সুযোগ না থাকা: খেলাধুলাকে যদি শত্রুতা-মিত্রতার মাপকাঠি বানানো হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তার বৈধতা থাকবে না।
এসব শর্তে খেলাধুলা বৈধ থাকলেও বর্তমানে প্রচলিত খেলাধুলায় ইসলামি মূল্যবোধের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই না। এসব খেলার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি, নামাজ ও অন্যান্য ইবাদতের প্রতি অবহেলা, অন্য ধর্মের অনুসরণ, সময় ও অর্থের অপচয়, জুয়া ও বাজি ধরা, রংখেলা, নৃত্য করা, গান-বাজনা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ইত্যাদি লক্ষণীয়। এজন্য ইসলাম খেলার বল্গাহীন স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। তবে সুস্থ, সুন্দর ও শরিয়তের সীমায় থেকে খেলাধুলা ও শরীরচর্চার প্রতি ইসলাম উদ্বুদ্ধ করেছে। মহান আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন!
লেখক: ঢাকার আজিমপুর দায়রা শরিফের বর্তমান সাজ্জাদানশিন পির ও মুতাওয়াল্লি।